প্রযুক্তি এবং প্রজন্মের ক্ষত আদনান আল রাজীবের ‘ইউটিউমার’

আদনান আল রাজীবের ‘ইউটিউমার’।

জীবনে গতি এনে দিয়েছে প্রযুক্তি। তবে স্মার্টফোনের এই যুগে এসেও আমরা অধিক স্মার্ট হয়ে, গতির দৌড়ে বারবার পিছিয়ে পড়ি। ফেসবুক, ফলোয়ার, ইউটিউব, সাবস্ক্রাইবার—রাতারাতি জনপ্রিয় হওয়ার সব কৌশল আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকে। ইচ্ছা হয় জীবনে লটারি পাওয়ার মতো হঠাৎ কিছু করে, সবাইকে দেখিয়ে দেওয়ার। কিন্তু বাস্তবের দুনিয়ায় পা রেখে দেখা যায়, হঠাৎ করে কিছু পাওয়া বা সাপ লুডো খেলার মতো সিঁড়ি ধরে তরতর করে উঠে যাওয়ার পরেও সাপের মুখে পড়লে জীবন একেবারে লেজেগোবরে হয়ে যায়। সোজা নিচে নেমে আসতে হয়। প্রযুক্তি আর প্রজন্ম একে অন্যের পরিপূরক। প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজের মূল্যবোধ, সংযম, সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে না পারলে, সভ্যতার অন্ধকারে তলিয়ে যেতে হয়। আদনান আল রাজীবের ‘ইউটিউমার’ নামটির মধ্যেও রঙ্গব্যঙ্গের আড়ালে তীব্র শ্লেষ, সময়ের সেই ক্ষত লুকিয়ে আছে।

সমসাময়িক রংচঙে দুনিয়ার হতাশা, বিষাদ, ব্যর্থতা, উল্লাস, জীবন-মৃত্যুর সূক্ষ্ম সুতায় ঝুলে থেকে আবেগ আর বাস্তবের সংঘাতে লড়ে যাওয়া এই চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলোর কারও নাম ডন, কারও নাম মন্টি, কেউ জ্যাকসন, কেউ পাপ্পু ভাই। ডন আর মন্টি মিলে মুখোশ পরে হোটেল, শপিং মল, হলে দাঁড়িয়ে থেকে ছোট–বড় সবাইকে আনন্দ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। এটাও একধরনের জনসম্মক্ষে নিজেকে বিক্রি করা। দুজনে মিলে একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলে নাম দেয় ‘ডনটি’। প্রতিযোগিতার বাজারে ইউটিউবার নিজেকে দাঁড় করাতে গিয়ে গল্প ফেঁদে বসে মাথায় টিউমার হয়েছে। বোঝা যায়, যা আসলে বর্তমান সময়ের টিউমার।

নিজেদের ইউটিউব চ্যানেলে কেঁদেকেটে নিজেদের তীব্র যন্ত্রণা প্রকাশ করে মানুষের সহানুভূতি, সহমর্মিতা কুড়িয়ে বিপুল সমর্থন পেয়ে যায় দুজন। রাতারাতি অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। টিভি মিডিয়া, বিজ্ঞাপন সংস্থা, বেসরকারি উন্নয়নমূলক সংস্থা, এমনকি চিত্রপরিচালক পর্যন্ত—নানা জায়গা থেকে ডাক আসতে থাকে। জনপ্রিয়তা বাড়ে, নাম–যশ ও আর্থিক প্রতিপত্তি বাড়ে। মাঝেমধ্যে তাদের মধ্যে এসে হাজির হয় কালের মাতাল, স্বপ্নখোর, দার্শনিকের মতো একটা চরিত্র জ্যাকসন ভাই। তার বাণী বাতাসের মতো। একদিকে ভালোবাসার কাঙাল, অন্যদিকে তীব্র সাবধানী। সে বলে, ‘জীবনে ভালোবাসা আসবে, জীবনে ভালোবাসা যাবে, এইটাই খেলা। সেই খেলায় তুই কতক্ষণ টিকতে পারছিস, সেইটাই আসলে খেলা।’

মন্টির জীবনে ভালোবাসা হারিয়ে যায়। দিদির ননদকে সে ভালোবাসত। সচ্ছল সুপাত্র দেখে তার বিয়ে হয়েছে। যেভাবে প্রেমের ধাক্কা প্রতিটি বেকারের জীবনে অন্ধকার নামিয়ে আনে, তেমনি ডনের ভাইরাল হওয়া জীবন হঠাৎ হাওয়ার মতো উড়ে যায়। একজন নকল ডনকে সামনে এনে তাকে দিয়ে অশ্লীল কাজ করিয়ে আসল ডনের নামে প্রচার করে দেয়। এই হঠাৎ বিখ্যাত হওয়া প্রচারের দুনিয়ায় পড়ে যেতেও খুব বেশি সময় লাগে না। ডন কাকুতিমিনতি করেও বোঝাতে পারে না, এই কাজ তার নয়। নিজেকে প্রমাণ করতে শেষমেশ এই উলঙ্গ সমাজের সামনে লাইভে এসে নিজের পশ্চাৎদেশ দেখিয়ে বসে।

আদনান আল রাজীব, সাদিয়া ইসলাম রোজা ও নুহাশ মিলে সাংঘাতিক একটা চিত্রনাট্য সাজিয়েছেন। অনবরত পরিবর্তনশীল সময়ের, চলমান ভঙ্গুর সমাজের ক্ষতচিহ্নগুলো প্রজন্মের সৃষ্টিশীল মানুষেরাই যে পদে পদে অনুভব করতে পেরেছেন বেশি। চলচ্চিত্রের অন্য এক চরিত্র পরিচালকের শিষ্য কলকাতার ভাষায় কথা বলে, মন্টি তাকে ব্যঙ্গ করে। বিষয়টা বেশ মজার। কিন্তু এই সময়ের যন্ত্রণাগুলো এপার-ওপার সব জায়গারই ক্ষতচিহ্নকে তুলে ধরে। চলচ্চিত্রের কুশীলবরা হলেন প্রীতম হাসান, জিয়াউল হক পলাশ, শরীফ সিরাজ, শারাফ আহমেদ জীবন, গাউসুল আলম শাওন, তাপস মৃধাসহ অনেকে। প্রত্যেকের অভিনয় অনবদ্য। চরিত্র নির্বাচনে রাজীব প্রকৃতই মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। চিত্রগ্রাহক জোয়াহের মুসাভভিরের কাজ খুব উঁচু মানের। সম্পাদনায় প্রদীপ বেপারীও অনন্য। আরাফাত মহসীন নিধির আবহসংগীত চমৎকার। প্রযোজনা করেছেন রেদওয়ান রনি। ছবির সুন্দর গানগুলোও আজকের সময়ের প্রজন্মের ভাষ্য হয়ে উপস্থাপিত হয়েছে।

বর্তমান এই স্মার্টফোনের জগৎ কত দূরকে কাছে এনে দেয়। অচেনাকে আপন করতে শেখায়। অজানাকে জানতে শেখায়। প্রতিটি মুহূর্তে নিজেকে উন্মোচনের, ব্যক্তিগত জগৎকেও চারপাশের বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে শেখায়। আমাদের প্রত্যেকেরই একটা ব্যক্তিগত মিডিয়া প্রচারমাধ্যম তৈরি করে দিয়েছে আজকের প্রযুক্তি। আজ থেকে ২০ বছর আগে যা আমরা ভাবতেই পারতাম না। কিন্তু হাতের সামনেই বোতাম টেপা মিডিয়া রয়েছে বলেই হঠাৎ জনপ্রিয় হওয়ার নেশায় যদি যা ইচ্ছা খুশি করতে চাওয়া হয়, প্রতিযোগিতায় তাল সামলাতে না পারলেই বিপদ ঘনিয়ে আসে। আকাশে উড়তে চাওয়ার ইচ্ছা থাকা ভালো। তা থাকে বলেই যুগে যুগে মানুষ অসাধ্য, অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। কিন্তু আমাদের পা যেন বাস্তবের মাটিতে থাকে। আদনান আল রাজীব ও তাঁর সহকর্মীরা সেই বার্তা দিয়ে যান।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত