যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকেরা মানুষের মুক্তির সংগ্রামে অমূল্য ভূমিকা পালন করেছেন। বিশেষ করে স্বাধীনতা, মানবাধিকার, সামাজিক বৈষম্য এবং শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে তাঁদের রচিত কবিতা ও গানগুলো জনগণের মনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। যখন জাতি শাসকগোষ্ঠীর হাতে নির্যাতিত হয়েছে, তখনই কবি-সাহিত্যিকেরা কলম ও কণ্ঠের মাধ্যমে প্রতিবাদ–প্রতিরোধের এক শক্তিশালী ভাষা সৃষ্টি করে সংগ্রামী চেতনাকে জাগিয়ে তুলেছেন।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতাসংগ্রাম, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সময় কবি-সাহিত্যিকেরা নিজেদের সৃষ্টি দিয়ে শোষিত জনগণকে সাহস জুগিয়েছেন। তাঁদের গান ও কবিতা ছিল নীরব বিপ্লবের মন্ত্র, যা মানুষের মনোবলকে উদ্বুদ্ধ করে সংগ্রামের আগুন জ্বালিয়েছিল। শোষিত মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিল তাঁদের লেখা, জাতিকে দেখিয়েছে এক নতুন দিশা।
বিপ্লবী কবিদের কবিতা ও গানে প্রতিধ্বনিত হয়েছে মানুষের লড়াই, বিরোধিতা, প্রতিবাদ ও পুনর্গঠনের এক শাশ্বত আহ্বান।
১৭৪১ সাল, সম্রাট আলিবর্দি খাঁর যুগ। খাঁ সাহেবের রাজত্বে বাংলার মানুষের অভাব হয়তো ছিল, কিন্তু অশান্তি ছিল না। একদিন হঠাৎ করেই বাংলার আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা! কথা নেই বার্তা নেই, একদল লুটেরার উৎপাত শুরু হয়ে গেল মুর্শিদাবাদের গ্রামগুলোতে। রাতের আঁধারে একদল লোক ঘোড়া টগবগিয়ে হানা দিতে থাকল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে থাকল, লোকজনকে মেরেধরে সবকিছু কেড়ে নিতে থাকল। দোকানপাট সব তাদের অত্যাচারে বন্ধ হয়ে গেল, মানুষজন ভয়ে ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিল। শান্ত বাংলা যেন হঠাৎ করেই আতঙ্কের বাংলা হয়ে উঠল।
এই দুর্বৃত্তরাই এখনকার বিখ্যাত ছড়াগানের সেই বর্গি।
আসলে পর্তুগিজ বর্গি হলো পঞ্চদশ শতাব্দীর লুটতরাজপ্রিয় অশ্বারোহী মারাঠা সৈন্যদলের নাম। হাতে তাদের থাকত তীক্ষ্ণফলা বর্শা। মারাঠাদের আসল নিবাস ভারতের মহারাষ্ট্র শহরে হলেও দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতজুড়েই তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। আলিবর্দি খাঁ যখন বাংলার সিংহাসনে, সে সময় দিল্লির দখলে ছিল মোগলরা। সে সময় এই মারাঠাদের যোদ্ধা হিসেবে নামডাক ছিল। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মোগলদের সঙ্গে মারাঠাদের ভয়ংকর যুদ্ধ হয়েছিল। মারাঠাদের কিছু পথচ্যুত সেনা একসময় পরিচিত হয়ে যায় বর্গি নামে। সারা ভারতে শুরু করে তাণ্ডব। ১৭৪২ থেকে শুরু করে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত বর্গিদের উৎপাতে মানুষ তটস্থ ছিল। ৯ বছরে যে ত্রাস তারা চালিয়েছিল, সে জন্য তাদের নামে লেখা রওশন ইজদানীর লোকগানটা পাকাপাকিভাবে ঠাঁই পেয়ে যায় ইতিহাসে।
‘খোকা ঘুমাল পাড়া জুড়াল
বর্গি এল দেশে,
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কিসে?’
