বৃক্ষবন্ধু শাকিরের নীরব বিপ্লব

প্রায় ১০ বছর ধরে নিজ অর্থায়নে ও নিজ উদ্যোগে ৩৩ হাজারের বেশি গাছ লাগিয়েছেন শাহ সিকান্দার আহমদ শাকিরছবি: লেখকের সৌজন্যে

হুমায়ুন আহমেদের ‘বৃক্ষমানব’ নাটকটি হয়তো অনেকেই দেখেছেন। অভিনেতা আহমদ রুবেল ছিলেন ‘বৃক্ষমানব’ চরিত্রে। যে কিনা গাছের সঙ্গে কথা বলত। এ কারণে বাড়ির লোক থেকে পাড়াপড়শি সবাই তাকে পাগল বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করত।

বাস্তবে সিলেটেও এমন একজন বৃক্ষপ্রেমী রয়েছেন। শাহ সিকান্দার আহমদ শাকির, তিনি বৃক্ষবন্ধু শাকির নামে সবার কাছে পরিচিত। বৃক্ষ সঙ্গে নিয়ে ছুটে চলা, আর সেই বৃক্ষের যত্ন ও ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে তিনি হয়ে উঠেছেন সবার প্রিয়।

প্রায় ১০ বছর ধরে নিজ অর্থায়নে ও নিজ উদ্যোগে ৩৩ হাজারের বেশি গাছ লাগিয়েছেন শাকির। সিলেট শহরের সড়কের বিভাজক ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান—যেখানেই জায়গা পেয়েছেন গাছ রোপণ করেছেন, করছেন। এ ছাড়া শহরের বাইরে যেখানেই তাঁর পদচারণ হয়েছে, সেখানেই চেষ্টা করেছেন একটি হলেও গাছ রোপণের। তবে তাঁর এই পথচলার শুরুটা সহজ ছিল না। পেরিয়ে আসতে হয়েছে, হচ্ছে নানা বাধাবিপত্তি, শুনতে হয়েছে মানুষের টিটকারি-মশকরা।

ছোটবেলা থেকেই গাছের প্রতি শাকিরের আলাদা একটা মায়া ছিল। তবে গাছ রোপণের সংখ্যা গণনার হিসাবে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২০১৩ সালের ১৩ নভেম্বর প্রিয় মানুষের জন্মদিন উপলক্ষে। এর পর থেকে বছরের বিভিন্ন দিনে প্রিয় মানুষ, প্রিয় লেখক, প্রিয় অভিনেতাদের জন্ম ও মৃত্যুদিবস স্মরণে এবং নিজের জন্মদিনকে কেন্দ্র করে গাছ রোপণের অভিযান চলতে থাকে।

শুরুর দিকে একাই গাছ রোপণ করতেন। সাহায্যের জন্য তেমন কেউ ছিল না। বরং লোকে তাঁকে পাগল বলে খ্যাপাত। বন্ধুদের কাছেও হয়েছেন তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার। রোপণ করতে গিয়ে অনেকের বাধার মুখেও পড়েছেন। যেখানে বাধা পেয়েছেন, সেখানেই চেষ্টা করেছেন লুকিয়ে হলেও গাছ রোপণের। এভাবেই নীরবে বৃক্ষবিপ্লব করে যাচ্ছেন এই তরুণ।

সড়কের বিভাজক ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান—যেখানেই জায়গা পেয়েছেন গাছ রোপণ করেছেন, করছেন শাকির
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

এ কাজের সঙ্গে থাকতে না পারলেও দূর থেকে অনুপ্রেরণা দিতেন কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী। তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রথম আলো বন্ধুসভার সদ্য প্রয়াত বন্ধু জুবায়ের কবির তুষার। তাঁর উৎসাহে ভালো কিছু ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াসে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বৃক্ষরোপণ নিয়ে প্রচারণা করতে শুরু করেন শাকির। এতে কিছু মানুষ তাঁকে বন্ধু তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেয়। বিষয়টি নিয়ে তুষার ভাই তাঁকে বলতেন, ‘তুমি ভালো কাজ করছ, এগিয়ে যাও। এসব কথা কানে নিও না।’
উৎসাহ দিয়ে যাওয়া আরও একজন মানুষ হলেন শিশুসাহিত্যিক দন্ত্যস রওশন। তিনি সব সময় গাছ রোপণের খবরাখবর নিতেন। দিতেন উৎসাহ, অনুপ্ররেণা।

শাকির গাছ রোপণ করেছেন, মানুষ উপড়ে ফেলে, নষ্ট করে দেয়। মন খারাপ হয়, তাও আবার রোপণ করেন। গাছ রোপণ করেই তাঁর কাজ শেষ হয়ে যায় না; পানি দেওয়া ও রক্ষণাবেক্ষণও করেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না একটা গাছ মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ায়। শাকির মনে করেন, রোপণ করা প্রতিটি গাছ তাঁর মনের খবর জানে। জানে তাঁর দুঃখ-বেদনার গল্প। তাই কোনো কারণে-অকারণে মন খারাপ হলেও তিনি গাছ রোপণ করেন। এতে মন হালকা হয়।

করোনা মহামারির সময় এসে শাকির চিন্তা করলেন, ‘শুধু দিবসকেন্দ্রিক থেকে বাহির হয়ে আমি কেন বছরে প্রতিদিন, অর্থাৎ ৩৬৫ দিন গাছ রোপণ করতে পারি না!’ যেমন চিন্তা তেমন কাজ। দিবসের পাশাপাশি যখনই সময় পান, তখনই গাছ রোপণ করা শুরু করলেন। সপ্তাহে প্রতিদিন না পারলেও কমপক্ষে তিন থেকে চার দিন চেষ্টা করেন। ধীরে ধীরে মানুষের কাছে ইতিবাচক সাড়া পেতে শুরু করেন। তাঁর গাছের সঙ্গে ছুটে চলার পাগলামি দেখে আগে যখন বেশির ভাগ নেতিবাচক মন্তব্য করত, ধীরে ধীরে ইতিবাচক মন্তব্য আসতে শুরু করে। তাঁকে অনুসরণ করে তখন অনেকেই গাছ রোপণের সঙ্গী হতে শুরু করেন। এর মধ্যে মেহরাব, বিভাষ তালুকদার, দেবাশীষ রনি, মিসবাহ জামিল, উত্তম দাশ, নাসিম, স্বর্ণা ও আবদুল ওহাব অন্যতম। এভাবে তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজনকে সঙ্গে নিয়ে বৃক্ষরোপণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ২০২৪ সালের একটা সময় এসে আমিও বৃক্ষরোপণের সঙ্গী হই তাঁর। সেই সুবাদে তাঁর এই নীরব বিপ্লবের সাক্ষী আমি।

এই বছরের ২০ অক্টোবর পর্যন্ত শাকিরের রোপণ করা গাছের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ১৭৯। কিছুদিন আগে প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের উদ্যোগে ব্র্যাক মাইক্রোফাইন্যান্সের সহযোগিতায় এক হাজার গাছ উপহার পান শাকির। আমাকে সঙ্গে নিয়ে সিলেট শহীদ মিনারসহ শহরের বিভিন্ন জায়গায় এগুলো রোপণ করেন তিনি। বন্ধু জুবায়ের কবির তুষার যেদিন মারা যান, সেদিন তাঁর স্মরণে একটি শিউলিগাছ রোপণ করা হয়। তবে এগুলো ব্যক্তিগত গাছ রোপণের সংখ্যায় যোগ করেননি। এর আগে আমাকে সঙ্গে নিয়ে ৪ অক্টোবর সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় ব্যক্তিগত একজনের উপহারের প্রায় ৭০টি গাছ রোপণ করে আসেন। উপহারের চারা তিনি ব্যক্তিগত রোপণের সংখ্যায় যোগ করেন না।

শিক্ষার্থী, আরটিএমআই নার্সিং কলেজ, সিলেট