নামহীন

ছবি: এআই/বন্ধুসভা
জয়িতার সঙ্গে পরিচয়ের পরের সময়ে ট্রেনের গতি কত ছিল, সে খেয়াল নেই জীবনের। তবে তার বুকের বাঁ পাশের ঘড়িটার বেগ যে দ্রুততর হয়েছে, সেটা অনুভব করতে পেরেছিল ঠিকই।

জসীম টি-স্টল, গৌরিপুর জংশন। দুই কাপ গরম চা জয়িতা আর জীবনের হাতে।
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে বাইরে। বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেনটি প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজে দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি দূর করে নিচ্ছে। জয়িতা আর জীবনের পরিচয় যে ঘণ্টাখানেক আগে, সেটা তাদের কথাবার্তায় বোঝার কোনো উপায় নেই। পরিচয় স্বল্প সময়ের হলেও তাদের গন্তব্য একই স্টেশনে।

জীবন যখন ট্রেনে ওঠে, ঠ বগির ৩২ নম্বর সিটটাকে দূর থেকে দেখে প্রথমেই তার দৃষ্টি যায় পাশের সিটের তরুণীর ওপর। পাঁচ বছর ধরে একা যাতায়াত করলেও কখনো এমন কোনো মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়নি যে একা যাতায়াত করে, তাও এত দূরত্বে। যথারীতি দুজনে নিজেদের আসন গ্রহণ করে এবং যাত্রা আরম্ভ। জয়িতার সময় কাটে গান শুনে, ঘুমিয়ে। জীবন অভ্যাসমতো বই পড়ে, মাঝেমধ্যে গানও শোনে। ট্রেন তার নিজস্ব ধীরগতিতে এগিয়ে চলছে।

হঠাৎ কোথা থেকে যেন পাঁচ বছর বয়সী একটি মেয়ে এল। এসেই জয়িতার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল। জয়িতাও স্নেহ–মমতায় পিচ্চিটাকে কাছে টেনে নিল। পাশের সিট থেকে জীবনও জমজমাট এই আড্ডায় শরিক না হয়ে পারল না। হাস্যোজ্জ্বল দীর্ঘ আড্ডা শেষে পিচ্চিটা চলে গেলে জয়িতা আর জীবন একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হলো। নিজেদের বিষয়ে আলাপ দিয়ে শুরু হলেও অল্প সময়েই সমাজ, রাজনীতি, দেশ, বিশ্বের নানা দিক উঠে এল আলাপে। জীবন সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়েছে সাংবাদিকতায়। আর জয়িতার বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু মাত্র এক বছর হলো। দুজনের বয়সে পার্থক্য থাকলেও মানসিকতায় অনেক মিল। সহজেই একে অপরের চিন্তার জগতে তাল মেলাতে পারল।

জয়িতার সঙ্গে পরিচয়ের পরের সময়ে ট্রেনের গতি কত ছিল, সে খেয়াল নেই জীবনের। তবে তার বুকের বাঁ পাশের ঘড়িটার বেগ যে দ্রুততর হয়েছে, সেটা অনুভব করতে পেরেছিল ঠিকই। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। ময়মনসিংহ জংশনে চলে এসেছে ট্রেন। জীবন ব্যাগ নামাতে জয়িতাকে সাহায্য করে। হেঁটে স্টেশনের বাইরে এসে একটা অটো ডেকে দিয়ে জিনিসপত্র তুলে দেয়। এবারে দুজনের বিদায়ের পালা। জয়িতা জীবনের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় হ্যান্ডশেকের জন্য। ‘নাইস টু মিট ইউ, ইট ওয়াজ আ গ্রেট ডে’। জীবনও কিছুটা থতমত খেয়ে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে। তার মুখ থেকে শুধু বের হয়, ‘আবার দেখা হবে ইনশা আল্লাহ।’

অবশ্য দুজনই জানে যে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। দুজনের গন্তব্য ভিন্ন। চলে যায় ভিন্ন পথে, ভিন্ন দুটি বাস্তবতায়।

জীবনের অনুভূতির জগতে সেই দিনের কয়েক ঘণ্টার জার্নি আর জয়িতা অনেকটা জায়গা দখল করে নিয়েছে। সেদিন বিদায়ের আগে জীবন ঠিকই ফোন নম্বর নিয়ে রেখেছিল। তবে কেন জানি আর ফোন করা হয়নি। সে জয়িতাকে তার মন থেকে বের করতে পারেনি। মাঝেমধ্যে অল্প সময়ের ব্যথা, আনন্দ কিংবা সুখ-দুঃখের স্মৃতি আমরা বয়ে বেড়াই, হয়তো সেগুলো আমাদের সারা জীবন আনন্দ দেয় অথবা হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগায়।

আজ পহেলা আষাঢ়। মাঝখানে কেটে গেছে কয়েকটি বর্ষা। জীবন আবারও হাজির জসীম টি-স্টল, গৌরিপুর জংশনে। সঙ্গে দুই কাপ গরম চা আর জয়িতার সুন্দর স্মৃতি। বিজয় এক্সপ্রেস কাকতালীয়ভাবে আজও প্লাটফর্মে দাঁড়ানো। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জীবন চায়ের দোকানিকে বলল, ‘মামা, আপনার দোকানের চা এই পুরো স্টেশনের সেরা চা।’ প্রতিউত্তরে দোকানি বলল, ‘কে কইসে আফনারে এই কথা?’

জীবন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কথাটা যে তাকে জয়িতা বলেছে, এটা আর বলা হলো না। হঠাৎ তাকিয়ে দেখল, বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেনটা প্লাটফর্ম ছেড়ে ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে দৃষ্টিসীমার বাইরে। জীবন সেই ট্রেনের দিকে তাকিয়ে কল্পনা করছে জয়িতার কথা। ভাবছে বয়ে নেওয়া নামহীন এই সম্পর্কটাকে কী নামে অভিহিত করবে সে? জীবন চোখ বন্ধ করে তার এই বেহাল মনোজাগতিক অবস্থা অনুভব করল। মনে পড়ল পছন্দের কবি আবুল জীবনের ‘সম্পর্ক’ কবিতাটির কথা—
‘তুমি নও, তোমার ভিতরে এক অটল দ্রাক্ষার
আসন্ন মধুর মদ, মাতোয়ারা বানায় আমাকে!
গেলাসে গেলাসে দিন—ঝরে পড়ি ঝর্ণা আয়োজনে।’

সাবেক সহসভাপতি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা