শেষ থেকে শুরু

বাংলাবান্ধা এক্সপ্রেস ট্রেন
ছবি: লেখক

তৃতীয় দিন

বিশাল একটা লম্বা রাস্তা পার হতে হবে, এটা মাথায় নিয়ে গত রাতে বাসে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। মাঝে বাস কয়েকবার দাঁড়াল। কুমিল্লায় এসে চায়ের দোকান থেকে গরম পানি নিয়ে কাপ নুডলস ভিজিয়েছি। একসঙ্গে খাবার ও চা পান। ঢাকায় এসে পৌঁছাই সকাল ১০টায়। স্টেশনে নেমে হাঁটতে হাঁটতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলে গেলাম। সেখানে কয়েকজন বন্ধু থাকে, তাদের সঙ্গে আড্ডা দিলাম কিছুক্ষণ। গোটা দিনটি ছিল বেশ এলোমেলো। দুপুরের খাওয়া সেরে গন্তব্য কমলাপুর রেলস্টেশন। বেলা ২টা ১৭ মিনিটে সিল্কসিটি হুইসেল দিয়ে দিল।

চতুর্থ দিন

বেশ এলোমেলো একটা দিন। গতকাল ট্রেনের চেইন টেনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশনে ট্রেন থামিয়ে দিলাম। বিশাল ব্যাপারস্যাপার। রাতে বন্ধু আকাশের বিছানা দখল নিয়েছি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশনের পেছনে রোজ গার্ডেন বয়েজ হোস্টেল। সকাল সকাল বিছানা খালি করে দিয়ে বের হয়ে পড়লাম চাঁপাইনবাবগঞ্জের উদ্দেশে। বরাবরের মতো রাজশাহীতে এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে বেজে গেল সকাল ১০টা।

আরও পড়ুন
বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টে লেখক
ছবি: অভি

স্টেশন গেটে এসে টিকিট কাটলাম। এরপর অভিকে বোঝাতে লাগলাম, বাসের ছাদে করে যাওয়া দারুণ কিছু। বিতর্ক প্রতিযোগিতায় হেরে ঘণ্টা দুই পর নামলাম সোনা মসজিদ জিরো পয়েন্টে। বর্ডারে একদম সীমানা বরাবর একটি মসজিদে মুখ ও চুল ভিজিয়ে নিলাম। এরপর অটোরিকশায় করে সোনা মসজিদ। এদিক-ওদিক তাকিয়ে কোনো দর্শনার্থী না দেখে কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেলাম। অভিকে আস্তে করে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ঢুকতে দেবে তো?’ পাশ থেকে বেশ বড় গলায় একজন জবাব দিল, ‘কেন দেবে না?’ দ্বিতীয়বার আরেকটু ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, ‘না মানে ভেতরে দেবে তো ঢুকতে?’ ‘আরে কেন দেবে না? দিতে বাধ্য।’

 পরিচয় হয় সাজ্জাত সরোয়ার ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি ছোট অক্ষরে নিজেকে পরিচিত করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। পেশায় একজন আইনজীবী। ছোট অক্ষরে লেখা ভিজিটিং কার্ড তাঁর ভিন্নতা সহজে তুলে ধরে।

 পূর্ব নাম শেরগঞ্জ। সম্রাট শের শাহর নামানুসারে নামকরণ। তবে হিন্দু সম্প্রদায় তাদের অন্যতম দেবতা ‘শিব’–এর পূজার জন্য শিবগঞ্জ বাজারসংলগ্ন একটি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করে এবং শিবপূজা ব্যাপক প্রচারণা লাভ করে। একসময় পরিবর্তন হয়ে যা হয় শিবগঞ্জ। মসজিদের মাঝখানের দরজার ওপরে প্রাপ্ত এক শিলালিপি থেকে জানা যায়, সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহর শাসনামলে (১৪৯৪-১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দে) ওয়ালি মোহাম্মদ নামের এক ব্যক্তি এই মসজিদ নির্মাণ করেন। তবে শিলালিপিতে নির্মাণের সঠিক তারিখসংবলিত অক্ষরগুলো মুছে যাওয়ায় নির্মাণকাল জানা যায়নি। আমি আর অভি অবাক হয়ে সাজ্জাত ভাইয়ের বলা ইতিহাস মন দিয়ে শুনছি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনা মসজিদের সামনে লেখক ও তাঁর সঙ্গী, মাঝে স্থানীয় যুবক সাজ্জাত সরোয়ার
ছবি: লেখক

