তারুণ্যের লবর

বৈশাখী মেলায় নাগরদোলায় চড়ে আনন্দে মেতেছে সবাইছবি: এ কে এম ফয়সাল

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার ছেলেবেলা’ পড়ার সময় মনে হতো আমার সঙ্গে প্রচুর মিল আছে। এক-আধ দিন স্কুলে না গেলে, শিক্ষকের কাছে না পড়লে ওই বয়সে তেমন কোনো ক্ষতি হবে না—এই আবদার আমার স্বর্গীয় ঠাম্মা (ঠাকুর মা) মেনে নিলেও বাবা, দাদা (ঠাকুরদা) ও শ্রদ্ধেয় স্বর্গীয় হরেন্দ্র স্যাররা মানতে নারাজ। সাত ভাইবোনের (ছয় বোন, এক ভাই) আদুরে ভালোবাসায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের উচালিয়া পাড়ার গ্রামের বাড়িতে আমার বেড়ে ওঠা। এ বাড়ির একমাত্র বক্তব্য ছিল পড়াশোনা করা! ভালো খাবার ও পড়াশোনা। সেই সময়ে একটি অজপাড়াগাঁয়ে বাস করেও ঠাম্মা-দাদা কীভাবে বুঝতে পেরেছিলেন, জীবনে পড়াশোনার চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই, ভেবে অবাক হই।

আমার মা মুখে কিছু বলতেন না, মারধরের তো প্রশ্নই ওঠে না; শুধু তাকানোতেই বুঝতাম—মা কী পছন্দ করছেন আর করছেন না। শৈশবে বরিজ্ঞা স্কুল, সরাইল অন্নদায় পড়ার সময় বছরের আকর্ষণীয় উৎসব ছিল আলন্তী (পৌষসংক্রান্তি), লক্ষ্মীপূজা ও ফরিক্কা লবর বান্নি। সরাইলের আঞ্চলিক ভাষায় লবর মানে মেলা, বিশেষত বৈশাখী মেলা। এই লবরকে ঘিরে ছিল আমাদের পাড়ার বন্ধুদের বছরজুড়ে সব জল্পনাকল্পনা। বাল্যবন্ধু তনু, কর্তা, নন্দন ও সঞ্জীব। সঞ্জীব ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সরাইলে আসত, আমরা ওর কাছ থেকে অবাক দৃষ্টিতে শহুরে গল্প শুনতাম। ঢাকা থেকে ট্রেনে টিকিট ছাড়া সে কীভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে আসত, তা–ই শুনে পুলকিত হতাম! আরেকটি মজা ছিল লক্ষ্মীপূজায় বাজি ফোটানো এবং আলুন্তিতে কনকনে শীতের মধ্যে ভোরবেলা পুকুরে স্নান করে আগুন পোহানো এবং বিকেলে ভজন কাকুর নেতৃত্বে কীর্তন ও লুট! এখন এসব শুধুই স্মৃতি। সভ্যতার জোয়ারে, ঢাকার ইট-কাঠ-পাথরের খাঁচায় বসবাস, পেশাগত তীব্র ব্যস্ততা, ফেসবুক-টুইটারের আড়ালে শৈশব-তারুণ্য ও পরিণত বয়সের আড়ালে লবর, আলুন্তি কিংবা লক্ষ্মীপূজা এখন পালন করা হয় বটে, কিন্তু সেই আমেজ খুঁজে বেড়াই নিরন্তর!

ঢাকায় প্রায় প্রতিদিনই মেলা হয়। বৈশাখ মাস লাগে না। পাড়া, মহল্লা, শপিং মল কিংবা বেইলি রোডে ১২ মাসই কোনো না কোনো মেলা থাকে, কিন্তু সেগুলো প্রাণহীন মনে হয়। বাঁশের বাঁশির জায়গায় স্থান পেয়েছে ভুভুজেলা, মাটির গরু-হরিণের পরিবর্তে পাইরেক্স কিংবা মাটি-বাঁশের টমটমের জায়গায় রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি অথবা তরমুজের চিলতের পরিবর্তে ওয়াটার মেলন জুস!

অবশ্য এখন এগুলো ভিন্ন স্বাদের মনে হয়। তারুণ্যের স্বাদ পেয়েছিলাম নটর ডেম কলেজে পড়ার সময়। ১৯৯২ সালের কথা। ঢাকায় এসে তখন মনে হতো স্বপ্নের শহরে এসেছি। কিন্তু সেই দুই বছর ছিল কঠিন সময়। নটর ডেম কলেজকে বলা হতো বড়দের কিন্ডারগার্টেন। পড়াশোনা ছাড়া আর কিছু নেই! সে সময়ে তারুণ্যের মজা ছিল কলেজকেন্দ্রিক। নটর ডেম সায়েন্স ক্লাব, ন্যাচার স্টাডি ক্লাব, বন্যার্তদের সাহায্য ইত্যাদি। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ঢাকা কলেজে গুরু আজম খানের কনসার্ট দেখতে গিয়ে টেরেন্সের ধাপ্পানি খেয়েছিলাম কয়েকবার। বুঝতে পেরেছিলাম, নটর ডেমিয়ানদের ভাগ্য ঢাকা কলেজের বন্ধুদের মতো এত সুখকর নয়। এরপর কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে পড়তে গিয়ে ছয় বছর সব অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রায় সর্বাগ্রেই থাকতাম আমি। এরপর পেশাগত জীবন শুরু, প্রিয় জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী মিশন হাসপাতালে। তখন ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুল মাঠের মেলা, কালভৈরবের উৎসবের মেলার স্বাদ পেয়েছিলাম। তিন বছর আগে ঢাকার যান্ত্রিক জীবন থেকে একটু স্বস্তি পাওয়ার আশায় হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিলাম শৈশবের সরাইলের ফরিক্কা লবরে যাব। ঠিকই পৌঁছেছি প্রাণের মেলায়, তবে আর হাফপ্যান্ট পরে নয়। একেবারে পূর্ণ বয়সে আমার স্ত্রী নীতু, আমার একমাত্র সন্তান দিব্যময় ঋজুসহ সপরিবার। শৈশব, তারুণ্য ও পরিণত বয়সের সব উপলব্ধিতে বুঁদ হয়েছিলাম সেদিন।

লেখক: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, প্রথম আলো বন্ধুসভার জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সাবেক স্বাস্থ্য সম্পাদক।

প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের প্রকাশনা ‘তারুণ্য’, সপ্তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১৮ থেকে নেওয়া।