ঈদগাহের পাশে ছোট একটা চায়ের দোকান। চারপাশে নকশা করা বাঁশের চাটাই দিয়ে বাঁধা, সঙ্গে একটা ছোট দরজা। দোকানের পাশে জলভরা একটা স্বচ্ছ পুকুর। এই দোকানের চা পান করার বড্ড ইচ্ছা মনের মধ্যে পুষে রেখেছি।
এই পুকুর অনেক কথার সাক্ষী। কাজের ফাঁকে ফাঁকে পুকুরপাড়ে চলে গাঁয়ের বধূদের আড্ডা। অন্য বধূদের চোখে পড়লেও এ দলে গুনগুনি ভাবিকে দেখতে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তিনি যেন শরতের মেঘমালা। কেন জানি তাঁর সঙ্গে কথা বলে বুকের ভেতরটায় একটা শান্তি অনুভূত হয়। সৌভাগ্যক্রমে দূর থেকে তাঁকে আজ দেখতে পেলাম। মনে হলো, চা পানের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়ার সঠিক মানুষটাকে পেলাম। একটু ছুটেই গেলাম। তাঁর হাত নিজের হাতে নিয়ে বললাম, ‘চলো চা খাই।’ তিনি আমার দিকে মিষ্টি হেসে বললেন, ‘সময় নাই রে, সংসারের অনেক কাজ পড়ে আছে।’
‘দূর ছাই! তোমার সঙ্গে চা খেতে এলাম। আর তুমি শুধু কাজের কথা বলো। একদিন সংসারের কাজ পরে করলে কী হবে? এসো তো!’
তিনি আমার কথা ফেলতে পারলেন না। ভাবির বর শহিদুল ভাই ধান মারা কাড়িগুলো আলাদা করছিলেন, তাঁর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তুমি যে এত সুন্দর, তোমাদের দুজনের জীবনের একখান রঙিন গল্প বলো।’
ভাবি হাসলেন, ‘রঙিন গল্প? হ্যাঁ একটা গল্প আছে, তাঁর বালু ছিটানোর গল্প।’
উৎসুক একটা হাসি মুখের ওপর এনে বললাম, ‘বালু ছিটানোর গল্প! সেটা আবার কেমন গল্প? বলো দেখি শুনি।’
‘তখন একাত্তর সাল। চারদিকে মেশিনগানের শব্দ, বাজারগুলোয় দাউদাউ আগুনের লেলিহান শিখা, শত শত গ্রাম জ্বলে–পুড়ে ভস্ম। আমি তখনকার গুনগুনি। নাম শুনে হেসো না। তখন গাঁয়ে দুপুর হলেই চলত মিলিটারির আনাগোনা। গোলা–বারুদ আর বুটের শব্দ রাত অবধি চলে। কোলে আমার প্রথম সন্তান। প্রতি সন্ধ্যায় বাড়ির উঠানে সবাই বসে গল্প করি। মনে মনে ভাবি, এটাই শেষ গল্প। কে জানে কার ঘরে কী হয়। নির্ঘুম রাত। আতঙ্কিত মন নিয়ে দুশ্চিন্তায় দুচোখে ঘুম আসে না। দেশের পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হতে শুরু করল। গ্রামের বাজারগুলোয় সকালে চুপচাপ কিছু বেচাকেনা চলত। চারদিকে অভাব দেখা দিল। ঘরে খাবার নেই। নিজের খাবারের চিন্তা নেই; কিন্তু অবুঝ শিশুর ক্ষুধার কষ্ট দেখে থাকা যায় না। সারা দিন ক্ষুধার জ্বালায় বিরক্ত করে। কী করি? ঘরে কিছু পাট ছিল, ভয়ে ভয়ে তোমার ভাইকে দিয়ে বাজারে পাঠালাম।’ একটা নিশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ চুপ রইল। এরপর মুচকি হেসে মাথা নিচু করে বললেন, তারপর সে আর বাড়িতে ফিরে নাই।
তাঁর এই অভিব্যক্তি আমাকে বিস্মিত করল, ‘বাড়িতে ফিরে নাই, বলো কী?’
‘নাহ! সে আর বাড়িতে ফিরে নাই। দেবর, ভাসুরসহ সবাই যে যেখানে পারছে খুঁজছে, পায় নাই। সবাই ধরে নিয়েছিল, মিলিটারিরা হয়তো নিয়ে গেছে। কথাটা আমারও কানে এল।’
একটু উৎসুক হয়েই বললাম, ‘কাঁদো নাই?’
—না, কান্না করি নাই। প্রতিদিনই মানুষের মরণের খবর, গুলির আওয়াজ শুনি। ভয়ে, শোকে, ক্ষুধায় বুক শক্ত হয়ে গিয়েছিল। তাই কান্না করি নাই। ঘরে স্বামী নাই, খাবার নাই, কেমন করে সন্তানের জন্য খাবার জোগাড় করি; সেই চিন্তায় মাথা ঘুরে। রওনা দিলাম বাপের বাড়ি।
—বাপের বাড়ি কত দূর?
