কেন আমাদের একাকিত্ব ঘিরে রেখেছে!

বৃষ্টির মধ্যে ফুটবল খেলছে কয়েকজন কিশোর। এখন আর এমন দৃশ্য খুব একটা দেখা যায় না!ছবি: সৌরভ দাশ
নব্বইয়ের দশকে জন্ম নেওয়া কাউকে জিজ্ঞেস করলে সে চোখ বন্ধ করেই বলবে, পুরোনো সময়টা ফিরে পেতে চায়। হারিয়ে যেতে চায় সোনালি দিনগুলোতে। ফিরে যেতে চায় বন্ধুদের সঙ্গে খেলার মাঠে, আড্ডায়।

হাত বাড়ালেই বন্ধু। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সবচেয়ে সহজলভ্য উপায়। হাজার হাজার বন্ধু নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে একটা আলাদা জগৎ গড়ে উঠেছে। দিন শেষে ভুগছে বিষণ্ণতায়। কোথাও কোনো হেমন্ত নেই। বসন্তের আগমনী বাতাসের প্রশান্তির বদলে চৈত্রের দাবদাহে হৃদয় পুড়ছে। নামের পাশে সবুজ বাতি জ্বলছে; কিন্তু যোগাযোগ হচ্ছে না। সবাই সবার মতো নিজেকে নিয়ে একটা গণ্ডিতে আবদ্ধ করে রেখেছে। একটা কবিতার কথা মনে পড়ছে ‘এ শহরে আমার কোনো বন্ধু নেই’।

বন্ধুহীনতা যে শুধু পীড়া দিচ্ছে, তা না। প্রযুক্তির খপ্পরে পড়ে আমরা পারিবারিকভাবেও আলাদা আলাদা হয়ে পড়ছি দিনকে দিন। পরিবারের মানুষদের সঙ্গেও ঠিকঠাক কথা হচ্ছে না। যে সময়টা পাচ্ছি, সেটা ওই ডিভাইসের সঙ্গে ব্যয় করছি। অন্যদিকে সামাজিক মাধ্যম কিংবা অন্য যা–ই বলি না কেন, একটা অদৃশ্য প্রতিযোগিতায় ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা ভীষণ অভাব বোধ করছি। নিজেদের পুরোপুরি স্বাধীন করতে গিয়ে একা করে ফেলেছি।

এই তো কিছুদিন আগেও শুক্রবারে নতুন সিনেমার জন্য অপেক্ষা করতাম। বিকেলে খেলাধুলা, হইহুল্লোড়ে মেতে থাকতাম। সন্ধ্যার পর বই-খাতা নিয়ে বসতাম। এই যে ভাল্লাগে না ব্যাপারটা, এটার সঙ্গে একেবারেই পরিচিত ছিলাম না। কিন্তু এখন ব্যাপারগুলো তেমন না। রিমোট চাপলেই চ্যানেল বদলাচ্ছে, নেটফ্লিক্স, অ্যামাজনসহ আরও ওটিটি মাধ্যম আমাদের নাগালে। যখন যা ইচ্ছা তা দেখতে পারছি। পার্থক্য হলো, আগে পরিবারের সঙ্গে দেখা যেত, আর এখন একা একা! তা–ও আমরা ঠিক সুখী হতে পারছি না। একটা অজানা বিষণ্ণতা তাড়া করে বেড়াচ্ছে। কেউ সেটার ঠিক কোনো নাম খুঁজে পায় না।

এখনো নব্বইয়ের দশকে জন্ম নেওয়া কাউকে জিজ্ঞেস করলে সে চোখ বন্ধ করেই বলবে, পুরোনো সময়টা ফিরে পেতে চায়। হারিয়ে যেতে চায় সোনালি দিনগুলোতে। ফিরে যেতে চায় বন্ধুদের সঙ্গে খেলার মাঠে, আড্ডায়। ঈদ–পার্বণে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগিতে। যেখানে এই ভাল্লাগে না অধ্যায়টা নেই। তাকে ছুঁতে পারবে না কোনো মনখারাপি এসে। রাত নামলে ঘুমের জন্য এত অপেক্ষা নেই। কথার তৃষ্ণায় ভুগতে চায় না কেউ।

আমরা ভাল্লাগে না শিখেছি; কিন্তু এর থেকে প্রতিকার এখনো আবিষ্কার করতে পারিনি। এই এক জিনিসে একটা গোটা প্রজন্ম ঘুরপাক খাচ্ছে। সবকিছুতেই নুনের মতো একটা শব্দ দরকারি হয়ে উঠেছে, ‘ভাল্লাগে না’। আপনি একা একা সিনেমা দেখছেন, একটা সময় মনে হবে আপনার সিনেমা দেখতে ভালো লাগছে না, ধুম করে সেখান থেকে বেরিয়ে গেলেন। তারপর চুপচাপ শুয়ে কিংবা বসে থাকলেন। এই ভাল্লাগে না ব্যাপারটা রয়েই গেল। ঠিক তেমনি যখন দেখছেন আপনার সমবয়সীরা প্রেম-ভালোবাসায় মেতেছে; কিন্তু আপনি সেটা করছেন না, আপনার না চাওয়া সত্ত্বেও একটা প্রতিযোগিতা মনের মধ্যে চলে আসে, কেন আমার কিছু হচ্ছে না। প্রকাশ না করলেও সেখান থেকে ঠিক একটা ‘ভাল্লাগে না’ কিংবা মনখারাপি চলে আসে। যেখানে পরিবারের সদস্যদের একটা বড় সাপোর্ট দরকার, সেই সময়টাতে কিন্তু ব্যস্ততা কিংবা অন্য কোনো কারণে পাচ্ছি না। আমরা দিন দিন একা হচ্ছি।

নিজের প্রতি নিজের দায়ও এড়ানো যাবে না সহজে। আমার যা ভালো লাগছে, তা কেন করছি না। সবাই সবকিছু মেনে নেবে, বিষয়টা এমন কখনো হয় না। তোমার পড়তে ইচ্ছা করে তুমি পড়ো, খেলতে ইচ্ছা করে খেলো, অভিনয়ের ইচ্ছা থাকলে সেটায় মনোযোগী হও, লিখতে ইচ্ছা করলে লেখো, ঘুরতে ইচ্ছা করলে চুপচাপ একদিন বেরিয়ে যাও, আড্ডা দিতে ইচ্ছা করলে আড্ডা মেরে এসো, মন যা চায় করো, তবে অবশ্যই নৈতিকতার মধ্যে। প্রতিবন্ধকতা থাকবেই, এসব দিয়ে নিজেকে গুটিয়ে রেখে লাভ নেই। নিজের লক্ষ্যে পুরোপুরি এগিয়ে যেতে থাকলে বাকি সব শূন্যতা এমনিতেই কমতে থাকবে। নিজেকে নিজেরই ভালো রাখতে হবে। মনের যত্ন নিতে হবে।

নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