শেষ যাত্রা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আনুর সঙ্গে পরিচয় বেশি দিনের না। এর মধ্যেই আমাদের সুন্দর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। কলেজের সিঁড়ি, মাঠের উত্তর পাশে বটতলা, বাংলা বিভাগের ক্লাশরুম—সব জায়গায় আমাদের বিচরণ।

এক ঈদের ছুটিতে আনুকে ট্রেনে উঠিয়ে দিতে গেলাম। গিয়ে শুনি ট্রেন আসতে বিলম্ব হবে। প্রথমে একটু বিরক্ত লাগলেও পরে মনে হয়েছে বিধাতাই আমার জন্য এ সময়টুকু দিয়েছে। স্টেশনের উত্তর পাশে একটা বেঞ্চিতে আমি আর আনু বসে বাদাম খাচ্ছিলাম। হঠাৎ আনু বলল, ‘আচ্ছা বলতো, আমাকে তোমার কেমন লাগে?’ কিছু না ভেবেই উত্তর দিয়েছিলাম, ‘এক পাশলা বৃষ্টির পর মেঘলা আকাশের বুক চিরে সূর্য হেসে ওঠে, শরতের সকালে ঘাসের সঙ্গে শিশির যেমন মিশে থাকে, তেমনি তুমি আমার কাছে।’ জবাব শুনে আনু বলল, ‘সত্যি!’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’ আবারও জানতে চাইল, ‘আচ্ছা বলতো আমি যদি তোমার জীবনসঙ্গী হই, তবে তোমার কেমন লাগবে?’ জবাবে বললাম, ‘তুমি তো আমার এমনিতেই ভালো বন্ধু। আর একজন ভালো বন্ধুই তো জীবনসঙ্গী হিসেবে উত্তম।’

উত্তর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তপ্ত দুপুরে হাজার লোকের ভিড়ে আনু আমার ঠোঁটের কাছে তার ঠোঁট স্পর্শ করে বলল, ‘তুমি শুধু আমার।’ আমি কিছু বুঝে ওঠার আগে, কেউ কিছু দেখে ফেলার আগেই সে কীভাবে কী করল, বুঝতেই পারিনি! মনে হলো মুহূর্তের জন্য স্বর্গ নেমে এসেছে ধরণীতে।

এরপর অনেক গল্প, আড্ডা চলল আমাদের মধ্যে। এমন সময় রেলগাড়ির হুইসেল দিল। আনুর মন খারাপ। আমাকে ছেড়ে যেতে চাইছে না। তবু যেতে হবে। ১ নম্বর প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনে আনুকে উঠিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন ছেড়ে দিল। আনু জানালা দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। যতদূর দেখা যাচ্ছিল, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। কে জানত সেটাই শেষ দেখা হবে!

বাসায় ফিরে সন্ধ্যায় নাস্তা করে টেলিভিশন দেখতে বসছি। হঠাৎ একটা নিউজে চোখ আটকে যায়। করতোয়া আন্তনগর ট্রেন দুর্ঘটনায় পাঁচজন নিহত। সেই পাঁচজনের মধ্যে আমার আনুও ছিল।

এখনো নিজেকে বিশ্বাস করাতে কষ্ট হয়। সেই দিন থেকে আজও ট্রেনের শব্দ শুনলে মনে হয়, এই বুঝি আমার প্রিয়তমা আসছে…

সভাপতি, গাইবান্ধা বন্ধুসভা