চট্টগ্রামের পটিয়া নয়াহাট পেরিয়ে গেলে দক্ষিণ হুলাইন গ্রাম। আরাকান সড়ক থেকে তিন মিনিট হেঁটে গেলে পুঁথি–গবেষক ইসহাক চৌধুরীর বাড়ি। বাড়ির সামনে পুকুর, পাশে অমর পুঁথি–গবেষক আবদুস সাত্তার চৌধুরীর সমাধি। বাড়িতে প্রবেশ করলেই ড্রয়িংরুমে চোখে পড়বে ইসহাক চৌধুরীর বিশাল সংগ্রহশালা। পুকুরের পাশে সাড়ে তিন হাত মাটির কুঁড়েঘরে চিরতরে শুয়ে আছেন তিনি।
পিতার কাছে পুঁথিপাঠের হাতেখড়ি। পিতার অনুপ্রেরণায় নিজের মেধা ও মননে পুঁথি সংগ্রহ ও সংরক্ষণে উৎসাহিত হন। ইসহাক চৌধুরী ছিলেন বিবলিওগ্রাফার, পুঁথি–গবেষক। পুঁথি নিয়ে জীবনের সঙ্গে খেলা করা ছিল নেশা। সংগ্রহ, সংরক্ষণ থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার পদে চাকরি করা অবস্থায় নিয়মিত লিখেছেন চট্টগ্রামের স্থানীয় দৈনিক পত্রিকায়। আশির দশকে লেখক ও গবেষক শামসুল হক সম্পাদিত পটিয়া থেকে প্রকাশিত মাসিক অভয়বাণী পত্রিকার মাধ্যমে লেখালেখি শুরু করেন। আবদুস সাত্তার চৌধুরী ইন্তেকালের পরে ইসহাক চৌধুরী পুঁথির সাগরে সাঁতরে বেড়িয়েছেন। ১৯৬৬ সাল থেকে বাবার কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল ও জনপদে পুঁথি সংগ্রহের জন্য সাহিত্যের প্রতিটি পরতে পরতে বিচরণ করেছেন।
ইসহাক চৌধুরী ছিলেন লোকসাহিত্যের কিংবদন্তি। ৫৭ বছরের পুরোনো সংগ্রহশালায় পুঁথি বই ছাড়াও ব্রিটিশ আমলে পটিয়া কাগজী পাড়ায় হাতে তৈরি কাগজ পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রেখেছেন। আরও রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিভিন্ন বই, গল্প, কবিতা, ধর্মীয় গ্রন্থ—বিশেষ করে সুফি–সাধকদের জীবনীসহ নানা দুর্লভ বই।
তাঁর দুর্লভ সংগ্রহ পুঁথির মধ্যে রয়েছে কবি সৈয়দ গাজী বিরচিত ‘শাস্ত্রবার্তা’, কবি জমসের আলী বিরচিত ‘চারি মোকামবেদ’, মহিলা কবি বিরচিত ‘স্বামীর বিলাপ’, কবি শরফুদ্দিন বিরচিত ‘কোরআনের মাহাত্ম্য বয়ান’, কবি আবদুল মজিদের ‘বে-নজির বদরে মুনির’, কবি আজমুল্লাহ বিরচিত ‘খোলাছাতুন মুছল্লিন’, কবি ছৈয়দ আলম বিরচিত ‘হিন্দুয়ানী ইমামের ছাওয়াল’, কবি শেরবাজ বিরচিত ‘মহাব্বত নামা’, কবি মোহাম্মদ হোসেন বিরচিত ‘শরা শরীয়ত’, কবি লাল খান শাহ বিরচিত ‘মুসানামা’, কবি মনচুর শাহ রচিত ‘যোগ কালন্দর’, কবি সুমন বিরচিত ‘সুগত শাসন’, কবি আমির উদ্দীন বিরচিত ‘মনচোরের কেচ্ছা’, কবি হিলাল খাঁ বিরচিত ‘নূর নামা’ ইত্যাদি। এসব পুঁথি কিছু কাগজে লেখা, কিছু তালপাতায় লেখা, কিছু তুলট কাগজে লেখা। ইসহাক চৌধুরীর সংগ্রহশালায় তিন হাজারের অধিক বই রয়েছে। হাতে লেখা পবিত্র কোরআন শরিফও আছে। ক্ষুদ্র আকারের একটি দুর্লভ কোরআন শরিফ আছে, যেটি তিলাওয়াত করতে হলে আতশি কাচের প্রয়োজন হয়।
জীবদ্দশায় তিনি ভাদ্র মাসে তীব্র রোদের মধ্যে পুঁথিগুলো নাড়াচাড়া করে যত্নসহকারে শুকাতেন। কোনো বই–পুঁথি যদি দেখতেন যে কীটপতঙ্গের হামলায় আহত হয়েছে, তাঁর মন খারাপ থাকত। দু-চার দিন নাওয়াখাওয়া বন্ধ করে বাকরুদ্ধ থাকতেন। আহমদ ছফার একটা লেখায় পড়েছিলাম, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক স্যার নাকি পুরোনো দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থসমূহকে ‘পাঁজরের হাড়ের মতো রক্ষা করতেন। যেসব বইয়ের পাতা বিবর্ণ হয়ে এসেছিল, যত দিন সক্ষম ছিলেন, নিজের হাতে বইগুলো যত্ন করতেন, মুছতেন, রোদে দিতেন এবং পাউডার ছড়াতেন।’ ৫৭ বছরের সংগ্রহশালাটি সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। মৃত্যুর আগপর্যন্ত পরম যত্নে হৃদয়ের সিন্দুকে আগলে রেখেছিলেন। যাঁরা বই ভালো করে পড়তে পারেন, তাঁরা মানুষের হৃদয়ের না বলা পাণ্ডুলিপিও পড়তে পারেন, মানুষের মনের অলিতে–গলিতে অবাধে বিচরণ করতে পারেন। সে জন্য বোধ হয় বই অনন্ত যৌবনা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মকালীন ইসহাক চৌধুরীকে পুঁথি গবেষণার কাজে উৎসাহ দিয়েছেন অধ্যাপক সুলতান আহমেদ ও অধ্যাপক মনিরুজ্জামান। একবার মালঞ্চ আয়োজিত পটিয়ায় ইতিহাসবিদ অধ্যাপক আবদুল করিম স্মরণসভায় ইসহাক চৌধুরীকে নিয়ে অধ্যাপক মনিরুজ্জামান বলেছিলেন, ‘আমি ডক্টর অধ্যাপক হতে পারি, কিন্তু আমার চেয়েও অনেক বড় ডক্টর হলো ইসহাক চৌধুরী। তাঁর পুঁথি–গবেষণা, লোকসাহিত্য ও ইতিহাস বিষয়ে পাণ্ডিত্য আমাকে মুগ্ধ করে।’
ইসহাক চৌধুরীর পুঁথি–গবেষণায় পাণ্ডিত্য আজও আলোর দ্যুতি ছড়াচ্ছে। পুঁথিসাহিত্যে নিবেদিতপ্রাণ হিসেবে সর্বশেষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন তিনি।
ইসহাক চৌধুরী আমার কাছে ছিলেন জীবন্ত অভিধানের মতো। একসময় ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে দৈনিক পূর্বকোণের শহর থেকে দূরে নামে একটি পাতা ছিল, নিয়মিত লিখতাম। কোনো তথ্যের প্রয়োজন হলে ছুটে যেতাম ওনার কাছে। গেলে সঠিক তথ্য পেতাম। তিনি আমার লেখালেখির গুরু, যার কাছ থেকে প্রতিনিয়ত শিখে এসেছি। লেখার জন্য সব সময় অনুপ্রাণিত করতেন। ২০২০ সালে টইটম্বুর প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘চাটগাঁইয়া মেজ্জান’ বইটি পড়ে বইয়ের আলোকপাত করেছিলেন।
পুঁথি–গবেষক ইসহাক চৌধুরী গ্রামীণ জীবনযাপন পছন্দ করতেন। শহরে থাকতে চাইতেন না। মিষ্টভাষী ও বিনয়ী ছিলেন। খুব সহজে মানুষকে আপন করে নিতেন। মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে থাকতেন। সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। বেশ ধার্মিক ছিলেন। এতিমখানার ছাত্রদের খাওয়াতে পছন্দ করতেন। আতিথেয়তা, আপ্যায়ন এবং প্রিয়জনদের দাওয়াত করে খাওয়ানো ছিল তাঁর বড় গুণ। বই পড়তে পছন্দ করতেন। কখনো পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অভিমান করলে বই নিয়ে বসে যেতেন। তাঁর সংগ্রহশালার প্রতিটি পুঁথির পরতে পরতে মুহুর্মুহু বেজে উঠেছে লোকসাহিত্যের আনন্দিত আত্মা। ইসহাক চৌধুরী মরেও অমর হয়ে থাকবেন অনন্তকাল।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পুঁথি–গবেষক ইসহাক চৌধুরীর সংগ্রহশালাটি নিয়ে একাডেমি স্থাপন করা হলে আগামীর প্রজন্মরা পুঁথি নিয়ে গবেষণা করতে পারবে। আজ কীর্তিমান পুঁথি–গবেষক ইসহাক চৌধুরীর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
উপদেষ্টা, পটিয়া বন্ধুসভা