লাল জামা

অলংকরণ: এসএম রাকিবুর রহমান

হঠাৎ করেই বানের জলে তলিয়ে গেছে চারপাশ। ভাগ্যিস, কৃষকেরা এ বছর বোরো ধান আগেই ঘরে তুলে ফেলেছে। আমাদের পুকুরের ডান দিকটায় খানিকটা ঝোপঝাড়। প্রতিবছরই এখানটায় অনেক মাছ পাওয়া যায়।

আজ তিন দিন হলো বাড়িতে এসেছি। বিকেলে খুব একটা কাজ নেই। তাই পুকুরের ওই দিকটায় গেলাম। হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে আছি। বাঁশপাতা দিয়ে নৌকা বানিয়ে জলে ভাসাই আর স্মরণ করি সোনালি শৈশবকে। আচমকা কেউ আসার শব্দ শুনে পেছনে তাকালাম। বুড়ি আসছে! জিজ্ঞেস করি, কী রে এখানে আসছিস কেন? কাঁদো কাঁদো মুখে সে উত্তর দেয়, ‘ভাইয়া আমাগো হাঁসের বাচ্চাগুলাইন পাই না। আদর কইরা খেলতাছি আর ফুরুত কইরা দৌড় দিছে। মায় কইছে, সন্ধ্যার আগে না ধরতে পারলে মাইর দিব।’

কথা শেষ করেই হাউমাউ করে কেঁদে দেয় ছোট্ট যূথী। চঞ্চল মেয়ে। উৎফুল্লতা আর চনমনে আচরণের কারণে সবাই বুড়ি বলে ডাকে। ছোট ছোট পা দিয়ে হেঁটে পুরো গ্রাম মাতিয়ে রাখে মেয়েটি। ওর কান্না দেখে হাসি পেল খুব। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাচ্চাগুলাইন কোন দিকে গেছে রে? কান্নার রেশ কমিয়ে অভিযোগের স্বরে জানায়, খালের দিকে। কাছে গিয়ে চোখ মুছে দিয়ে পিঠে হাত রেখে বললাম, ‘শোন, তোর হাঁসের বাচ্চা আমি খুঁজে দিচ্ছি। কিন্তু শর্ত হচ্ছে, কাঁদতে পারবি না’। মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দেয় বুড়ি।

ওকে নিয়ে রাস্তায় চলে আসি। সূর্য হেলে পড়েছে। রাস্তায় এসে বললাম, ‘শোন, এভাবে ভেজা কাপড়ে থাকলে তোর জ্বর উঠতে পারে। বাড়িতে গিয়ে কাপড় বদলে আয়, খুঁজে দিচ্ছি’। কিন্তু সে কোনোভাবেই হাঁসের বাচ্চা ছাড়া বাড়িতে যেতে চাচ্ছে না। অনেক জোরাজুরির পর মনে হলো, মেয়েটি আবার কেঁদে দেবে। যূথী কান্না করলে মনে হয়, পুরো পৃথিবীটাই কান্না করে। অগ্যতা রাজি হতে হলো।

এদিক–ওদিক হাঁটছি। একটু পরপর যূথী চই চই বলে চিৎকার করছে। কিন্তু বাচ্চা হাঁসের নাম–নিশানাও কোথাও নেই। অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরির পর পাগলিটার মন হঠাৎ ভালো হয়ে যায়। একগাল হেসে বলে, ‘ভাইয়া ঈদ হইতে আর কয়দিন বাকি?’ প্রশ্ন শুনে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। বললাম, ‘তিন দিন’। সে আবার বলল, ‘জানো ভাইয়া, আব্বায় আমার লাইগা একখান লাল জামা কিনছে। এবার ঈদে আমি লাল জামা পরুম।’ ওকে হাত দিয়ে টেনে কাছে নিলাম। একটু সময়ের জন্য মনে পড়ে গেল ছোটবেলার কথা। বছর ঘুরে ঈদ এলে কত আনন্দ! এখন সেসব কই গেল? বছর ঘুরে ঈদ ঠিকই আসে, শুধু আসে না ছোটবেলার আনন্দ।

এদিকে আকাশে মেঘ জমেছে। অন্ধকারে ছেয়ে গেছে চারপাশ। বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। কিন্তু যূথী হাঁসের বাচ্চা ছাড়া যাবে না কিছুতেই! অনেক বুঝিয়ে রাজি করাই। তা ছাড়া এই সন্ধ্যায় হাঁসগুলো কোথায় খুঁজবে! বাড়িতে ঢুকতেই ওর মায়ের সঙ্গে দেখা। সালাম দিলাম। ততক্ষণে যূথী আমার পেছনে লুকিয়েছে। সালামের জবাব দিয়েই কাকি বললেন, ‘আসামি নিয়া আইছ, না? আমি তো অরে খুঁজতাছি। বাবুরে একলা রাইখা পানি আনতে যাইতে হইবে, তাই।’

শেফালি কাকি ভীষণ ভালো মানুষ। একবার কথা হলেই সবাই ওনার ভক্ত হয়ে যায়। যূথীকে বললেন, ‘তোর ভাইয়ারে ঘরে নিয়া বসতে দে।’ অমনি দৌড়ে বাড়ির ভেতর চলে যায় সে। ততক্ষণে আজান হয়ে গেছে। আমি বললাম, ‘এখন আর বসব না। সন্ধ্যা হয়ে গেছে।’ কাকিও আর জোরাজুরি করেননি। ফিরে এলাম।

রাত পেরোলেই ঈদ। কিন্তু গ্রামে এ নিয়ে কারও উচ্ছ্বাস নেই। দলে দলে সবাই যূথীদের বাড়ির দিকে যাচ্ছে। কারও মুখে কোনো কথা নেই। আকস্মিক দুর্ঘটনায় সবাই কেমন যেন চুপ হয়ে গেছে। গত রাতে বন্যার পানির স্রোতে একটি লঞ্চ ডুবে যায়। সেই লঞ্চে বাড়ি ফিরছিলেন যূথীর বাবা, সঙ্গে ছিল মেয়ের জন্য কেনা নতুন লাল জামা।