চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পৌষের সকাল

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বললে যে কারোরই শাটল ট্রেনের ছবি চোখে ভেসে উঠবে। পাহাড়ঘেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য রকম রূপ দিয়েছে এই শাটল ট্রেন। ১৯৮০ সালে শাটল ট্রেনের যাত্রা শুরু হয়। শাটলে প্রতিদিন কয়েক হাজার শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম শহর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করেনছবি: সূর্য দাস
পৌষের নিঃসঙ্গ সকাল আমাকে যে বোধ, যে উপলব্ধি দিয়েছে, তা খুব দামি। সুন্দর স্মৃতি। মাঝেমধ্যে এভাবেই একা হাঁটা দরকার। চারপাশ মন দিয়ে দেখা, নিজের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন।

ক্যালেন্ডারে ডিসেম্বরের শেষ দশ চলছে। আর বাংলায় পৌষ মাসের প্রথম দশ। প্রকৃতিতে শীত জেঁকে বসেছে। ঘড়ির কাঁটায় সকাল ৭.৩০ পেরিয়েছে। হাঁটতে বের হয়েছি। একা এবং নিঃসঙ্গ। দক্ষিণ ক্যাম্পাসের বউ বাজার হয়ে স্টেশন চত্বরে প্রবেশ। অযত্নে বেড়ে ওঠা তিনটি ছোট্ট কুকুরছানার সঙ্গে দেখা। ভীষণ মিষ্টি আর নরম চাহনি তাদের। ভালো লাগার প্রথম দৃশ্যটা আজ এখানেই শুরু।

স্টেশনে এলাম। ক্যাম্পাস ছুটি। ২০ তারিখের আগে থেকেই ক্যাম্পাস ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। এখন শুধু হাতে গোনা কিছু মানুষের উপস্থিতি। প্ল্যাটফর্মে মস্ত ব্যাগ নিয়ে উপস্থিত কয়েকজন। লক্ষ্য ৯.২০-এর শাটল ধরবে। তাঁদের নীড়ে ফেরা আর প্রিয় ক্যাম্পাস ছাড়ার আবেগটা আমাকেও নাড়া দিচ্ছিল।

দুই হাত পেছনে মুষ্টিবদ্ধ করে সাহেবদের মতো হাঁটছিলাম। পশ্চিমে এগিয়ে গিয়ে উঁচু সিঁড়ি বেয়ে সমতল প্ল্যাটফর্ম থেকে বরাবর ওপরের দিকে উঠব। অনেকগুলো সিঁড়ি। সচরাচর এ পাশটা দিয়ে কম মানুষই যাতায়াত করে। সিঁড়িগুলো কারা যেন সুন্দর আলপনা করে রেখে দিয়েছে। পাখি, ফুল আর লতাপাতা আরও কত কি এঁকেছে! ধীরপায়ে আস্তে আস্তে উঠছিলাম। আজ কোনো তাড়া নেই। হেঁটে বেড়াব, প্রকৃতির সঙ্গে কথা বলব।

জিরো পয়েন্ট যেতেই একদল তরুণ-তরুণী। নবীন সেশনের হবে। চোখেমুখে উচ্ছ্বাস। শীতের সকাল উপভোগ করতে দল বেঁধে বেরিয়েছে। তাঁদের হাসির প্রতিধ্বনি আমার কর্ণকুহরে পোঁছেছে। এই হাসি–আনন্দের ভাগ যেন আমিও পেলাম। মোড়ে সারি সারি অটোরিকশা অলস দাঁড়িয়ে। জিরো পয়েন্ট পেরিয়ে লম্বা কাটাপাহাড় সড়ক ধরে হাঁটছি।