—এখান থেকে পাঁচ-ছয় কিলো। ঘোর আন্ধকার রাত, ভোর তখনো হয় নাই, একবুক সাহস নিয়ে পায়ে পায়ে রওনা দিলাম। খুব সকালেই পৌঁছে যাই। গিয়ে দেখি, উঠান খাঁ খাঁ, ঘর দুইটার দরজা খোলা, দুই-একটা কাক ঘরের চালে ওড়াউড়ি করছে, বাড়ি শূন্য, আব্বা নাই। মাথার ওপর যেন বাজ পড়ল। দৌড় দিয়ে চাচার বাড়িতে গেলাম। চাচি বারান্দায়ই ছিল। আমাকে দেখে তাড়াতাড়ি করে নেমে এল। বলল, ‘ভয় পাস না। তোর আব্বা এইখানে থাকার সাহস পায় না। গেছে দাদার বাড়ি।’ একমুহূর্ত দেরি না করে রওনা দিলাম দাদার বাড়ি। সেখানে গিয়ে চোখে অন্ধকার দেখা শুরু করলাম। ঘর তালাবন্ধ। কী করি? দুপুর হলেই বুলেটের শব্দ আর মিলিটারির গর্জন শুরু হবে। কোথায় লুকাব, এমন ভাবতে ভাবতেই দেখলাম, দাদাজান কোথা থেকে যেন দৌড় দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে আসলেন। কোনো কথা না বলে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন বাগানের মধ্যে একটা সুরঙ্গ পথ দিয়ে কোঠার ঘরে। তালাবদ্ধ কোঠার ঘরে বন্দী হয়ে কাটালাম কয়েকটা দিন। এরপর আবার ফিরে আসি স্বামীর ভিটায়। সে সময় আব্বা অনেক কষ্ট করে বাবুর খাবার পাঠাত। এর মধ্যে তোমার ভাইয়ের জন্য মিলাদ দিলাম।
গুনগুনি ভাবি এই বয়সেও গোলাপি। মুখের বলিরেখাগুলো যেন কালের সাক্ষী, লাজুক হাসি, কখনো কারও সঙ্গে বিবাদ হয়েছে এমন কথা কেউ বলতে পারবে না। মতের মিল না হলে সরে পড়েছে, কিন্তু বিবাদ করেনি। ‘তাহলে শহিদুল ভাই কি তোমার দ্বিতীয় বর?’
—না না, কী বলো?
—তাহলে? ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে মিলাদ করছ না!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘মিলাদ করেছি কিন্তু জিন্দা মানুষের।’ বলে মাথা নিচু করে রইলেন। মুখের ওপর একটা গভীর বেদনার ছাপ।
—কী হলো? মনে ব্যথা দিলাম? কেমন করে জানলে, উনি বেঁচে ছিলেন?
—তোমার ভাই হারানোর সাত মাস অতিবাহিত হয়। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা সম্মান দিয়েই রাখে আমাকে। কিন্তু গ্রাম-গঞ্জে কিছু রাজাকারও ছিল। তাই সন্ধ্যার পর উঠানে বসে জা-জ্যাঠানি মিলে নিজেদের রক্ষা করার গল্প করে তাড়াতাড়ি যে যার ঘরে পড়ে থাকতাম। একদিন হলো কী, অন্ধকার ঘন হতে শুরু করেছে, উঠানে সবাই মিলে গল্প করছি, দেখলাম আমার পিঠে কে যেন মুঠোভর্তি বালু ছুড়ছে। মনের মধ্যে সন্দেহ হলো। চিন্তা করলাম, আমার সঙ্গে তো কেউ ঠাট্টা–মশকরা করে না, সবাই সমীহই করে। এইটা তোমার ভাইয়ের কাজ ছাড়া আর কারও সাহস হওয়ার কথা না। মনের মধ্যে সাহস সঞ্চার করলাম, কাউকে কিছু বললাম না। সবাইকে বললাম, ঘরে যাও। রাত বাড়ছে। আর আমি ধীরে ধীরে কোঠার ঘরের পাশে চাপকলের পাড়ের দিকে গেলাম। যাওয়ামাত্র তোমার ভাই মুখ চেপে ধরে বলল, ‘ভয় পাস না, আমি!’
—বলো কী? তুমি তো জানতে ভাই মারা গেছে, মিলাদ করছ। ভয় করে নাই? ভাই হইতে পারে, এমন বিশ্বাস করলে কীভাবে?
—মন কোনো দিন বলেনি সে মরছে, বিশ্বাস ছিল যে সে ফিরবে। এই কথা কাউকে বলি নাই। মনে মনে ভাবছি, কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে না, তাই দিনের পর দিন আশায় বুক বাঁধছি, পথ চেয়ে থাকছি। এ জন্যই সাহস করে দেখতে গেছি কে ওই অন্ধকারে!
