তৃতীয় বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষার ফল ঘোষণা করা হয় এক সপ্তাহ আগে। মাথার ওপর আবার দুটি বিষয়ের বোঝা। বাড়িতে টাকা চাইব, সেই মুখ ছিল না। মনকে শক্ত করে খালি পকেটে গ্রামের বাড়িতে চলে আসি। ভেবেছিলাম, কিছু টাকা নিয়ে ঢাকায় ফিরে যাব। সেটা আর সম্ভব হয়নি। মাঝসমুদ্রে হঠাৎ আসা তুফানের মতো জীবন হুট করেই এলোমেলো হয়ে যায়।
২৬ মার্চ সকালে ঘুম ভাঙে বেতারযোগে স্বাধীনতার ঘোষণা শোনার মধ্য দিয়ে। আগের রাতেই নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকা শহরের মানুষের ওপর নির্বিচার গণহত্যা চালিয়েছে পাকিস্তানি সেনারা। বাড়িতে চলে আসায় নিজের ভাগ্যকে বারবার ধন্যবাদ জানাচ্ছি। যদি না আসতাম, তাহলে এতক্ষণে বাবা আমার লাশের শেষ চিহ্ন খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠতেন।
এর কয়েক দিন পরের ঘটনা। ৩০ মার্চের ভোরের দিকে একটা বেনামি চিঠি আসে। সেই পরিচিত হাতের লেখা। শতভাগ নিশ্চিত, এই চিঠির মালিক সুবর্ণা। সে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজ। কাজে–অকাজে নানা বাহানায় সুবর্ণা আমার সঙ্গে কথা বলত। ব্যাপারটা আমি বুঝলেও তেমন পাত্তা দিতাম না। আমার বইয়ের ভাঁজে ছোট্ট একটা চিরকুট পাওয়ার পর থেকেই তাকে আমি এড়িয়ে চলতে শুরু করি। এটা মাসখানেক আগের কথা।
সুবর্ণার কথা আমার মাথায় আর জায়গা পায় না। এখন মনে হয়, হয়তো অনেক চাপা আক্ষেপ নিয়েই সে লিখেছিল, ‘আমার এই হৃদয় আর আমার নিয়ন্ত্রণে রইল না, আমি আমার হৃদয়কে তার মতো বয়ে চলার অনুমতি দিলাম।’
মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়। গ্রামে তখনো যুদ্ধের প্রভাব তেমন পড়েনি। হঠাৎ বন্ধু কামালের চিঠি পেয়ে টনক নড়ে ওঠে। তারা ১০-১২ জন মিলে একটা গেরিলা বাহিনী গঠন করেছে। সেই চিঠি পাওয়ার পর বাড়িতে থাকতে আর ইচ্ছে হলো না। পরদিনই কাউকে না জানিয়ে বাবার পকেট থেকে কিছু টাকা চুরি করে ঢাকায় ফিরে আসি। কামালের সঙ্গে দেখা করে তার দলে যোগ দিই।
একদিন দুপুরে মেঘহীন বৃষ্টির মতো সুবর্ণার সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। চেহারায় অনেক পরিবর্তন। নির্জীব দেহটাকে যেন নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জীবিত রেখেছে সে। পরে জানতে পারি, তার বাবা ও দুই ভাই যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। সেই সূত্র ধরে কামালদের সঙ্গে সুবর্ণার মায়ের যোগাযোগ। তিনি এখন নিজের পরিবারের মতো এই গেরিলা দলকে আগলে রাখেন। আরও অনেক মা রোজ কামালদের জন্য খাবার ও কাপড় পাঠান।
মনস্থির করলাম, সুবর্ণার সঙ্গে কথা বলব। আষাঢ় মাস তখনো আসেনি। তবে সেদিন আষাঢ়ের সবটুকু বৃষ্টি যেন সুবর্ণার দুই চোখ দিয়ে ঝরে পড়ছিল। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি জানতেন, বইয়ের ভাঁজে চিরকুট আমি দিতাম, তা–ই না?’ সেদিন আমি এর উত্তর দিতে পারিনি। সম্ভবত দিতে চাইনি। আর কোনো দিনই সে আমার চোখের সামনে আসেনি। এর পর থেকে মনে হতে থাকে, আমার অবহেলা সে আমাকে দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দিচ্ছে। আমি চাইলেই সুবর্ণার বাড়ির সামনে গিয়ে তার মায়ের সহায় হতে পারতাম। সুবর্ণার কাঁধে হাত রেখে বলতে পারতাম, ‘ভয় নেই, আমি তোমার পাশে আছি। ভরসা রাখো।’ আমি তার সেই ভরসার জায়গা হয়ে উঠতে পারিনি।
তারও কিছুদিন পর সুবর্ণাদের বাড়ির পশ্চিম পাশের খালি জমিটায় তার সঙ্গে আমার শেষবার দেখা হয়। কিন্তু তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। সুবর্ণার দেহটা নিথর হয়ে পড়ে আছে। আমি নির্বাক দাঁড়িয়ে। পাকিস্তানি নরপিশাচেরা তার হাতের আঙুলগুলোর সব কটা নখ উপড়ে ফেলেছিল, কামড়ের দাগ ছিল সারা শরীরে।
শুনেছিলাম, সুবর্ণাকে পাকিস্তানি দোসররা জিজ্ঞাসা করেছিল, আমাদের ঘাঁটি কোথায়। সে বলেনি। কে জানে! হয়তো দেশ আর নিজের ভালোবাসার মানুষকে বাঁচাতে নিজের কথা আর চিন্তা করেনি। ক্যালেন্ডার আর আমার দুচোখ তখন আষাঢ়ে বৃষ্টিতে টইটম্বুর। নীল খামে মোড়া চিঠি ছাড়াও সুবর্ণাকে আমার আরও অনেক কিছুই দেওয়ার ছিল।
শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়