গোবিন্দ হালদারের বিখ্যাত গান ‘রক্ত লাল’ দিয়ে স্বাধীনতাসংগ্রামে রক্তের ঝরনার কথা উল্লেখ করেছেন। যা লাখ লাখ মানুষের আত্মবলিদানের প্রেক্ষাপটে প্রেরণাদায়ক হয়ে ওঠে।
‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে
রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল
জোয়ার এসেছে জনসমুদ্রে
রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল।।
বাঁধন ছেঁড়ার হয়েছে কাল,
হয়েছে কাল, হয়েছে কাল।।’
‘বাঁধন ছেঁড়ার হয়েছে কাল’ অংশে লেখক স্বাধীনতা অর্জনের মুহূর্তের গুরুত্বের কথা বলেছেন। যেখানে সমাজের শৃঙ্খল ভেঙে নতুন এক যাত্রার সূচনা ঘটে। গানের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ছন্দ যেন জনগণের অন্তরে স্বাধীনতা ও প্রতিরোধের আগুন জ্বালিয়ে ইতিহাসের এক সোনালি অধ্যায়ের জন্ম দেয়।
অন্যদিকে রক্তের হরফে আগাম বিজয়ের ঘোষণা দিয়ে রাখেন বিপ্লবী তরুণ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য।
‘সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী তাকিয়ে রয়:
জ্বলে পুড়ে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়’
চল্লিশের দশকের শেষ দিকে ভবিষ্যদ্বাণীর মতো কথাগুলো উচ্চারণ করেছিলেন মার্ক্সবাদী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। দুই দশক পরে সত্তরে এসে জ্বলেপুড়ে ছারখার হওয়া বাংলাদেশের মাঠ থেকে আমরা তুলেছি স্বাধীনতার ফসল। সেই ফসল ছিল রক্তধোয়া। ৩০ লাখ শহীদের খুনরাঙা ছিল আমাদের মাঠের সেই ধান। তাঁর কবিতাগুলো স্বাধীনতার জন্য একটি মিছিলকারী আর্তনাদ ও জনসাধারণের মধ্যে প্রতিরোধের চেতনা জাগিয়ে তোলে।
‘দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল বাংলাদেশের প্রাণ
কেন ঘরে ঘরে গড়ে উঠল এত রণাঙ্গন?
কেন এত রক্ত বিসর্জন?’
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী চেতনায় সমাজের দমন-পীড়ন এবং শোষণব্যবস্থার বিরুদ্ধে জেগে ওঠার জন্য সাহস জুগিয়েছেন। কবিতার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বিদ্রোহী মনোভাব এবং স্বাধীনতার পিপাসা তৈরি করেছেন।
‘লাথি মার, ভাঙরে তালা! যত সব বন্দিশালায়–
আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা, ফেল্ উপাড়ি।।’
‘লাথি মার, ভাঙরে তালা! যত সব বন্দিশালায়’ পঙ্ক্তিতে কবি শোষণ, অবিচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন। বন্দী শৃঙ্খলা ভেঙে, চিরকালীন কষ্ট এবং অসত্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে তিনি এক শক্তিশালী আহ্বান জানিয়েছেন। ‘আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা, ফেল্ উপাড়ি’—কবি প্রতিরোধের আগুনে পুরোনো সব কাঠামো ও অসত্যকে ধ্বংস করে নতুন একটি সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখিয়েছেন।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য ঘষেটি বেগম ও মীর জাফরদের ষড়যন্ত্রের ফলে অস্তমিত হয়ে যায়। বিপ্লবী কবি ফররুখ আহমদ দেখেছেন ইংরেজ বেনিয়াদের শাসন ও শোষণের অবস্থা। দেশবাসীর জন্য স্বাধীনতা ছাড়া মুক্তি নেই। আরও উপলব্ধি করেছেন, দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানের জন্য সুযোগ্য নেতা প্রয়োজন। যে নেতা কোটি কোটি মজলুম মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারবেন। তিনিই হলেন কবির কল্পনায় সৃষ্ট আদর্শ মহানায়ক পাঞ্জেরী। এক রূপক কবিতার মাধ্যমে তিনি প্রকাশ করলেন—
‘জাগো বন্দরে কৈফিয়তের তীব্র ভ্রুকুটি হেরি
জাগো অগনন ক্ষুধিত মুখের নীরব ভ্রুকুটি হেরি
দেখো চেয়ে দেখো সূর্য উঠার কত দেরি, কত দেরি।’
কবির মনে প্রশ্ন—
‘রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরী?...
ঘরে ঘরে ওঠে ক্রন্দনধ্বনি আওয়াজ শুনছি তারি।
ওকি বাতাসের হাহাকার, ওকি
রোনাজারি ক্ষুধিতের!
ওকি দরিয়ার গর্জন, ওকি বেদনা মজলুমের!
ওকি ধাতুর পাঁজরায় বাজে মৃত্যুর জয়ভেরী!
পাঞ্জেরী!’
সর্বশেষ চব্বিশের জুলাই আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী কবি মাহমুদুল হাসান নিজামী ‘দিল্লি না ঢাকা’ শিরোনামের কবিতা লেখেন। পরবর্তী সময়ে সেটি গণস্লোগানে পরিণত হয়।
‘দিল্লির স্বার্থটাই হেফাজতে রাখা
কোথা আছি বুঝা দায় দিল্লি না ঢাকা’
বিপ্লবী কবিদের কবিতা ও গানে প্রতিধ্বনিত হয়েছে মানুষের লড়াই, বিরোধিতা, প্রতিবাদ ও পুনর্গঠনের এক শাশ্বত আহ্বান। তাঁদের কবিতা ও গান আজও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অংশ এবং এগুলো আগামীর সংগ্রামীদের কাছে অমূল্য দিশা হিসেবে জীবিত থাকবে।
তারাগঞ্জ, রংপুর