মুচকি হেসে বললাম, ‘যখন ভাইকে দেখলে কেমন লাগল?’ ভাবি ফোকলা দাঁতে হেসে দিলেন, ‘লজ্জার কিছু নাই, সেই অন্ধকারে তারে দেখছি, মুখে দুইজনেরই কোনো কথা ছিল না, মনের মধ্যে হাজার তারার বাতি জ্বলছিল। হাত ধরে তারে ঘরে নিলাম। সেই রাত সে আমার সঙ্গে থাকল। স্বর নিচু করে তার সঙ্গে সারা রাত কথা বললাম। সে আমাকে তার মুক্তিফৌজে যোগ দেওয়ার কথা জানাল।’
—ভাই মুক্তিফৌজে যোগ দিয়েছিল? মানে মুক্তিযোদ্ধা?
—হাঁ, তোমার ভাই মুক্তিযোদ্ধা ছিল। দেশ স্বাধীন করার জন্য হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়ছে।
—আমি তো জানি না। তা ভাই কী বলল?
—সে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। জানাল, সেদিন বাজারে নাসিরুল ভাইর সঙ্গে দেখা। সে আগেই পাট বিক্রি করেছিল। নাশতা খাইতে চাইলে সে একটা দোকান দেখিয়ে দিল। সেখানে গিয়ে দেখে, আরও অনেক যুবক ছেলে। সবাই দেশ স্বাধীন করার জন্য বাড়ি ছাড়ছে। তাদের কথা শুনে তোমার ভাইর রক্ত টগবগ করতে লাগল দেশ স্বাধীন করার জন্য। আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল; কিন্তু আমায় দেখে মায়া বাড়বে বলে আর বাড়িতে আসে নাই।
এমন অনেক কথায় রাত গভীর হতে থাকে। আমি উনুন জ্বালাতে জ্বালাতে তাকে এ গাঁয়ের কিছু রাজাকারের কথা বললাম। ভোরেরাতে রান্না করে তাকে খাওয়াইলাম। কথায় কথায় জানতে চাইলাম, ‘কোথা থেকে এলে?’
বাড়ির পাশে বোদা এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী দমন করতে এসে আমাকে আর বাবুকে দেখার লোভ সামলাতে পারেনি। ভোরে অন্ধকার থাকতেই আবার বিদায় নিল। যাওয়ার কালে পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘বউ, সাবধানে থেকো, আমার জন্য দোয়া কইরো। আমি আরও একবার আসব এ গাঁয়ের রাজাকারদের সঙ্গে দেখা করার জন্য। তবে কবে আসব বলতে পারছি না। আমি তোমার জন্য স্বাধীনতা নিয়ে আসব।’
—এই কথা তুমি কাউকে বলো নাই? উনি কি আবার আসছিলেন?
—নাহ! কাউকে বলি নাই। সে আরও একবার আসছিল। একদিন সন্ধ্যার পর সে আবার কলের পাড়ে এসে পটপট করে আঙুল ফুটাইতে লাগল। আর আমরা রোজকার মতো উঠানে বসে গল্প করছি। শব্দ শুনেই বুঝেছি, সে আসছে। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে তারে ঘরে নিলাম। রাজাকাররা জেনে গেছে, সে মরে নাই, মুক্তিযুদ্ধে গেছে। একদিকে হানাদারের ভয়, অন্যদিকে রাজাকারের ত্রাস। যদি রাগের বশে প্রাণে মেরে ফেলে, তাই তিন দিন ঘরের পাটনের ওপর লুকিয়ে রাখলাম। কাউকে কিছু বুঝতে দিলাম না। তৃতীয় দিন শেষরাতে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ, বুক শুকিয়ে এল, সে ওপর থেকে ইশারা করল দুয়ার খুলতে। যেই দুয়ার খুলছি, ওমনি মুখ চেপে ধরল একজন। ফিসফিস করে বলল, ‘আমি মুক্তিফৌজ। তোমার স্বামীর সঙ্গে এসেছি, তাঁকে বাইর হতে বলো।’ সত্য-মিথ্যা বুঝার আগেই তোমার ভাই তরতর করে নেমে আসল। সেই রাতে তারে কিছু খাওয়াইতে পারি নাই। সে একবার আমার মুখের পানে চাইল; এরপর দুই বন্ধু অন্ধকার রাতে মিলিয়ে গেল।
গল্প শুনতে শুনতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। গুনগুনি ভাবি বলেই চলছিলেন, দেশ স্বাধীনের পর সে আবার ফিরে আসে।
লক্ষ করলাম, কথাগুলো বলতে বলতে গুনগুনি ভাবির মুখে তৃপ্তির হাসি আর চোখের কোণে জল টলমল করছে। ততক্ষণে শেষ বিকেলের আকাশ কমলা রং ধারণ করতে শুরু করেছে। ভাবিকে বললাম, ‘যাও তোমার বেলা পড়ে যাচ্ছে।’
তিনি মিষ্টি হাসি দিয়ে বললেন, ‘ঠিক বলেছ। তোমার ভাইকে খাবার দিতে হবে।’
আমি খালি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। আর ভাবলাম, নারীরা শুধু বীরাঙ্গনা হয়েই দেশ স্বাধীন করেনি। জীবিত স্বামীকে সমাজের চোখে দাফন দিয়ে বিধবা সেজে স্বাধীনতার জন্য সাহস জুগিয়েছে, লড়েছে প্রাণপণ।