মর্জিনা কথা বলার আগেই বউ আমাকে উদ্দেশ করে বলল, ‘এই, তুমি একটা কথাও বলবা না। মর্জিনা, তুমি ঘটনা খুলে বলো।’
বাসায় সালিস বসেছে। অপরাধী আমি। আমার চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্য ভালো, এখনো পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরানো হয়নি। বিচারক আমার বউ, সহযোগী বিচারক পাশের বাসার শায়লা ভাবি। ফরিয়াদি বাসার কাজের মেয়ে মর্জিনা। তার সহযোগী আবার শায়লা ভাবিদের কাজের মেয়ে নুরজাহান।
অপরাধ হলো, আমি নাকি মর্জিনাকে অপমান করেছি। মর্জিনা এ কথাটা বলেছে নুরজাহানকে। নুরজাহান রং চড়িয়ে সেটা বলেছে শায়লা ভাবিকে। শায়লা ভাবি আরেকটু রং চড়িয়ে বলেছে আমার বউকে। আর বউ? থাক, আর না বলি। ঘরের খবর পরের জেনে লাভ কী!
ঘরের অবস্থা থমথমে। মর্জিনা ঘোষণা করেছে, সুষ্ঠু বিচার না পেলে এ বাড়িতে আর কাজ করবে না। তার কাজের অভাব নেই। কত লোকজন এসে তার পায়ে ধরছে কাজ করার জন্য! সঙ্গে যোগ দিয়েছে নুরজাহান। বিচার না হলে সেও কাজ ছেড়ে দেবে। গরিব বলে বিচার পাওয়ার অধিকার নাই?
আমি বললাম, ‘মর্জিনা, তোমাকে কখন অপমান করলাম? তা ছাড়া তোমাকে অপমান করলে নুরজাহান কাজ ছাড়বে কেন? প্রেমিক-প্রেমিকাও তো একজন আরেকজনের জন্য এত দরদ দেখায় না, যেটা নুরজাহান তোমার জন্য দেখাচ্ছে!’
মর্জিনা লাফিয়ে উঠে বলল, ‘এই তো আবার অপমান করলেন! আপনের তো কতায় কতায় অপমান করা স্বভাব। আমরা গরিব বইলা কি মানইজ্জত নাই? আমরা কি ভাইসা আসছি?’
‘তোমারে কখন অপমান করলাম?’
মর্জিনা কথা বলার আগেই বউ আমাকে উদ্দেশ করে বলল, ‘এই, তুমি একটা কথাও বলবা না। মর্জিনা, তুমি ঘটনা খুলে বলো।’
‘ম্যাডাম, আপনের জামাইয়ের কতায় কতায় রাগারাগি করার স্বভাব। সেদিন দেখলাম, রাস্তার পাশের দোকানদারের লগে রাগারাগি করতাছে…।’
মর্জিনার কথা শেষ হওয়ার আগেই শায়লা ভাবি বলল, ‘ব্যাটা মানুষ আর কিছু পারুক আর না পারুক, বউয়ের সঙ্গে রাগারাগি ঠিকই পারে। পুরুষ মানুষের খাসলত বহুত খারাপ…।’
নুরজাহান সমর্থন করে বলল, ‘একদম খাঁটি কতা কইছেন ভাবি। পুরুষগো খাসলত আমার জানা আছে। এরা বদের বদ!’
আমি বললাম, ‘আরে ভাবি, সে বলতেছে দোকানদারের কথা। আপনি আবার কিসের ঝামেলা করেন? দোকানদার আমাকে পচা ডিম গছিয়ে দিয়েছে বলে রাগারাগি করেছি। মর্জিনা, তোমার সঙ্গে কখন রাগারাগি করলাম?’
মর্জিনা মাথা চুলকিয়ে বলল, ‘আচ্ছা এই ঘটনা বাদ। আপনে তো সখিনার লগেও রাগারাগি করতেন।’
সখিনা আমাদের বাসায় আগে কাজ করত। তার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় মর্জিনাকে আনতে হয়েছে। দুই মাস আগে সখিনাই ওকে ঠিক করে দিয়ে গেছে।
অসহায় কণ্ঠে বললাম, ‘সখিনা তোমাকে বলেছে এই কথা?’
‘আমারে বলতে হইব কেন? আমি কি জানি না? আমি কি আন্ধা? আমার চোখ কি বিলাই খাইছে?’
‘তুমি কীভাবে জানো? তুমি তো তখন এই বাড়িতে ছিলে না। বানিয়ে কথা বলছ কেন?’
মর্জিনা বলল, ‘আইচ্ছা এই ঘটনাও বাদ।’
‘তুমি তো সব ঘটনাই বাদ দিয়ে দিচ্ছ, তাহলে বিচার বসাইছ কেন? আমারে তো ফাঁসির আসামি বানাইয়া দিলা!’
বউ রাগী গলায় আমাকে বলল, ‘তোমাকে কথা বলতে নিষেধ করলাম না? তুমি এত কথা বলতেছ কেন? মর্জিনা, তুমি আসল কথা বলো। এই মিচকে শয়তান কী করেছে?’
‘ভাবি, আপনের জামাইয়ের তো চোখ খারাপ, খালি মাইয়াগো দিকে তাকায় থাকে। কাল দুপুরে আমি দেখছি...।’
বউ সোফা ছেড়ে লাফিয়ে উঠে বলল, ‘বলো কী! এইটা তো আমি জানতাম না। কী করছিল? তোমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকাইছিল!’
‘না, অন্য মেয়ে।’
বউ আমার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘এই, তোমাকে ভালো মানুষ বলেই জানতাম! তলে তলে এই করো! এই সত্যি কথা বলো, মেয়েটা কে?’ বলেই কাঁদতে শুরু করল।
আমি মনে মনে আতঙ্কে ভুগতে লাগলাম। বউ না আবার কান্না থামিয়ে আমাকে এক্ষুনি ছুরি নিয়ে তাড়া করে। আগে দৌড়ে পারলেও এই ভুঁড়ি নিয়ে এখন আর দৌড় দেওয়া সম্ভব নয়। শায়লা ভাবি উঠে দাঁড়িয়ে বউকে সান্ত্বনার সুরে বলল, ‘দেখছেন ভাবি, আমি বলি নাই, পুরুষ মানুষের খাসলত খারাপ! এখন আমার কথা বিশ্বাস হলো? সাপকেও বিশ্বাস করা যায়; কিন্তু পুরুষ মানুষ? কাভি নেহি।’
নুরজাহান তাল মিলিয়ে বলল, ‘একদম খাঁটি কতা। বেডা মানুষ আর শয়তানের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।’
আমি অসহায় হয়ে সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘মর্জিনা, আমি তো গতকাল সারা দিন বাসা থেকেই বের হই নাই। দুপুরে একটা দক্ষিণী মুভি দেখেছি। আমি আবার কোন মেয়ের দিকে তাকাইলাম?’
মর্জিনা ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল, ‘কেন, আপনে সেই টিভির নায়িকার দিকে তাকাইয়া থাকেন নাই? আল্লাহ গো আল্লাহ, কীভাবে মিথ্যা কতা কয়। আমরা মইরা গেলেও মিথ্যা কতা কই না!’
আমি ধপাস করে আবার সোফায় বসে পড়লাম। শায়লা ভাবি মোবাইল টেপাটিপি করতে লাগল। নুরজাহান অন্যদিকে তাকিয়ে গাল চুলকাতে লাগল। বউ মনে হয় আমাকে তলে তলে খুন করার পরিকল্পনা করছিল, আপাতত সেই চিন্তা বাদ দিয়ে মর্জিনাকে ধমক দিয়ে বলল, ‘আসল কথা বলো, তোমাকে কখন অপমান করা হয়েছে?’
‘ভাবি, সুষ্ঠু বিচার করবেন তো?’
‘অবশ্যই করব। তুমি বলো কী হয়েছে?’
‘গত পরশু আমার হাত থিকা পইড়া দুইটা গ্লাস ভাঙছে না…।’
বউ মর্জিনাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘তুমি গ্লাস ভেঙেছ? কই, আমি তো জানি না!’
আমি বললাম, ‘তোমার এক বিদেশি বান্ধবী এক ডজন বেলজিয়াম গ্লাস পাঠিয়েছে না? ওখান থেকে মর্জিনা পরশু দুইটা গ্লাস ভাঙছে। আমি জানি, আমি মারা গেলেও এতটা কষ্ট পাবে না, যতটা কষ্ট পাবে তোমার প্রিয় গ্লাসের জন্য। সে জন্যই তোমারে বলিনি।’
বউ হায় হায় করে উঠল। এতক্ষণ সে কাঁদছিল স্বামীর চরিত্রের শোকে। এখন কাঁদছে গ্লাসের শোকে।
বউ হায় হায় করে উঠল। এতক্ষণ সে কাঁদছিল স্বামীর চরিত্রের শোকে। এখন কাঁদছে গ্লাসের শোকে। ভেঙে যেতে পারে বলে বেচারি নিজে কখনো এই গ্লাস দিয়ে পানি খায় না। মর্জিনা মোছামুছির সময় সেখান থেকে দুইটা ভেঙেছে।
শায়লা ভাবি এবার বিচারকের দায়িত্ব পালন করতে বসল, ‘মর্জিনা, হানিফ ভাই তোমাকে কীভাবে অপমান করেছে সেইটা ভাবিকে খুলে বলো। ডিটেইলস বলবা, কোনো কিছু বাদ দিবা না।’
মর্জিনা এবার ভাবির দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘ভাবি, গেলাস কি আমি ইচ্ছা কইরা ভাঙছি? আপনে বলেন? হক কতা বলবেন।’
‘না, ইচ্ছে করে ভাঙো নাই। তারপর কী হলো? হানিফ ভাই তখন তোমাকে কী বলল?’
সে আমারে বলেছে, ‘মর্জিনা, কাজ করার সময় তোমার মন কই থাকে, মন দিয়া কাম করবা না? বলেন ভাবি, আমি কি মন দিয়া কাম করি না? আপনে হক কতা বলেন। এইটা অপমান না? আপনেরা তো আবার আমরা গরিব বইলা হক কতা বলেন না। যদি সুষ্ঠু বিচার না করেন, চইলা যামু। এত অপমান নিয়া এই বাসায় কাম করণের দরকার নেই।’
নুরজাহান সায় দিয়ে বলল, ‘খাঁটি কতা। আমিও চইলা যামু। এত অপমান সহ্য অয় না।’
শায়লা ভাবি আর বউ চোখ চাওয়াচাওয়ি করছে। কীভাবে বিচার করবে বুঝতে পারছে না। এই আকালের দিনে যে ভালো একটা কাজের মেয়ে পাওয়ার চেয়ে স্বর্ণের খনি পাওয়া সহজ, এটা তারা ভালো করেই জানে। এরা চলে গেলে না খেয়ে থাকতে হবে।
শায়লা ভাবি নরম গলায় বলল, ‘শোনো মর্জিনা, হানিফ ভাই তো তোমাকে গালি দেয়নি, কীভাবে অপমান করল?’
মর্জিনা লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল, ‘গালি দিলে আপনে খুশি হইতেন? জানি তো, গরিবের বিচার নেই। আপনেরা সবাই এক। আমি আর এই বাসায় কাজ করতাম না। আজই চইলা যামু।’ বলেই সে ধুপধাপ করে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল।
কিছুক্ষণ পর সে পোঁটলাপুঁটলি গুছিয়ে বেরিয়ে এল এবং দরজার দিকে হাঁটা দিল। বউ হায় হায় করে উঠল। অনেক কষ্টে এই মেয়েকে জোগাড় করা হয়েছে। স্বামী না থাকলেও তার চলবে! কিন্তু কাজের মেয়ে ছাড়া যে তার চলবে না।
বউ দৌড়ে গিয়ে মর্জিনার হাত চেপে ধরে বলল, ‘মর্জিনা, করো কী? তোমার ভাই না হয় না বুঝে একটা অপরাধ করে ফেলেছে, তাই বলে কি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে? কাজটা কি ঠিক হবে? তা ছাড়া তোমার বেতন তো দেওয়া হয়নি এ মাসে!’
মর্জিনা এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘বেতনের ধার মর্জিনা ধারে না। টেকা দিলে দিবেন, না দিলে নাই। এত অপমান নিয়া এই মর্জিনা কাম করে না। আমারে ছাইড়া দেন। এমন কাম রে উষ্টা মারি।’
আমি বুঝলাম, সাড়ে সর্বনাশ! মর্জিনা চলে গেলে ওর অনেক কাজ আমার ঘাড়ে এসে উঠবে। তা ছাড়া বউ উঠতে–বসতে খোঁটা দেবে—তোমার জন্যই বাসায় কাজের মেয়ে থাকে না! শায়লা ভাবিও আমাকে দায়ী করবে। তাদের এই সুযোগ কিছুতেই দেওয়া যাবে না।
আমি এগিয়ে গিয়ে মর্জিনার সামনে দাঁড়ালাম। মিনতি ভরা গলায় বললাম, ‘মর্জিনা, আমার ভুল হইছে। এই ভুল আর করব না। আমাকে ক্ষমা করে দাও।’
মর্জিনা হেঁচকি তুলে বলল, ‘আমরা গরিব বইলা কতায় কতায় অপমান করে। আমরা মানুষ না? আমাগো সম্মান নাই?’
বুঝলাম সে কান্নার অভিনয় করছে। কিন্তু অভিনয় ভালো হচ্ছে না। আমি খুবই বিনয়ী হয়ে বললাম, ‘মর্জিনা, তোমাকে ছোট বোন হিসেবে দেখি। আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? কাজটা ঠিক হবে? অবশ্যই তোমরা সম্মানিত মানুষ। আমি কথা দিলাম, আমাদের বংশের কেউ তোমাকে আর জীবনে অপমান করে কথা বলবে না।’
এবার মর্জিনা হেসে ফেলল, ‘এসব কী কন ভাইজান? আপনে আমাগো বড় ভাই না? আমি তো জানি, আপনে কত ভালো মানুষ!’
তার কথা শুনে বুক থেকে যেন একটা পাথর নেমে গেল।