নবনী

অলংকরণ: তুলি
হঠাৎ একদিন খেয়াল করলাম, আমার শক্ত বান্ধবীটা কেমন যেন নরম হয়ে গেল। খুব শান্ত হয়ে গেল। নিজের মতো থাকত। একটা বই নিয়ে বারান্দায় বসে থাকত চুপচাপ আনমনে। আমাদের তখনো নিয়মিত কথা হতো। তাই ওর পরিবর্তনগুলো সহজেই ধরতে পারছিলাম। খুব চিন্তা হতো ওকে নিয়ে। জিজ্ঞাসা করলে কিছুই বলত না।

আমার বান্ধবী নবনীতা। আদর করে ডাকি নবনী। খুব ভালো বান্ধবী, সবচেয়ে কাছের মানুষদের একজন। নিজেকে ভেঙেচুরে খুচরা পয়সার মতো জমা করে রাখার একটা ব্যাংক হচ্ছে সে। কী ভীষণ শক্ত একটা মেয়ে। সহজে কেউ ওকে ভাঙতে পারে না। সবাইকে সামলে রাখে খুব যত্ন করে। নিজের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে ভাবার সময় থাকে না ওর কাছে। অন্যদেরটা নিয়ে ভাবতেই ব্যস্ত!

অনেকবার জিজ্ঞাসা করেও তার কাছ থেকে কখনো সহজে জানতে পারিনি মন খারাপ কেন? খুব কাছের মানুষ হওয়ায় মন খারাপের ব্যাপারটা চট করে ধরে ফেলতে পারলেও কারণ জানতে প্রচুর বেগ পেতে হতো। তবে আমার মন খারাপের গল্পগুলো তার কাছে বলতেই সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম। এত মনোযোগ দিয়ে মেয়েটা কথা শুনত, আমাকে এত চমৎকারভাবে সবকিছু বোঝাত; এক জীবনে এমন একজন বন্ধু পেলে মনে হয় না এর চেয়ে খুব বেশি কিছু চায় মানুষ!

আমি তাকে ভীষণ ভালোবাসি। সম্পর্কটা বন্ধুত্বের হলেও তার জন্য বরাবরই রক্তের সম্পর্কের মতো টান অনুভব করি। প্রতিদিন আমাদের নিয়ম করে কথা হতো, কত সুখ-দুঃখের আলাপ হতো, দুজনে মিলে কতশত পরিকল্পনা করতাম। কোনো দিন কোনো কারণে কথা না হলে প্রচণ্ড অস্থিরতা অনুভব করতাম। কী জানি সেও হয়তো করত। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল আমাদের দিন।

হঠাৎ একদিন খেয়াল করলাম, আমার শক্ত বান্ধবীটা কেমন যেন নরম হয়ে গেল। খুব শান্ত হয়ে গেল। নিজের মতো থাকত। একটা বই নিয়ে বারান্দায় বসে থাকত চুপচাপ আনমনে। আমাদের তখনো নিয়মিত কথা হতো। তাই ওর পরিবর্তনগুলো সহজেই ধরতে পারছিলাম। খুব চিন্তা হতো ওকে নিয়ে। জিজ্ঞাসা করলে কিছুই বলত না। সৃষ্টিকর্তার কাছে চাইতাম ওর ভেতরের কষ্টগুলো যেন দূর করে দেয়। চাইতাম আমার কাছে যা কিছু আছে, সবকিছুর বিনিময়ে হলেও তার হাসিটুকু ফিরে আসুক।

আমরা দুই বান্ধবীই বইপড়ুয়া হওয়ায় অনেক বই বিনিময় হতো। একবার নবনীর কাছ থেকে কিছু বই নিয়েছিলাম। পড়তে গিয়ে হঠাৎ একটির ভেতর থেকে একটা চিঠি পেলাম। সেই চিঠিটা পড়ে বুঝলাম নবনী অতি সন্তর্পণে কাউকে মন দিয়েছিল। নিজের সবটুকু উজাড় করে ভালোবেসেছিল। কিন্তু সেই নিষ্ঠুর মানুষটি তার সেই ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে চলে গেছে। ওর হঠাৎ মনমরা হয়ে যাওয়ার কারণটাও বুঝতে অসুবিধা হলো না। তবে এ ব্যাপারে নবনীকে কিছুই বুঝতে দিইনি। ওকে এসব মনে করিয়ে আবারও কষ্ট দিতে চাইনি।

কয়েক বছর পর হঠাৎ নবনীর বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। ওর একটাই অনুরোধ, যেভাবেই হোক ওর বিয়েতে যাতে আসি। আমাকে ছাড়া ওর এত বড় দিনটা নাকি ভালো যাবে না। প্রায় এক হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে চলে গেলাম বান্ধবীর বিশেষ দিনে পাশে থাকতে। ওর বরের সঙ্গে পরিচিত হলাম। বেশ অমায়িক মানুষ। সম্পূর্ণ ওর বিপরীত চরিত্রের মনে হলো। তবু এত ভালো লাগছিল একসঙ্গে দেখতে। ভাইয়া বেশ মজার মানুষও বটে। উনি বিয়ের শেরওয়ানি পরেননি, গরম লাগছে বলে। বিয়ে নাকি আরাম করে করতে হয়। আমাদের বলছিলেন, ‘তোমরা আমার বউকেও এত বস্তা–টস্তা পরিয়ে রেখো না তো। ও গরমে সেদ্ধ হয়ে যাবে!’ নবনীর হয়তো ভালোই লাগছিল এসব দেখে। কিন্তু বরাবরের মতোই সে তার ভেতরের অনুভূতিকে ভেতরে রেখে মুখ বেঁকিয়ে বলছিল, ‘কি বেশরম লোক দেখ তো!’

ওর বিয়ের পরও আমাদের নিয়মিত কথা হতে থাকে। কোনো ঝামেলা হলেই ফোন করে দুই পক্ষ থেকেই আমার কাছে সালিস চাওয়া হয়। আমিও ভীষণ উপভোগ করি। কখনো নবনীর পক্ষ, তো কখনো ভাইয়ার। ভাইয়াকে আবার এটাও বলি সব সময়, ‘আমার বান্ধবীর মতো একটা মেয়ে পেয়ে আপনি তো জিতেছেন ভাইয়া!’ উনিও মৃদু হেসে আমার কথায় সায় দিয়ে বলে, ‘তা তো জিতেছি। তোমার বান্ধবীর মতো মেয়ে হয় নাকি?’ তৃপ্তির হাসি থাকে ভাইয়ার চোখেমুখে নবনীর কথা বলতে গিয়ে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। নবনীকে উনি চোখের আড়ালই হতে দেন না।

একদিন রাতে হঠাৎ নবনীর ফোন। কণ্ঠ শুনেই বুঝতে পারলাম ভাইয়ার সঙ্গে ঝগড়াঝাটি হয়েছে। ঘুম ঘুম কণ্ঠে বললাম, ‘কিরে আবার ঝগড়া করেছিস?’ বিরক্ত কণ্ঠে বলল, ‘অন্য রুমে এসে ঘুমাব আজকে বুঝছিস। ওই ফাজিলটার সঙ্গে ঘুমাব না।’ জবাবে বললাম, ‘পাগলামি করিস না তো নবনী। মানুষটা তোকে ছাড়া থাকতেই পারে না; আর তুই কিনা শুধু শুধুই তাকে কষ্ট দিচ্ছিস। যা তো নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমা।’ নবনী তারপরও কপট রাগ দেখিয়ে বলছে, ‘তুই যতই বলিস আমি আজকে যাব না।’ কিন্তু আমি খুব ভালো করেই জানি নবনী যাবে। ভাইয়ার গলা শোনা যাচ্ছে, উনি ডাকছেন। বললাম, ‘এক্ষুনি যা তুই।’ গলা নামিয়ে নবনী বলল, ‘আসলেই যাব রে?’ ফোনের ওপাশ থেকে হাসি লুকিয়ে রেখে বললাম, ‘অবশ্যই যাবি। মানুষটাকেও আর কষ্ট দিস না, আমাকেও দিস না!’ সে কিশোরীদের মতো তরল গলায় ‘আচ্ছা’ বলতেই আমি বলে উঠলাম, ‘নবনী, তুই কি এই মানুষটাকে ততটা ভালোবাসিস, যতটা সেই কিশোরী বয়সে অন্য কাউকে বাসতি?’ নবনী খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘ভালো না বেসে উপায় আছে বল? মানুষটা যে খুব বেশি ভালো।’ আমি হেসে ফোনটা রাখতেই সে বলে উঠল, ‘শোন ময়না! তুই না থাকলে আমি সে সময়কার হৃদয় ভাঙার ওই তীব্র কষ্টটা থেকে কখনো বের হয়ে আসতে পারতাম না। জানিস আমার দীর্ঘ সাত বছরের একটা সম্পর্ক চোখের পলকে শেষ হয়ে গেছিল। বেঁচে থাকাটাই অর্থহীন লাগত। তুই আমার সঙ্গে আঠার মতো লেগে ছিলি। তোর মনে আছে তুই সব সময় বলতি, আল্লাহ যা নিয়ে নেন তার চেয়ে ভালো কিছু দেন। কি অদ্ভুত দেখ! সেই কথাটাই আমার জীবনে সত্যি হলো। তুই এভাবেই আমার পাশে থাকবি তো?’

আস্তে করে ফোনটা নামিয়ে রাখলাম। চোখ ভর্তি হয়ে উঠেছে পানিতে। খুব কান্না পাচ্ছে। কিন্তু নবনীর সামনে এখন কেঁদে ওর চরম সুখের এই মুহূর্তটা নষ্ট করতে ইচ্ছা করছে না!

শিক্ষার্থী, দিল্লি ইউনিভার্সিটি ও বন্ধু, ভারত বন্ধুসভা