যেতে যেতে পাখির ডাক আর ফুটে থাকা বুনো ফুলে দৃষ্টি নিবদ্ধ হচ্ছিল বারবার। ধীরপায়ে হাঁটতে হাঁটতে নিজের সঙ্গে কথা বলছিলাম। নিজের স্বপ্ন, ইচ্ছা আর পেরিয়ে যাওয়া একটি বছরের হিসাব কষছিলাম। অনেকটা পেছনে ফিরে গিয়ে নিজের অস্তিত্ব খুঁজছিলাম। এরই মধ্যে পাহাড়ের উঁচুতে থাকা গাছগুলো কিংবা পাহাড়ধসের পর উলঙ্গ অংশটুকু তাকিয়ে দেখছি। চোখ পড়ে পাতাশূন্য মরা গাছগুলোতে। যেন ভাস্কর্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পৃথিবীতে কারও স্থান শূন্য থাকে না। তাই হয়তো লতাগুলো মরা গাছটাকে পেঁচিয়ে ধরেছে। তারপর পুরোটা ঢেকে দিয়ে একদিন মরা গাছটার কঙ্কাল মাটিতে পড়বে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মিশে গিয়ে জৈব সার হয়ে উর্বরতা জোগাবে।
এসব ভাবতেই একটা পাখি চোখে পড়ল। নাম জানি না। বৈদ্যুতিক তারে একা বসে আছে। ছোট্ট রঙিন। পাখিটির সঙ্গে নিজেকে কল্পনা করছিলাম। একা হাঁটছি। প্রকৃতি থেকে সব আনন্দ আস্বাদন করছি। ভাঙা ফোনের ক্যামরায় পাখিটিকে বন্দী করতে না পারলেও চোখ জোড়ায় তুলে এনেছে।

হাঁটতে হাঁটতে শহীদ মিনার পৌঁছে যাই। একটু দক্ষিণে লেডিস ঝুপড়ি। পাতাশূন্য লম্বা গাছগুলো দাঁড়িয়ে। কী সুন্দর গায়ের রং! পুরো দৃশ্যটা আমাকে দুই বছর পেছনে নিয়ে যায়। যেদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আসি। তখনো ছিল ডিসেম্বর মাস। ভর্তি শেষে এ পথে প্রথমবার হাঁটতে গিয়েছিলাম। এই গাছগুলো ছিল ঠিক নগ্ন অবস্থায়। প্রথম পা রাখা নবীন ছেলেটি আজ দুই বছর পার করে ফেলেছি দেখতে দেখতে।

ভাস্কর্যে হাত বাড়িয়ে থাকা মানুষগুলো যেন জীবন্ত। সত্য, সুন্দর, কল্যাণ আর ন্যায়ের পথে লড়ার জন্য হাত বাড়িয়েছে। আমিও তাদের একজন হতে চাই!

শহীদ মিনারের পাশেই জয় বাংলা ভাস্কর্য। এখান দিয়ে বারবার হেঁটে গেলেও কখনো দাঁড়িয়ে ভাস্কর্যগুলো মন দিয় দেখা হয় না। ভাস্কর্যের ওপরে রাইফেল উঁচিয়ে তিনজন। আর নিচে একদল তরুণ-তরুণী গোল হয়ে দাঁড়িয়ে। গোলচত্বরের পুরোটা একা ঘুরছিলাম। ভাস্কর্যে থাকা তরুণ-তরুণীর কাঁধে ব্যাগ। মন দিয়ে দেখার পর উপলব্ধি এল, তারা উত্তাল সময়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। স্বাধীন দেশের অভ্যুদয়ে তাদের ত্যাগ–রক্ত লেগে আছে। জহির রায়হানের আরেক ফাল্গুন কল্পনা করছিলাম। ভাস্কর্যে হাত বাড়িয়ে থাকা মানুষগুলো যেন জীবন্ত। সত্য, সুন্দর, কল্যাণ আর ন্যায়ের পথে লড়ার জন্য হাত বাড়িয়েছে। আমিও তাদের একজন হতে চাই! আছে কি সেই শিরদাঁড়া!
জয় বাংলা পেরিয়ে উন্মুক্ত মঞ্চে গিয়ে একা দাঁড়িয়ে। পাশে ঘন অরণ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়। গাছের ডালপালায় উন্মুক্ত মঞ্চ যেন ঢাকা মঞ্চ হয়ে গেছে। দুটি কুকুর পাশ দিয়েই ঘুরছিল। তারা ক্যাম্পাসের স্থায়ী বাসিন্দা। জন্ম থেকে মৃত্যু এ সবুজ চত্বরে ঘুরে কাটিয়ে দেয়। আমরা তো চার-পাঁচ বছরের অতিথি মাত্র!

আইটি ভবন পেরিয়ে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থামলাম। গ্রন্থাগার আমার আবেগ–ভালোবাসার জায়গা। যদিও নিয়মিত সঙ্গী হতে পারিনি। সম্পর্ক অনেকটা দূরত্বের! তবু এ ভবন আর লাখ লাখ বই, জ্ঞান–গরিমায় সবার চেয়ে সেরা।

এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক গ্রাফিতি আছে। তবে ছাত্র ইউনিয়নের কাজগুলো চোখে পড়ার মতো। তাদের কাজে বিশেষত্বও আছে। ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কার্যক্রম চোখে না পড়লেও তাদের প্রতিবাদী চিকা মারা প্রায়ই নজর কাড়ে। জাদুঘর প্রাঙ্গণে আসতেই ‘তবু বন্ধুগণ আমি আমার স্বপ্নের কথাই বলব’। আরও কিছু সুন্দর লেখা, যা আপাতত মনে করতে পারছি না। গ্রাফিতি দেখার পর সাম্পান নৌকার কাছে গেলাম। সাম্পান নৌকা চট্টগ্রামের বিখ্যাত। প্রথমবার স্বচক্ষে দেখেছিলাম পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে গিয়ে। জাদুঘর প্রাঙ্গণে আস্ত সাম্পান নৌকা রাখার বিশেষত্ব হলো সাম্পান নৌকার পেছনের অংশ থেকেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগোটা নেওয়া হয়েছে।
গ্রাফিতি সাম্পানের পর মন নিবদ্ধ বৃক্ষের কাছে। বৃক্ষের নাম নাগলিঙ্গম। গাজীপুরে ভাওয়াল রাজবাড়িতে প্রথম দেখেছিলাম। এরপর আবার এই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুনেছি এটি খুব দুষ্প্রাপ্য গাছ। এই গাছের ফুলগুলো খুব সুন্দর। দেখেছেন কখনো? নাগলিঙ্গমের সব কটি পাতা ঝরে নগ্ন দাঁড়িয়ে। এ দৃশ্য বার্তা দিয়েছে আশার। পুরোনো বছরে সব ভুলগুলো এভাবেই ঝেড়ে ফেলে নতুন বছরে নতুন পাতা নিয়ে নতুন উদ্যোমে শুরু করার স্বপ্ন।

জাদুঘর প্রাঙ্গণে পায়চারি করতে করতে অনেক গাছ দেখছিলাম। এ প্রাঙ্গণে অনেক বিখ্যাত গুণী মানুষের হাতের ছোঁয়া আছে। বেশির ভাগ গাছ তাঁদের হাতেই লাগানো। নজর পড়ে প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলামের লাগানো ‘গুট গুটিয়া’ গাছের দিকে। প্রথমবার এ নাম শুনেছি। গাছটা ৫ আগস্ট ২০০২-এ লাগানো। এখন বেশ বড় হয়ে গেছে। বয়সে তরুণ। ঠিক আমার সমবয়সী। জামাল নজরুল ইসলাম এই দেশের গর্ব করার মতো সন্তান। দেশপ্রেম যাঁকে নিয়ে এসেছিল বিলাসী জীবন ছেড়ে বিলেত থেকে এ প্রকৃতির পাঠশালায়। তাঁর সম্পর্কে আরও জানার ইচ্ছা! এ আঙিনায় সাবেক উপচার্যসহ গুণী শিক্ষকদের লাগানো চম্পা, পলাশ, সোনালুসহ আমার জানার বাইরে অসংখ্য গাছ! ক্যাম্পাসটি ছেড়ে যাওয়ার আগে আরও বৃক্ষের সঙ্গে পরিচয় হয়ে যাওয়ার ইচ্ছাটা ভীষণভাবে পেয়ে বসেছে।

কলার ঝুপড়ি। ক্যাম্পাসের প্রচণ্ড আবেগ আর স্মৃতির আঙিনা। কত গান–আড্ডায় মুখর থাকে। আজ সকালে সব যখন ঘুমন্ত, তখন আমার জোবরার চাষা ভাইয়েরা পাহাড়ি সবজি নিয়ে ঝুপড়িতে জড়ো করছিল। শীতকালীন সবজি দেখতেও ভালো লাগে। বেগুন, লাউ, ক্ষীরাই, সাদা মুলা, দেশি ধনেপাতা, কপি, শাকসহ আরও কত কী! ঝুপড়িতে কিছুক্ষণ পায়চারি করার পর এ পথ ধরেই আবার বাসায় যাওয়া শুরু করলাম। কিন্তু পৌষের নিঃসঙ্গ সকাল আমাকে যে বোধ, যে উপলব্ধি দিয়েছে, তা খুব দামি। সুন্দর স্মৃতি। মাঝেমধ্যে এভাবেই একা হাঁটা দরকার। চারপাশ মন দিয়ে দেখা, নিজের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন।

কার্যনির্বাহী সদস্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা