যেভাবে প্রথম সিনেমা বানিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ

আগুনের পরশমণি ছবির শুটিংয়ের অবসরে বৃষ্টিস্নান: বাঁ থেকে সামনে—শিলা আহমেদ; পেছনে—মোজাম্মেল হোসেন, হুমায়ূন আহমেদ, মাসুক হেলাল; আর একেবারে পেছনের সারিতে—মিনহাজুর রহমান ও স্থপতি আবদুল করিমছবি: লেখকের সৌজন্যে
হাতে চিত্রনাট্য, মনে সিনেমা বানানোর স্বপ্ন; কিন্তু পকেট ফাঁকা। ফাঁকা বলতে শূন্য না, হাতে মাত্র দুই লাখ টাকা। সিনেমার জন্য এটা ফাঁকাই ধরা যায়।

সিনেমার স্বপ্নটা দেখান ফিজিকসের আনিস সাবেত। তাঁর সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে এসে। ফিজিকস নিয়ে পড়লেও উনি প্রায়ই শোনাতেন আলো–আঁধারের গল্প, স্বপ্ন দেখতেন ছবি বানানোর। এমনকি সে সময়ে আহমেদ ছফার ‘ওংকার’ উপন্যাস নিয়ে চিত্রনাট্যও লিখে ফেলেন তিনি। কিন্তু সেটা পর্দায় আনার আগেই পড়াশোনার তাগিদে দেশ ছাড়তে হয়। তবে স্বপ্ন ছাড়েননি, বিদেশের মাটিতে বসেই বানালেন নিজের স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র, জিতলেন পুরস্কারও।

১০ বছর পর দেশে ফিরে সে গল্প শুনিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদকে। তারপর হঠাৎ হানা দিল ক্যানসার, আনিস সাবেতকে স্বপ্নের সঙ্গে বিসর্জন দিতে হয়েছিল জীবনকেও। ওনার চলে যাওয়ার পর হুমায়ূন আহমেদের মনে সেই স্বপ্ন ঢুকে গেছে। একদিন ভোরবেলা স্ত্রী গুলতেকিনকে জানালেন সেই স্বপ্নের কথা, ছবি বানানোর কথা। ছবির নাম ‘আগুনের পরশমণি’।

চাইলেই কি আর ছবি বানানো যায়! আবার স্বপ্নকেও তো নিজ হাতে মারা যায় না। নিজের লেখা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘আগুনের পরশমণি’কে চিত্রনাট্যে রূপ দিতে শুরু করলেন। সেই সঙ্গে সিনেমা তৈরির ওপর লেখা দেশি-বিদেশি বই খুঁজে সেগুলো পড়তে শুরু করলেন। বইয়ের জন্য সাহায্য নিলেন বন্ধুদের। এদিকে আরেক সমস্যা এসে জুড়ে বসল! হয় অধ্যাপক হওয়ার জন্য রিসার্চের কাজ চালিয়ে যেতে হবে, নয়তো সিনেমা নিয়ে থাকতে হবে। মনের কথা শুনে রিসার্চ বাদ দিয়ে চিত্রনাট্যে মনোনিবেশ করলেন। তবে তাঁর ভাগ্য সহায় ছিল। দুটোই পেলেন একসঙ্গে।

হাতে চিত্রনাট্য, মনে সিনেমা বানানোর স্বপ্ন; কিন্তু পকেট ফাঁকা। ফাঁকা বলতে শূন্য না, হাতে মাত্র দুই লাখ টাকা। সিনেমার জন্য এটা ফাঁকাই ধরা যায়। সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এলেন বন্ধু এবং নাট্যাভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর। দিনভর দুজনে মিলে অর্থ সন্ধানে ঘোরাঘুরি করলেও মানুষের কাছ থেকে শুধু উৎসাহই মেলাতে পারলেন। রাতে একাকী ভাবতে ভাবতে মাথায় এল তথ্যমন্ত্রীর নাম, সেখানে গিয়েও হতাশা নিয়েই ফিরতে হলো। শেষে ঠিক করলেন বাসা বিক্রি করবেন, তবু ছবি বানাবেনই। এরই মধ্যে সুখবর মিলল সরকার আবার ছবির জন্য অনুদান প্রথা চালু করেছে এবং সেখানে তিনটা ছবির মধ্যে রয়েছে আগুনের পরশমণির নাম।

সিনেমার চরিত্র বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও নিজের মনের কথাই শুনলেন। বদিউল আলম চরিত্রে রাখলেন আসাদুজ্জামান নূরকে, রাত্রি চরিত্রে বিপাশা হায়াত, একে একে যুক্ত করা হলো ডলি জহুর, আবুল হায়াত, দিলারা জামান, শীলা, পুতুল, সালেহ আহমেদ, ওয়ালিউল ইসলাম ভূঁইয়াসহ আরও অনেককে। সহকারী পরিচালক হিসেবে নিলেন তারা চৌধুরীকে; যাঁর রেকর্ড ছিল কোনো পরিচালক সিনেমায় তাঁকে দ্বিতীয়বার নেননি। সম্পাদনায় যুক্ত করলেন আতিকুর রহমান মল্লিককে। মানুষের কথা না শুনেই ক্যামেরায় নিলেন আখতার হোসেনকে। সত্য সাহা যুক্ত হলেন সংগীত পরিচালক হিসেবে। মাসুক হেলাল, ধ্রুব এষ বাদ রাখেননি কাউকে।

সিনেমা বানাতে হলে খাজা বাবার দোয়া নিতে হয়, এটা শুনে অবাকই হলেন হুমায়ূন আহমেদ। মোজাম্মেল সাহেবের কথা রাখতে, মনের কৌতূহল মেটাতে তাঁকে নিয়েই গেলেন আজমীর শরিফ। খাদেমের মারফতে স্ক্রিপ্ট পাঠানো হলো ভেতরে। কিন্তু সে রীতিমতো চমকে দিল যে চিত্রনাট্যে বিরাট গণ্ডগোল, ফুফুর চরিত্র নেই। তাহলে কি আধ্যত্মিক ব্যাপার সত্যিই আছে! কিন্তু ব্যাপারটা তেমন না, সেখানে ওনারই আরেক ভক্তের সম্পর্ক জুড়ে ছিল। যিনি উপন্যাসটা আগে পড়েছিলেন। মাথায় কুলাভর্তি ফুল নিয়ে চিত্রনাট্য ঢোকাতে হলো মাজারের গিলাফের ভেতর। কথা ছিল সিনেমা রিলিজের দিন সেটা বের করা হবে গিলাফের ভেতর থেকে। সেটা বের করা হয়েছিল কি না, সে খবর আর পাননি হুমায়ূন আহমেদ।

দোয়া নেওয়া শেষ হলেও সিনেমার জন্য বসতে হবে পরীক্ষায়। পরিচালক সমিতি গো ধরেছে তারা পরীক্ষা নেবে। যদি সেখানে উত্তীর্ণ হতে পারেন, তবেই সিনেমা বানাতে পারবেন। ছবির জগতে পরিচিত মুখ চাষী নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে জনা বিশেক মানুষের সামনে বসতে হলো পরীক্ষায়। কোনোমতে পাস নম্বর পেয়ে মিলেছিল সহযোগী সদস্যপদ। সিনেমার জগতে পরিচিত চারটি শব্দ লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন, কাট। কিন্তু পরিচালক প্রথম দিনেই ভুলে গেলেন কাট বলার কথা। ক্যামেরা চলছে, ক্যামেরাম্যান আখতার সাহেব সেটা মনে করিয়ে দিলেন। কিন্তু যতক্ষণে কাট বলেছেন, ততক্ষণে পরের দিন খবরের পাতায় এই খবর উঠে এসেছে। এ নিয়ে হয়েছে প্রচুর হাস্যরস। এসব অবশ্য তিনি গায়ে মাখলেন না।

সিনেমা বানানো শেষ, এসে ঠেকল সেন্সরে। বিএনপি তখন ক্ষমতায়, চিত্রনাট্যে শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠ না থাকলেও পরবর্তী সময়ে হুমায়ুন আহমেদ ভাবলেন মুক্তিযুদ্ধের ছবি, সেখানে বজ্রকণ্ঠ থাকবে না, এমনটা হতে পারে না। জাতির পিতার ‘বজ্রকণ্ঠ’ ঢুকিয়ে দেওয়া হলো ছবিতে। সেন্সরে সেটা নিয়েই ঝামেলা বাধল। যদিও মিসির আলীর মতো যুক্তি দিয়ে সেটা উতরে যান তিনি। তবু খবর রটল তিনি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ কেটে ছবি থেকে বাদ দিয়েছেন। চট্টগ্রামে এ নিয়ে হল ভাঙচুরও হয়েছিল ছবি মুক্তির আগে। পরবর্তী সময়ে ছবি দেখে মানুষের ভুল ভাঙলেও মিথ্যা খবরের চাউর হুমায়ূন আহমেদকে দুঃখ দিয়েছিল ঠিকই। ‘আগুনের পরশমণি’ মানুষের মন জয় করে নিতে সক্ষম হয়।

নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