সাজ্জাত ভাই বলছেন, ‘বাংলায় স্থলপথে এটিই ছিল মুসলিম আধিপত্য, অথচ বাংলায় প্রথম ইসলাম প্রচারণা শুরু হয় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে।’ আমি ইতিহাসবিদ নই। তবে আমার এই ছোট্ট চিন্তাশক্তিতে এর দুইটা কারণ বোধগম্য হলো। প্রথমত, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা। হোসেন শাহর রাজত্বকাল পরিচিত ছিল হিন্দু প্রজাদের প্রতি তাঁর উদার দৃষ্টিভঙ্গির জন্য। সে সময় মধ্যযুগের সমাদৃত ধর্মগুরু চৈতন্য মহাপ্রভু ও তাঁর অনুসারীরা ভক্তি প্রচার করেন। পরবর্তীকালে আলাউদ্দিন হোসেন শাহর প্রশাসনের দুজন উচ্চপর্যায়ের হিন্দু কর্মকর্তা ব্যক্তিগত সচিব রুপা গোস্বামী ও তাঁর ঘনিষ্ঠ মন্ত্রী সনাতন গোস্বামী চৈতন্য মহাপ্রভুর অনুসারী হন।

 দ্বিতীয় কারণ, ত্রিপুরায় হোসেন শাহর অভিযানের সময় আরাকানের শাসক ত্রিপুরার শাসককে সাহায্য করেন। তিনি চট্টগ্রামও দখল করেন এবং হোসেন শাহর কর্মকর্তাদের সেখান থেকে বিতাড়িত করেন। ফলে এই গোটা সময় ধর্ম প্রচারণা মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারেনি বলে আমার মনে হয়।

 সাজ্জাত ভাইয়ের প্রশ্ন, ‘এত বিশাল একটি জনপদ। এর একটি শাসনামলকে বলা হয় স্বর্ণযুগ। তাহলে কেন শেষ দিকে এই জনপদ বিলুপ্ত হয়ে গেল?’ এটি আমাকেও বেশ কৌতূহলী করে তোলে। তবে খুব সম্ভবত কিছু অমানবিক নির্যাতন এর জন্য দায়ী। যেমন ক্ষমতালাভের পর গৌড়ে লুটপাট থেকে সৈন্যদের ফিরে আসার আদেশ দেন সুলতান। কিন্তু তাঁরা তা অব্যাহত রাখলে তিনি ১২ হাজার সৈন্যকে মৃত্যুদণ্ড দেন এবং লুট হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধার করেন। এ রকম বেশ কিছু নির্যাতনের বিবরণ হতে পারে একটি কারণ।

 যা–ই হোক, সিএনজিতে উঠে চলে আসি শিবগঞ্জ সদরে। আরেকটি মাইলফলকের খোঁজে। এদিকে এসে বুঝতে পারলাম, চাঁপাইকে কেন আমের রাজধানী বলা হয়। খাওয়া শেষে চলে গেলাম চাঁপাইনবাবগঞ্জে। ভেবেছিলাম, চাঁপাই থেকে সরাসরি পঞ্চগড়ে যাওয়ার ট্রেন পেয়ে যাব। পড়ন্ত উদাস বিকেলের প্রকৃতির মতো আমি আর অভি দুজনেই হতাশ। পরে রাজশাহীগামী একটি লোকাল বাসে উঠলাম।

 আমাদের পরবর্তী যাত্রা বাংলাবান্ধা এক্সপ্রেস ক ৪৯-৪৯...

শিবগঞ্জ উপজেলা
ছবি: লেখক

পঞ্চম ও শেষ দিন

একটা হাফ টিকিট, আরেকটা জোগার করা টিকিট দিয়ে রাতে পঞ্চগড় এক্সপ্রেসে চেপে বসি। পরিচয় মুন্না কাকুর সঙ্গে। শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরছেন নিজ বাড়িতে। প্রথমত, উত্তরের মানুষ অনেক ভালো। দ্বিতীয়ত, তিনি আসলেও অনেক অমায়িক মানুষ। ট্রেনের ওয়াশরুমে সারলাম বৈশ্বিক দাঁতমাজন ও প্রাকৃতিক নির্বাচন। ট্রেন থামল। আবদুল্লাহপুর জংশনে এসে ইঞ্জিন চেঞ্জ করবে। চা পানের জন্য জানালা দিয়ে ডাকলেন মুন্না কাকু। বললেন, তাঁর নেপালে থাকার গল্প, বিহারি হয়ে বাংলাদেশে বসবাসের অভিজ্ঞতা। গোটা রাত শুধু ক্রসিংয়ে থামতে থামতে কেটে যায়। ৫ ঘণ্টার রাস্তা ১০ ঘণ্টা লাগল। অন্য সময় হলে অবশ্যই বিরক্ত লাগত। আমাদের শেষ ট্রেন, তাই ঘরে ফেরার তাড়া ছিল না। ভালো লাগার বিষয় ছিল, ক্রসিংগুলোতে ট্রেন থামলে নতুন এক স্টেশন। নতুন মানুষ, অদ্ভুত তাঁদের ব্যস্ততা।

