অচল হৃদয়ের পোড়া চোখ

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

আব্বা যেন আমার চোখের পাতায় কাজলের মতো আছেন। গায়ের জামা, চুলের ফিতা, হাতের চুড়ি, পানির মগ, স্নানের জগ, সুবাসি ফুলের ঘ্রাণের মতোই সবখানে মিশে আছেন। আমি ভাসছি, ইছামতীর শাখা নদীতে। আমার আকৃতি একটা ব্যাঙের পোনার অতটুকু অথবা গাছের পাতার মতো ওজন। আমার পেটের নিচে আব্বার হাত। আব্বা ঠিক এভাবেই তার পোনা মাছটিকে ভরা নদীতে সাঁতার শিখিয়েছিলেন। ছোটবেলায় মায়ের বুকের দুধ ছাড়বার পর থেকেই বেড়ে ওঠা, ঘুমিয়ে থাকা প্রিয় মানুষ, বন্ধু আব্বা।

একবার এক মাহফিলে খালাদের বাড়ি গিয়েছিলাম। আব্বা ঘুমাতে গিয়ে আমাকে না পেয়ে, শীতের রাতে হেঁটে হেঁটে খালামনির বাড়ি গিয়ে আমাকে নিয়ে এসেছিলেন।
আরেক দিন রাতে, আব্বা ঘুমাতেই যাবেন—এমন সময় আমাকে খুব করে খুঁজেছিলেন। কোথাও না পেয়ে যখন ঘরে ঢুকে কাঁথা সরাচ্ছিলেন, আমি কাঁথার নিচ থেকে এমন করে হালুম বলে উঠেছিলাম যে আব্বা চমকে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। তিনি একটুও রাগ করেননি।

একসময় মনে হতো, আব্বার কোনো অবদানই নেই আমার জীবনে। কিশোরবেলায় শুনেছিলাম, আমি মেয়ে হওয়ার জন্য তিনি মন খারাপ করে তিন দিন আমার মুখ দেখেননি, ঘরে ঢোকেননি। পরে যখন কথা বলতে শুরু করি, আমার মুখ থেকে প্রথম উচ্চারিত শব্দ ছিল ‘আব্বা’। তারপর থেকে তিনি সেই যে আমাকে তাঁর বুকে আগলে নিলেন যক্ষের ধনের মতো, আর ছাড়লেন না।

এখন ইচ্ছে করে সেই দিনে ফিরে গিয়ে আব্বাকে যদি খাইয়ে দিতে পারতাম এক লোকমা!

মেয়েদের বয়স বাড়লে নাকি বাবার সঙ্গে বাহ্যিক দূরত্ব বৃদ্ধি পায়; কিন্তু আমি উপলব্ধি করেছি, আত্মিক সান্নিধ্য, কাছে থাকা, পাশে থাকার ইচ্ছে প্রবলভাবে বেড়ে যায়। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আব্বার অবদান ভেসে ওঠে।

আব্বার স্কুল থেকে সি অফিসে ট্রেনিং ছিল যেবার, তখন আমি অনেক ছোট। দুপুরের পর আব্বা বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। তাঁর হাতে ছিল খাবারের প্যাকেট; যার মধ্যে ছিল ডিম, পোলাও ও মুরগির মাংস। আমাকে দিয়েছিলেন, খেয়েছিলাম খুব! কিন্তু একবারও সেদিন আব্বাকে জিজ্ঞেস করিনি, ‘আপনি খেয়েছেন কিনা?’ ঐ বোধ বিবেচনা বা অনুধাবন তখনো আমার মধ্যে আসেনি। এখন ইচ্ছে করে সেই দিনে ফিরে গিয়ে আব্বাকে যদি খাইয়ে দিতে পারতাম এক লোকমা!

আব্বার সঙ্গে মাছ ধরতে যাওয়া, ঘুমানো, গল্প শোনা, বকুনি খাওয়া, পড়তে বসা; তাঁর কাছেই যোগ-বিয়োগ, ভাগ অঙ্ক শেখা। অঙ্ক শিখাতে শিখাতে কখন যে জীবনের হিসাব ভুলে বার্ধ্যক্যকে ছুঁয়ে ফেলেছেন আব্বা, বুঝতেও পারিনি। তাঁর জন্য কিছুই করতে না পারার একটা আক্ষেপ রয়ে গেছে। একটা অচল হৃদয় আর জ্যান্ত পোড়া চোখ নিয়ে নীরবে তাকিয়ে থাকতে হয়।

বন্ধু, সিরাজগঞ্জ বন্ধুসভা