মরীচিকা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

পাশে রাখা হাতঘড়ির টিকটিক শব্দ স্পষ্ট কানে আসছে। চারপাশের কোলাহল যখন থেমে যায়, তখন মনের কথা শুনতে পাওয়া যায়। এই মুহূর্তে সেই চেষ্টা করছে তাশহান। কানে এল কান্নার শব্দ...
কে কাঁদছে?
আমি।
ভেতর থেকে কেউ একজন জবাব দিল, একটু চমকে উঠে তাশহান, আজকাল ছোটখাটো ব্যাপারে ভয় পায় না সে, যে মানুষটা সবচেয়ে দামি জিনিস শত চেষ্টা করেও আগলে রাখতে পারে না, তার এসব ব্যাপারে ভয় পাওয়াটা বড্ড বেমানান।

কে তুমি? কাঁদছ কেন?
আমি তোমার বিবেক-জ্ঞান-মন, যা ইচ্ছা ডাকতে পারো। আমার এই অবস্থা কেন, তুমি ভালো করেই জানো।
সময়ের ব্যবধান আর বাস্তবতা নিয়ে হিসাবগুলো কিছুতেই মেলাতে পারছি না।
হিসাব করে কিছু হয় না, একটা সিদ্ধান্ত তো নিতেই হবে।
সব সময় সাহায্য করেছ আমাকে, এবারও করো।
সঠিক সিদ্ধান্তটা তোমাকেই নিতে হবে।
আমি যা চাই, তা কখনোই সম্ভব নয়।

মনের কাছ থেকে আর কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। কয়েক দিন ধরে হুমায়ূন স্যারের কয়েকটি বই পড়েছে তাশহান। উপন্যাসের চরিত্রগুলোর সংমিশ্রণে মনের ভেতর মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। চরিত্রগুলোর সাথে মাঝেমধ্যে কথোপকথন চলে। ড্রয়ার খুলে ডায়েরিটা বের করে লিখল মিশ্র চরিত্র।
তাশহান শুনছ...
পরিচিত কণ্ঠ। এবার চমকে উঠল তাশহান, এভাবে যে ডাকে, সে তো দূরে চলে গেছে। তাহলে কে ডাকছে?
ঝুম করে নামল বৃষ্টি, ক্ষণিকের মধ্যেই নিথর চারপাশটা সংগীতের পরিবেশে রূপ নিল। বৃষ্টিফোঁটার শব্দ আর গাছের পাতার আলোড়ন চমৎকার সংগীত তৈরি করেছে, বৃষ্টি হলেই একমনে সুর শোনে সে। বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াল তাশহান।
তুমি সত্যিই ভিজতে যাচ্ছ!

পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে প্রিয় মানুষটি বসে আছে চেয়ারে, মুচকি হেসে দরজার দিকে যাচ্ছে তাশহান। আর নিজেকে বলছে, আমার অবস্থা খারাপ হতে শুরু করেছে, মানসিক বিপর্যয়ের এই স্টেজে মানুষ তার প্রিয় বস্তুগুলো দেখতে পায়। একজন লোক প্রতিদিন রাতে দেখতে পেতেন তিনি উড়ছেন আর চারপাশ থেকে পৃথিবীর সকল পজিটিভ এনার্জি নিয়ে শক্তিশালী হচ্ছেন। আমার সাথে এমন কিছু হোক চাই না, বৃষ্টিতে ভেজার জন্য মনোনিবেশ করলাম। তার বৃষ্টি খুব প্রিয় ছিল, কিন্তু কখনো একসাথে আমাদের ভেজা হয়নি।
দরজা খুলতেই গরম একটা বাতাস ধাক্কা দিল, পরিষ্কার আকাশে মায়াবী চাঁদের আলো খেলা করছে, বৃষ্টি নেই।
প্রকৃতির নিস্তব্ধতা ভেদ করে দূর থেকে শিয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। ঘরের দিকে পা বাড়াতেই কানে এল,
বৃষ্টিতে ভিজবে না তাশহান?
বৃষ্টি নেই, তুমিও নেই, সব মরীচিকা। আমাকে একা থাকতে দাও।

ঘরে এসে গান প্লে করল। একটা গান শেষ হতেই বেজে উঠল সেই প্রিয় মানুষটির রেকর্ড, মনে হচ্ছে কানের কাছে সে কথা বলছে। তীব্র একটা মনচাপা কষ্ট ত্বরিতগতিতে আঘাত হানল তাশহানের বুকের বাঁ পাশে।
চোখের জল শেষ হয়ে গেলে মন–কান্নার জন্ম হয়, এই কান্নার যন্ত্রণা জগতের সকল কষ্টকে হার মানায়। যুগ যুগ ধরে হাজার হাজার মানুষ মন-কান্না নিয়ে হাসিমুখে জীবন পার করে দিচ্ছে। অভিমান আর অভিযোগের হিসাব করতে গিয়ে দিন শেষে ভারী হয় যুক্তির খাতা, আড়াল হয় ভালোবাসা। সম্পর্কের বেলায় হিসাবের খাতা খোলা মানে হলো নিজ হাতে ছুরি দিয়ে ভালোবাসার মানুষটার বুকে প্রতিমুহূর্তে আঘাত করা। সম্পর্ক টিকে থাকে মুঠোবন্দী করে দেওয়া প্রতিশ্রুতিতে।
আরও একটা রাত নির্ঘুম কেটে গেল তাশহানের। এই যন্ত্রণার শেষ কোথায়, জানা নেই।
বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা