ওরা দুজন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

লোকভর্তি বাস। তালগাছি মাজারের ওরস শরিফের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। ‘আল্লাহু, আল্লাহু’ জিকির আর ভান্ডারি গান বাজছে মাইকে। মাথা দুলিয়ে গা নাচিয়ে তাল দিচ্ছে বেশির ভাগ মানুষ। বাসের সিটে জায়গা না হওয়ায় মেঝেতে বসিয়ে দেওয়া হয় ছোট্ট কিরণ ও ঝিনুককে।

নিষ্পাপ মুখ, নির্লিপ্ত চাহনি, ভিতু হৃদয় আর কিছু খুঁজে ফেরা চোখ। গায়ে কম দামি ময়লা পোশাক। চুলগুলো এলোমেলো। পায়ে সামান্য স্যান্ডেলটাও নেই। ওরস, পীরের মাজারে ওদের কী কাজ!

বাসের সিটে বসা মা-বাবা, নানির সঙ্গে আসা অন্য শিশুরা দিব্যি হাসছে। একটার পর একটা খাবার খাচ্ছে। অথচ মেঝেতে বসা প্রাণ দুটো যেন কোনো গরু-ছাগলের হাটে বিক্রি হতে যাওয়া খোয়ারে বন্দী প্রাণী!
বিপদে-আপদে কাজে লাগবে ভেবে বাড়ি থেকে আসার সময় কিরণের মা ১০ টাকা দিয়েছিল। ঝিনুক কিরণের ছোট বোন। ওরা দুজনই মেঝেতে বসে আছে। ওরসে যাবে! পীরের দরবারে যাবে।

ঝিনুক বারবার ক্ষুধা পাওয়ায় কিরণের কাছে কান্না করে, কিরণ পায়জামার ডোর থেকে ১০ টাকার নোট বের করে দেখে, আবার রেখে দেয়। বড়দের দেখছে টাকা দিয়ে খাবার কিনে খেতে। টাকা দিলে খাবার পাওয়া যাবে—এটা কিরণ বুঝতে পারা সত্ত্বেও সে টাকাটা লুকিয়ে রাখছে।

বাস চলছে হেলেদুলে। বাইরের আকাশ, জানালার রোদ, হাওয়া—কিছুই চোখে পড়ে না তাদের দুজনের। তাদের চোখে পড়ে অনেক মানুষ, ব্যস্ততা, হাতের ওপর, গায়ের ওপর মাঝেমধ্যে পায়ের পাড়া! অসহায়ত্ব, অপমান, অবহেলা—এসবের কিছুই বোঝে না তারা। বুঝেছে কেবল তাদের তালগাছি মাজারে যেতেই হবে।

বাস স্টপেজে থামে। বাসে থাকা লোকজন বাইরে যায়, ভেতরে আসে। তারা দুজন একভাবে এক জায়গায় বসে থাকে। ভয় পায় খুব, বাস থেকে নামিয়ে দেওয়ার ভয়। গন্তব্যে এসে বাস থেকে যখন সবাই নেমে পড়ে, কিরণ ও ঝিনুক ছোট ছোট পায়ে নেমে যায়। মাজারে যেতে হলে নৌকায় নদী পার হতে হবে। বড়দের সঙ্গে তারাও নৌকায় উঠে বসে। চারপাশে খাবারের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। গান-বাজনা, শব্দ আর লাল-নীল আলো নদীর পানির তরঙ্গে নেচে বেড়ানো অবাক হয়ে দেখতে থাকে। পাড়ে নৌকা ভেড়ানোর পর মাটি মাড়িয়ে ভিড়যুক্ত জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায় তারা। এত মানুষ একসঙ্গে জীবনে দেখেনি। শানবাঁধানো ঢালাও মেঝেতে অসংখ্য মানুষ শুয়ে আছে, বসে আছে; কেউ মাথা ঝাঁকিয়ে জিকির করছে। কেউ আবার চুলার ধোঁয়ার মতো ধোঁয়া মুখ দিয়ে ছেড়ে চলছে। অদ্ভুত বিষয় হলো কিছু মানুষ গাজরের মতো লম্বা মাটির কী একটা মুখে নেওয়ার পরেই মুখ থেকে এসব ধোঁয়া বের হচ্ছে! বেশির ভাগ মানুষ এমনভাবে মুখ থেকে ধোঁয়া বের করছে। কিরণ কিছুই বুঝতে পারে না। বুঝতে পারে ওটা গাজর, আর গাজর থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে পীর বাবার কেরামতিতে।

কিরণের নানির অনুরোধে তাদের বাসে আনার অনুমতি দেয় বাবলু নামের মধ্যবয়স্ক লোক, যিনি বাস রিজার্ভ, মানুষদের জামায়াত এবং তালগাছি পর্যন্ত আনা-নেওয়ার দায়িত্বে আছে। কিরণের খালাতো খালা, আপন বড় খালা—সবাই এই মাজারে এক বাসে এলেও স্নেহ–সৌহার্দ্য কিছুই নেই তাদের প্রতি। প্রতিটি মানুষ শিক্ষার আলো ছাড়া, প্রতিবেশীর হক, আত্মীয়ের বন্ধন, ছোটদের স্নেহ করা—এসব সম্পর্কে ভেতরঘরে আলো ছাড়া মানুষ। তাই রক্তের সম্পর্কের মানুষ, দূরসম্পর্ক—এসব উপেক্ষা করে কিরণ, ঝিনুক।

তারা ফুলের প্রাণে পিপাসু চোখে মাজারে এসেছে কাউকে খুঁজতে। নানির কথামতো কিরণ বোনের হাত ধরে শানবাঁধানো জায়গায় সবার সঙ্গে গুটিসুটি মেরে এক জায়গায় একভাবে বসে থাকে। সময় গড়াতে থাকে। পেটের মধ্যে ক্ষুধারা হাঁ হাঁ করে ওঠে। ঝিনুক কেঁদে বুক ভাসাতে শুরু করে। কিরণ বারবার বলে, নানি এলে ভাত খেতে দেবে। নানির পথ চেয়ে থাকে…

ঝিনুকদের পাশেই গোলাপি রঙের সুন্দর সোয়েটার পরা একটা ছেলে আর মেয়ে ছিল। তারাও ভাই–বোন। তারা তাদের দাদির সঙ্গে ওরসে এসেছে। (হবালি) গোলাকার একটু গর্ত, এমন বাটির মতো মাটির পাত্রভর্তি মোটা চালের ধোঁয়া ওঠা ভাত, আর বড় গোশতের টুকরার পিটুলি দিয়ে তারা ভাত খাচ্ছে। মেয়েটির ভাইটার নাকে সর্দি গরাচ্ছে, মেয়েটি মুছে দিচ্ছে। ঝিনুক সেদিকে তাকিয়ে ‘ভাত খাব, ভাত খাব’ বলে কাঁদছে। তাদের খাওয়া শেষে মেয়েটির দাদি উচ্ছিষ্ট ভাত আর ঝোল এনে ঝিনুক ও কিরণকে দেয়। লজ্জা–ঘেন্না নেই বাচ্চাগুলোর। হাঁসের মতো গপগপ করে ভাত খেতে থাকে। একটু পর ঝিনুকের নানি এসে পীরের দরবারে নিয়ে যায়। তাদের বড় খালা পীরের পায়ের কাছে ১০ টাকা দিয়ে মাথা ঝুকতে নিলে পীরের শাগরেদ না করে; ১০ টাকায় পীর সিজদাহ নেয় না। ২০০২ সালের ১০ টাকা মূল্য অনেক ছিল। তবু ঝিনুকের বড় খালা ৩০ টাকা বের করে দেওয়ার পর পীরের পা ধুয়ে দেয়। তারপর পায়ের ওপর সিজদাহ দিয়ে চুমু খায়। পীর তার হাত বড় খালার মাথার ওপর রাখে।

কিরণের নানি সিজদাহ করে একইভাবে। কিরণের কাছে টাকা না থাকায় পীরের কাছে কিরণের নানি অনুমতি নেয় টাকা ছাড়া সিজদাহ দেওয়ার। কিন্তু কিরণ বোনের হাত ধরে সরে যায়। আলোকদিয়া মাদ্রাসায় ক্লাস ফোরে পড়ত কিরণ। সেখানে শিখেছিল, আল্লাহ ছাড়া কারও কাছে মাথা নোয়াতে নেই। নানি যেখানে বসিয়ে দিয়েছিল, সেখানে এসে আবার বোনকে নিয়ে বসে পড়ে। প্রচণ্ড শীত। মানুষের উত্তাপ আর বোধশূন্য হওয়ার জন্য তাদের শীত লাগে না। দলে দলে লোকজন পীরের দরবারে ছাগল, মুরগি, নতুন পাঞ্জাবি, লুঙ্গি, মিষ্টি, টাকা, চাল, ডিমএসব দিয়ে যাচ্ছে। এক থাল ভাত, এক টুকরা গোশত আর ঝোলে বিক্রি হয় টিকিটের মধ্যে, ১০ টাকা দামে। কিরণ আবার ১০ টাকার নোট বের করে, আবার রেখে দেয়। ঝিনুক মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়ে। যিনি সবাইকে নিয়ে এসেছেন, তার বউ-বাচ্চা কিরণদের পাশে এসে বসে। গরম ভাত আর গোশতের ঘ্রাণ আসতে থাকে তাদের হাতে থাকা মাটির থাল থেকে। কিরণ চোখ সরিয়ে নেয়।

মধ্যবয়স্ক মহিলা জিজ্ঞেস করে, তারা ভাত খেয়েছে কি না। যখন ‘না’ বলল কিরণ, তখন মহিলাটি ওঠে গেল। এক টিকেটে চালাকি করে দুবার ভাত নিল। ভাতের থাল নিয়ে এসে গোশতটা তুলে নিজের সন্তানের পাতে দিল। কিরণ ফ্যাল ফ্যাল করে সেদিকে চেয়ে থাকল। ভাত আর ঝোল কিরণের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘তোরা দুজন খা।’

কিরণের নানি তার থালের গোশত কামড় দিয়ে ছিড়ে কিরণের পাতে দিল। ঝিনুক ঘুম থেকে ওঠে চোখ মুছতে মুছতে হাঁ করে, ভাই তার মুখে ভাত তুলে দেয়। একে একে গ্রাম থেকে আসা সবাই আশপাশে বসে পড়ে। দোয়া পড়তে থাকে। কেউ নামাজ পড়ে, কালেমা পড়ে। কেউ আবার মাথা–গা ঝাঁকিয়ে জিকির করতে থাকে। শানবাঁধানো মেঝেতে আগে থেকেই খড় বিছানো ছিল শীতের তীব্রতা থেকে পীরের দরবারে আসা ভক্তদের রক্ষার জন্য। ঝিনুক আবার ঘুমিয়ে যায়। কিরণের নানি নামাজের সিজাদাহে গেলে একপলকে ওখান থেকে সরে পড়ে। পীরের বসার আসনের আশপাশে থেকে শুরু করে ওরসের এদিকে ভোঁ ভোঁ করে কিছু খুঁজতে থাকে। মাইকে অনেক মানুষ অনেক কিছু বলতে থাকে। কিরণ ভিড় ঠেলে সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়। তার ইচ্ছা করে মাইকে গিয়ে কিছু বলতে। কিন্তু ছোট কলিজায় সাহস জোটে না। ফিরে এসে বোনের সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ে। শেষ রাতে আবার সবাই পীরকে সিজদাহ করে। কিরণ তখনো তৃষ্ণার্ত চোখে কিছু খুঁজতে থাকে। সবার খাবার খায় টিকিট কেটে, কিরণ ও ঝিনুক এঁটোঝুটা খেয়ে চুপ বসে থাকে নৌকার এক কোণে। যে সবাইকে বয়ান শুনিয়ে নিয়ে এসেছে, নিয়ে যাচ্ছে; তাকে ভীষণ রাগান্বিত দেখা যায়। কারণ, তার শাশুড়ি-মা পীরকে ভণ্ড বলে গালি দিয়েছে বলে নৌকা থেকে বয়স্ক মহিলাকে ফেলে দিতে চেয়েছিল।

বিষণ্ন মুখ নিয়ে কিরণ নদীর দিকে চেয়ে থাকে। বুকের মধ্যে কান্না উতলিয়ে ওঠে। ফুঁপিয়ে ওঠে বাইরে। কিরণ একবার আকাশের দিকে তাকায়, আবার নৌকার পাটাতনের দিকে। মাঝির বইঠা পানি কেটে কেটে পাড়ের দিকে যায়। কিরণের পা ওঠে না বাসের দিকে। পেছনে ফিরে তাকায় একবার। এবার তার হাতের উল্টা পিঠ দিয়ে চোখের পানি আর ভেজা নাক মুছে নেয়। বাসের মেঝেতে বসে থাকে। বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়। বহুলী হাটখোলায় বাস এসে থামে। সবাই নেমে পড়ে। কিরণ ঝিনুকের হাত ধরে বাড়ির পথে হাঁটা দেয়। ফসলি জমির মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কিরণ মায়ের কাছে আসে। মা তাকে জিজ্ঞেস করে, বাবার দেখা পেয়েছে কি না। কিরণ মাথা নাড়িয়ে না করে।

সাত মাস হলো কিরণের বাবা নিখোঁজ। কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সন্তান নিয়ে কিরণের মা কীভাবে দিন পার করছে খেয়ে না–খেয়ে, তা আল্লাহ জানে। ধারণা ছিল, ওরসে খুঁজলে পেয়ে যাবে। কিন্তু কিরণ তার বাবাকে খুঁজে পায় না। মাইকে তখন তার বলতে ইচ্ছে করেছিল, বাবা যদি কোথাও থাকে, সে যেন ফিরে আসে, কিন্তু বলতে পারেনি। মাঝেমধ্যেই কিরণের বাবা এভাবে নিখোঁজ থাকে সংসার ত্যাগ করে। নেশা ভাং বা মেয়েলি কারণে নয়। সংসারের দায়দায়িত্ব ভালো না লাগায় অনেক দূরে থাকে একা নিজের মতো। ভেবেছিল, এবারও ফিরে আসবে। কিন্তু দীর্ঘ সাত মাস পার হওয়ার পরও তাদের চোখে খুঁজে ফেরা পিতার মুখ ফুটে ওঠে না।

বন্ধু, সিরাজগঞ্জ বন্ধুসভা