 ভোরের আলো গায়ে লাগতেই ঘুম ভেঙে যায়। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই। বাংলাবান্ধায় চলে এসেছি। স্টেশনে নেমে মুন্না কাকুর লেজ ধরলাম। ভ্যানগাড়িতে চেপে গেলাম পঞ্চগড় বাজারে। সকালের পরোটা আর গ্লাসভর্তি চা খাওয়ালেন। এবার কথা হলো শামীম ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি মুন্না কাকুর সঙ্গে চায়ের ব্যবসায় জড়িয়ে ১০ বছরের চিকিৎসকজীবন কাটিয়ে দিয়েছেন এই তেঁতুলিয়ায়।

সোনা মসজিদ
ছবি: লেখক

মানুষ এমনই! কার গন্তব্য কোথায় থেমে যায়, বলা মুশকিল।

পঞ্চগড় থেকে তেঁতুলিয়া, ঘণ্টাখানেক সময় লাগবে বড়জোর। সমতল ভূমির চা–বাগানে ছেয়ে আছে রাস্তার দুই পাশ। রাস্তার পাশ দিয়ে দেখা যাচ্ছে ভারতের চা–বাগান। সকালের হিমেল বাতাস ভেতরের সব টক্সিক ব্যাপারগুলোকে জল করে দিচ্ছে। দুপুর ১২টায় বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টের কাছে। আমাদের শেষ মাইলফলক। এক দিকে দারুণ রোমাঞ্চ কাজ করছে, অন্যদিকে খারাপও লাগছে।

 এই যাত্রার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের শেষ চার সীমান্ত এলাকার মানুষের জীবন-জীবিকা ও তাঁদের ছন্দের স্বাদ নেওয়া, যা আমরা করেছি। আমরা পেয়েছি অনেক উদার মানুষ ও তাঁদের আতিথেয়তা। বাংলাদেশ সুন্দর। এত এত বৈচিত্র্য নিয়ে বাংলাদেশ এক ও সার্বভৌমত্বের আলপনা আঁকছে। কারোর ইতিহাস নিষ্ঠুরতা শেখায়, কারোর ইতিহাস যুদ্ধ শেখায়, আবার কেউ শেখায় সমৃদ্ধ হতে। এই ভিন্নতা আপনাকে দেখাবে কীভাবে মানিয়ে নিতে হয় পরিবর্তন, কীভাবে ছুটতে হয় নিরন্তর অথবা কীভাবে হয় ইতিহাসের প্রস্থান।

সন্ধ্যায় মহানন্দা নদী
ছবি: লেখক

মহানন্দা নদীর তীরের পাথর ভেঙে জীবন যাপন করা সহজ মানুষগুলোর সঙ্গে গল্প করতে করতে বিকেল গড়িয়ে এল। মুন্না কাকু তাঁর বাড়িতে খাবারদাবারের আয়োজন করবেন। আমরা সামনের বারের জন্য তুলে রাখলাম। তিনি আমাদের একটা নিমকি ভেঙে মিষ্টি খাইয়ে পঞ্চগড়ের বাসে তুলে দিলেন।

সন্ধ্যায় পঞ্চগড়ে এসে সেই খরস্রোতা করতোয়ার জলে গা এলিয়ে দিয়ে অভি মেলাল জীবনের হিসাব, আর আমি মেলালাম এই যাত্রার হিসাব। আমাদের নির্ধারিত অঙ্কের চেয়ে হাজারখানেক টাকা কম খরচ হয়েছে। এই পাঁচ দিনে আমরা নিরামিষ ছিলাম চার দিন। রাতে স্টেশনে এসে ট্রেন আসার আগে ব্যাগের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে নিলাম কিছুক্ষণ। কারণ, ঢাকা অবধি টিকিট পাইনি। পাঁচবিবিতে এসে সিট ছেড়ে দিতে হবে।

 সবশেষ আসলে সমাপ্তি নয়, আজ এখান থেকে নতুনভাবে শুরু হলো আরেকটি দিন।

 একতা এক্সপ্রেস জ ৭০-৭১…

বন্ধু, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা