আমার মধুসূদন

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। বাঙালি পাঠকের কাছে তো বটেই, ভিনদেশি পাঠকের কাছেও এক বিস্ময়ের নাম। তাঁর আবির্ভাবে বাংলা সাহিত্যের কাব্যধারা পৌঁছেছে অনন্য উচ্চতায়। আমিও সৌভাগ্যবান। এই ছোট্ট জীবনে গর্ব করার মতো কিছু নেই। বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কবির জন্মস্থানধন্য কেশবপুর উপজেলায় জন্মেছি ভাবতেই প্রভূত আনন্দ লাগে। মাঝেমধ্যে আফসোসও হয়। কবির বাড়ি সাগরদাঁড়ি গ্রামে আর আমার আলতাপোলে। মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরত্বের ব্যবধান। অথচ কী দুর্ভাগ্য, সচেতনভাবে কবি সম্পর্কে জেনেছি অনেক পরে। তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। এর আগে জানাশোনা একেবারেই ছিল না, বিষয়টা মোটেও তেমন নয়। কবিকে চিনতাম মধুমেলার নিরিখে। প্রতিবছর সাগরদাঁড়িতে সাড়ম্বরে কবির জন্মজয়ন্তী উদ্‌যাপিত হয়। কয়েক দিনব্যাপী আয়োজনের মূল আকর্ষণ মধুমেলা। দেশে-বিদেশে মধুমেলার সুখ্যাতি সমাদৃত। পরিবারের সঙ্গে মেলার যাই, ঘুরিফিরি আনন্দ করি। এর বাইরে কিছুই জানতাম না। প্রগাঢ় অন্ধকারের মতো আমার এ অজ্ঞতায় আলো ফেলে মুক্তি দিয়েছিলেন সুবিমল মামা। ভদ্রলোক মায়ের মামাতো ভাই। পাশের উপজেলায় বাড়ি। শিক্ষকতা করেন। বাংলার শিক্ষক।

পরিষ্কার মনে আছে, সেদিন ঘুম থেকে উঠে ইংরেজি পড়ছিলাম। কী একটা দরকারে মামা গিয়েছিলেন। বাবা তখনো মর্নিং ওয়াক সেরে ফেরেননি। মামা আমার পাশে এসে বসলেন। হঠাৎ কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবাই, যে বইটা দিয়েছিলাম পড়েছ?’ মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ‘পড়িনি’ বললে মামা অসন্তুষ্ট হবেন। জন্মদিনে উপহার হিসেবে মধুসূদন জীবনী দিয়েছিলেন। বুদ্ধি করে বললাম, ‘মামা, আজ থেকে শুরু করব।’ তিনি কয়েক মুহূর্ত চোখের দিকে চেয়ে থেকে কিছু না বলে উঠে দাঁড়ালেন। আমি নির্নিমেশ চোখে চেয়ে আছি। তিনি হাতে থাকা ‘এক শ মনীষীর জীবনী’ দিয়ে বললেন, ‘বই না পড়লে বড় হওয়া যায় না। লেখাপড়ায় ভালো হলেই সব পাওয়া যায় না। জ্ঞান সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। অদর্শনীয় এ বস্তুটি বই না পড়ে রপ্ত করা যায় না। আসি রে বাবাই, বাবাকে বলিস এসেছিলাম।’ তিনি কষ্ট পেয়েছেন ভেবে মন খারাপ হলো। মামার চার কুলে কেউ নেই। বিয়ে করেছিলেন, বাচ্চা হওয়ার সময় মামি মারা যান। শিশুটিও পৃথিবীর আলোর মুখ দেখেনি। আমাকে নিজের সন্তানের মতো স্নেহ করেন। ইত্যাদি চিন্তা করে এক বসাতেই মধুসূদন জীবনীর অর্ধেকটা পড়ে ফেললাম। বাকি অংশ পরের দুই দিনে পড়লাম। বইটা শেষ করেছি জানলে মামা খুশি হবেন। বাবার মুঠোফোন থেকে কল করে জানালাম। তিনি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে আকুণ্ঠ আশীর্বাদ করলেন। কিন্তু মন ভরল না। কবির বাড়ি ঘুরে দেখার জিদ চেপে বসল। মধুমেলায় প্রচুর মানুষের ভিড় হয়। সেভাবে কখনো ঘুরে দেখিনি। আবদার করলে মামা অবশ্যই নিয়ে যাবেন। কিন্তু একা একা ঘুরে দেখব ভেবে ওনাকে বললাম না।

মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ি
ছবি: লেখক

তখন বাজারের স্কুলে পড়ি। বাড়ি থেকে সাইকেলে করে যাওয়া-আসা করি। সিদ্ধান্ত নিলাম সাইকেল নিয়ে যাব। তবে বাড়িতে বলব না। বললে যাওয়া হবে না। কোনোমতেই একা যেতে দিতে রাজি হবে না। কেশবপুর বাজার থেকে টেম্পো বা ভ্যানে করে যাওয়া সহজ। মধুমেলার সময় বাসও যায়। সাইকেলে একটু দূর হয়ে যায়। তা ছাড়া সাইকেল সঙ্গে নিলে বাড়ির কেউ আঁচ করতে পারবে না। ছুটির দিনে খেলা করতে যাওয়ার অজুহাতে বেরিয়ে পড়লাম। অনেকটা পথ। লোকমুখে শুনতে শুনতে এগোতে লাগলাম। মসজিদটা চোখে পড়তেই দুশ্চিন্তার পাহাড় নেমে গেল। ঠিক পথেই এগোচ্ছি। বইয়ে পড়েছি, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী শিশু মধুসূদন এই মসজিদে ফারসি শিখতেন। মসজিদটির নির্মাণকাল খ্রিষ্টীয় আঠারো শতকে। এই রাস্তা ধরে এগোলে কবির বাড়ি পৌঁছাব না, সামনে আরও কোনো মোড় ঘুরতে হবে ভাবছি। আর চেয়ে চেয়ে চারপাশে দেখছি। আমাকে উশখুশ করতে দেখে মসজিদের পাশে পুকুরের ধারে বসে থাকা লোকদের একজন এগিয়ে এলেন। জিজ্ঞেস করতেই পথের বিবরণ বলে দিলেন। সযত্নে সাইকেলের প্যাডেলে বল প্রয়োগ করে কবির বাড়ির রাস্তার মুখে গিয়ে পৌঁছালাম।

সাইকেল ধরে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। টাকা ভাঙাতে হবে। ৫০০ টাকার নোট। জন্মদিনে টাকাটা ঠাকুমা দিয়েছিলেন। কবির বাড়িতে ঢুকতে টিকিট কাটতে হয়। ছোট নোট হলে দ্রুত হয়। আমি পাশের দোকান থেকে টাকাটা ভাঙিয়ে নিয়ে সাইকেলে উঠতে যাব। হঠাৎ একজন অপরিচিত লোক পেছন থেকে ডাকলেন। পেছনে ফিরে অবাক হলাম। মানুষটা অনেক লম্বা। ভালো করে পরখ করলাম। না, ভুল দেখিনি। সত্যিই মানুষটা ততটাই উঁচু। পরনে সাদা পাঞ্জাবি। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। মুখ থেকে জর্দার গন্ধ ভেসে আসছে। একটা কালো রঙের ব্যাগ হাতে। ছেলেধরা নয়তো, ভেবেই সাইকেল নিয়ে দৌড় দেওয়ার উদ্যোগ নিলাম। কিন্তু হলো না। লোকটা সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। যথাসম্ভব গাল প্রসারিত করে বললেন, ‘নিশ্চয়ই আমাকে ছেলেধরা ভাবছ। সাইকেল নিয়ে দৌড়ে পালাতে চাইছ!’ ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেল। চিৎকার করব কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না। লোকটা আমার আরও কাছে এসে কাঁধে হাত রাখলেন। ‘কবির বাড়ি ঘুরতে এসেছ। বাড়ির ধারের লোক ট্রেন ফেল করে। তুমিও ট্রেন ফেল করেছ। সম্প্রতি কবির জীবনী পড়ে কবির স্মৃতিশালা দেখার সাধ হয়েছে। ছোট মানুষ, বাড়ির বড়দের বলে আসতে। মনে রাখবে যে বয়সের যেই কাজ, তা তখনই করা উচিত। আগে করলে সব সময় ভালো কিছু ঘটে না, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মন্দ ঘটে। তাই ভালো-মন্দ বুঝতে শেখা না পর্যন্ত একা একা কোথাও যাবে না।’

মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমাধির সামনে লেখক

আশ্চর্য হলাম। মানুষটা জানলেন কীভাবে, সবজান্তা নাকি না জাদুকর। ভয় বহুগুণে বাড়ল। আমার ভয় দূর করতেই কি না জানি না, একটা আইডি কার্ড দেখালেন তিনি। বড় মানুষ, অনেক পড়ালেখা, গবেষণা করছেন। ভয় কিছুটা কমল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত চেয়ে চেয়ে দেখছি। তিনি বললেন, ‘ঢাকা থেকে এসেছি। কী যে ভোগান্তি। প্রথমে খুলনা এসেছিলাম। চিনি না তো, তারপর খুলনা থেকে যশোর হয়ে কেশবপুর। কিন্তু এখানে এসে শুনলাম, খুলনা থেকে চুকনগর হয়েও কেশবপুর আসা যায়।’ আমি চুপ করে রইলাম। ভদ্রলোক পকেট থেকে একটা পান বের করে গালে দিয়ে বললেন, ‘তা খোকা, কবির বাড়ি দেখতে এসেছ কবিকে দেখবে না! চলো একসঙ্গে ঘুরে ঘুরে দেখি, শেষে তোমাকে কবিকেও দেখাব।’ লোকটার অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা আছে। না বলতেই মনের সব কথা বুঝে ফেলেন। তাই মনে মনে আর কিছু আওড়ালাম না। আর কোনো উপায় নেই যেতেই হবে। তাই ভণিতা না করে সরাসরি বললাম, ‘চলেন। ঘুরে দেখি।’

কবির বাড়ির সামনে একটি গেট। গেটের একপাশে টিকিট কাউন্টার। আমি টিকিটের টাকা দিতে চাইলেও দিতে দিলেন না তিনি। নিজেই দিলেন। আমরা একসঙ্গে ভেতরে গেলাম। শুরুতেই চোখে পড়ল বিখ্যাত পঙ্‌ক্তিটি, ‘দাঁড়াও, পথিক–বর, জন্ম যদি তব বঙ্গে। তিষ্ঠ ক্ষণকাল!’ বড় বড় অক্ষরে বাঁধাই করে বসানো। তার ঠিক পাশেই বাঁধানো অক্ষরে লেখা ‘স্বাগতম মধুপল্লী।’ এরপরই কবির পারিবারিক পুকুর। সিঁড়ি বাঁধানো ঘাট। ঘাটের একপাশে বটগাছের মতো বৃহদাকার আমগাছ। পুকুরের চারধারে সাজানো সবুজ ঘাস। পুকুরের পাশেই কবির পৈতৃক কাছারি ভবন। যা মধুপল্লী গ্রন্থাগার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ভদ্রলোকের সঙ্গে ভেতরে গেলাম। কবির লেখা বই, চিঠিসহ বিভিন্ন সংগ্রহে সাজানো গ্রন্থাগার। ঘুরে ঘুরে দেখলাম। পাশের ভবনে কবির ব্যবহৃত অনেক তৈজসপত্র সংরক্ষণ করে রাখা। ভদ্রলোক খুঁটে খুঁটে দেখলেন নোট করলেন। ততক্ষণে আমার নাম–পরিচয় নিয়ে নিয়েছেন। গ্রন্থাগার থেকে বেরিয়ে কবির পারিবারিক পূজা মন্দিরে যাওয়ার সময় বললেন, ‘গৌরব, মধুসূদনের সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার কি জানো। শুধু মধুসূদনের কথাই–বা বলছি কেন, সব মেধাবীর ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা সত্যি। একটা বয়সে গিয়ে তাঁরা টের পেয়ে যান যে একদিন বিশ্ব তাঁদের কদর করবে। মাইকেলও যেমন বিষয়টা অনুভব করেছিলেন, একইভাবে রবীন্দ্রনাথও টের পেয়েছিলেন। রবি ঠাকুরের একটা কবিতা আছে। ‘১৪০০ সাল’, বড় হয়ে পড়। কথা বলতে বলতেই পূজা মন্দিরে গেলাম। পূজা মন্দির ঘুরে দেখে গেলাম পাশের ভবনে। ভবনটি কবির কাকার বাড়ি। সম্পূর্ণ বাড়ির চারপাশে বিভিন্ন ফলদ গাছ। শুধু সবুজ আর সবুজ। গাছগাছালি, পাখি, ফুল সবই আছে।

বাড়ির চারপাশ দেখা শেষে আমরা কপোতাক্ষ নদের কাছে গেলাম। অনেকগুলো নৌকা বাঁধা রয়েছে ঘাটে। সময় হিসেবে দরদাম করে নৌকা চড়া যায়। তিনি একটা নৌকা ভাড়া করলেন। আমরা নৌকায় চড়ে বেশ কিছুটা দূরত্ব নদীতে ঘুরলাম। কয়েকবার সেই বিখ্যাত লাইন আবৃত্তি করলেন তিনি, ‘সতত, হে নদ তুমি পড় মোর মনে/ সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।/ সতত যেমতি লোক নিশার স্বপনে/ শোনে মায়া মন্ত্র ধ্বনি তব কলকলে/ জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে।’ নদ ঘুরে পাড়ে উঠতেই ভদ্রলোক খপ করে আমার হাত ধরলেন। আমি ভয়ে জড়সড়। ‘গৌরব, একটা কাজ যে বাকি থেকে গেছে। তোমাকে কবিকে দেখাতে চেয়েছিলাম, দেখানো হলো না যে।’ বলে তিনি সামনের ফুলের দোকান থেকে কিছু ফুল কিনলেন। আমি পেছন পেছন হাঁটছি। পুনরায় বাড়ির ভেতর ঢুকলেন। আমিও গেলাম। আশ্চর্য, আগে চোখে পড়েনি। কাছারি ভবনের সামনাসামনি কিছুটা দূরে রয়েছে কবির আবক্ষ মূর্তি। ‘সামনেই ২৯ জুন কবির প্রয়াণ দিবস। আসার সুযোগ তো হবে না, শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে যাই। তোমার কবি দর্শনও হলো। না হলে তো বলতে, মিথ্যা বলেছি।’ শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে বললেন তিনি। কবির প্রতি মানুষটার ভালোবাসা দেখে বুকের ভেতর কেমন যেন একটা উথাল-পাথাল হয়ে গেল। অসীম আবেগে মানুষটাকে জড়িয়ে ধরলাম।

কেশবপুর, যশোর