লন্ঠনের মতো হ্যালোজেনের হলুদাভ বাতি জ্বালিয়ে ট্রেন ছুটে চলেছে আপন গন্তব্যে। কেউ কেউ নিজ স্বপ্ন কোনো এক কামরায় তুলে নিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যের অপেক্ষায়। রেলগাড়ি গতিপথ পরিবর্তন না করলেও মানুষ তার জীবনের গতিপথ প্রায়ই পাল্টায়।
কুয়াশাচ্ছন্ন মধ্যরাতে গায়ে চাদর জড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে দৃশ্যখানি উপভোগ করছি। শীতের রাতে ট্রেন জার্নি! শেষ কবে যে ট্রেনে চেপেছিলাম, মনে পড়ে না। ইচ্ছাও করছিল বেশ! ট্রেনটা মুহূর্তেই চলে গেল। গেটম্যান গেট খুলে দিল। আমি আবার গাড়িতে বসলাম। কিছুদূর যেতেই গাড়িটা বিকট শব্দ করে থেমে গেল। ইঞ্জিন থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে।
এখন সারা রাত আমাকে এই অন্ধকারে কাটিয়ে দিতে হবে! এত রাতে মানুষের কথা বাদই দিলাম, একটা কুকুর-বিড়ালও দেখা যাচ্ছে না। তার মধ্যে আবার শীতকাল। মনে পড়ল ট্রেনের কথা। কাছেপিঠে কোথাও স্টেশন আছে হয়তো। ড্রাইভারকে বললাম, গাড়ি ঠিক হলে ফোন করতে। আমি মুঠোফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে রেললাইনের পাশ দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। কিছুদূর যেতেই সাদা সাইনবোর্ডে চোখে পড়ল ‘পাটগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন’।
স্টেশন একেবারে জনমানবশূন্য। এই শীতের রাতে প্রয়োজন ছাড়া মানুষ থাকার কথাও নয়। স্টেশন মাস্টারের কক্ষে গিয়ে দেখলাম, তিনি ঝিমুচ্ছেন। একবার গলা ঝাড়ি দিতেই মাথা তুলে জিজ্ঞেস করলেন, কে? ‘আমি সন্তু। ব্যবসার কাজে বুড়িমারী যাচ্ছিলাম। রাস্তায় হঠাৎ গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেল। তা মশাই, এখন কোনো ট্রেন আছে বুড়িমারীগামী?’ জানালেন, আছে। তবে রাত বারোটায়। ততক্ষণ প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করতে হবে।
স্টেশনের বেঞ্চে গিয়ে গুটিসুটি মেরে হেলান দিয়ে বসলাম। কখন যে ঘুমিয়ে গেছি, খেয়াল নেই। ঘুম থেকে উঠে ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি, ভোররাত চারটা। কখন ট্রেন এসেছিল আবার চলেও গেছে, বুঝতেই পারিনি। ঘণ্টাখানেক এদিক–সেদিক পায়চারি করতে করতে হঠাৎ ট্রেনের হুইসেলের শব্দ কানে ভেসে এল। রাত প্রায় শেষ। ট্রেন এসে স্টেশনে দাঁড়ায়। লোকাল ট্রেন। ভেতরে গিয়ে দেখি, আলো নেভানো। স্টেশন থেকে খানিকটা আলো আসছে; কামরা পুরোটা খালি। কেবল সামনের বেঞ্চে কে যেন বসে আছেন। কিছুটা বিস্মিত হলাম!
ভাবলাম, তাঁর সঙ্গে গল্প করে সময় কাটিয়ে দেওয়া যাবে। সামনে গিয়ে বসলাম। ভেবেছিলাম কোনো পুরুষ হবে, কিন্তু এ তো চল্লিশোর্ধ্বো মহিলা। পাশে বছর ছয়েকের ছেলে। ভদ্রমহিলার কপাল পর্যন্ত ঘোমটা, পরনে কুঁচিদেওয়া শাড়ি। আমি বেশ অবাক হলাম। একে তো কামরায় মাত্র দুজন, আবার এই শীতে ভোর চারটায় ভদ্রমহিলার উপস্থিতি! হয়তো জরুরি কোনো প্রয়োজনে এত ভোরে রওনা দিয়েছেন। কেননা, শুধু শাড়ি পরে এত ঠান্ডায় কারও বের হওয়ার কথা নয়।
আমার উপস্থিতিতে তাঁর চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ দেখতে পেলাম। তাই একদম পেছনের সিটে গিয়ে বসি। কেন জানি না, আমার বেশ ভয় লাগছে। আচমকাই দেখি আমার পেছনে ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে। গায়ে হিমশীতল মৃদু হাওয়া বয়ে গেল! তিনি কর্কশ কণ্ঠে বললেন, একটু পানি হবে?
ট্রেন ছুটছে। মহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম! মনে হচ্ছে, আমার সামনে একটা ছায়ামূর্তির অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে! ততক্ষণে ঘামতে শুরু করেছি। বললাম, ‘সামনের স্টেশনে গাড়ি দাঁড়ালে পানি নিয়েন।’ আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি বললেন, এই গাড়ি আর কখনো দাঁড়াবে না।
মহিলার কথা শেষ না হতেই হঠাৎ ট্রেন থেমে গেল। গন্তব্যে পৌঁছে গেছি ভেবে তাড়াহুড়া করে নেমে পড়লাম। কিন্তু একি; এখানে যে কোনো স্টেশন নেই! চারদিকে কালো ঘন অন্ধকার আর কুয়াশার ছায়া। মুহূর্তের মধ্যেই ট্রেন থেকে চারদিকে হইচই শুরু হলো! মিলিটারিদের ব্রাশফায়ারের গুলির মতো এলোপাতাড়ি বিকট শব্দ ভেসে আসছে! তাড়াহুড়া করে আবার ট্রেনে উঠে পড়লাম। কিন্তু ভেতরে যে সব ঠিক! তবে ভদ্রমহিলা সেখানে নেই! শুধু বাচ্চাটা বসে আছে! আমার উপস্থিতি টের পেয়ে ‘বাপজান’ বলে সে দৌড়ে এল। আমার দিকে তাকিয়েই একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘আমার বাপজান কই? কবে আইব? তুমি বাপজানের খবর কইতে পার?’
আমি বললাম, ‘কে তোমার বাপজান? তাঁর নাম কী বাবু?’ সে বলতে লাগল, ‘আমার বাপজান যুদ্ধে গেছে। বাপজান কইছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হইলে ট্রেনে কইরা ফিরব। পাঞ্জাবি মিলিটারিরা আম্মারে মাইরা ফালাইছে। আচ্ছা কাকু, বাংলাদেশ কবে স্বাধীন হইব?’ মনে মনে ভাবলাম, বাচ্চাটা হয়তো পাগল। বললাম, ‘বাংলাদেশ তো অনেক আগেই স্বাধীন হয়েছে।’ হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে দেখলাম ড্রাইভারের নম্বর। কলটা কেটে দিয়ে সামনে তাকাতেই গা শিউরে উঠল। কামরায় মা-ছেলে কেউই নেই, পুরো খালি। চলন্ত ট্রেন থেকে মুহূর্তের মধ্যে উধাও! পেছনে ঘুরতেই আবার সেই কণ্ঠ, ‘কও না, আমার আব্বাজান কবে আইব?’
এবার আমার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার মতো উপক্রম। সেই ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। পুরো শরীর ঘামে ভেজা, শরীর থেকে কেমন যেন একধরনের মাংসপচা গন্ধ বেরোচ্ছে। মুঠোফোনের স্ক্রিনের মৃদু আলোয় দেখলাম, তার কপালে গুলিবিদ্ধ ক্ষতচিহ্ন। মুখটাও থেঁতলে আছে। মনে হচ্ছে, কেউ বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে থেঁতলে দিয়েছে।
আমার সারা শরীরে বিদ্যুৎ বয়ে গেল। প্রচণ্ড ঘামতে শুরু করলাম, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। একপর্যায়ে স্নায়ুতন্ত্রই যেন কাজ করা বন্ধ করে দিল। জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।
পরদিন সকালের আলোয় ঘুম ভাঙতেই দেখি, বুড়িমারী জংশনের পুলিশ ফাঁড়িতে শুয়ে আছি। চারপাশে অসংখ্য মানুষ। প্ল্যাটফর্মে অচেতন অবস্থায় তারা আমাকে উদ্ধার করেছে। জিজ্ঞেস করতেই রাতের ঘটনা খুলে বললাম। সেখানে একজন মুক্তিযোদ্ধা উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, আমার ভাগ্য ভালো যে ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে’ কথাটি বলেছি। না হলে আজ হয়তো বেঁচে ফিরতাম না। ঘটনাটি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘ওটা বাকী ভাইয়ের ছেলে। একটাই ছেলে। আমরা একাত্তরের জুন মাসে ট্রেনিংয়ে যাওয়ার সময় বাকী ভাই তাঁর ছেলেকে বলেছিলেন, দেশ স্বাধীন করে সকালবেলা ট্রেনে করে ফিরে আসবেন। বাকী ভাই তো মাসখানেক পরই মাইন বিস্ফোরণে শহীদ হন। কিন্তু তার বাচ্চাটি প্রতিদিন স্টেশনে দাঁড়িয়ে বাবার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। পাকিস্তানি মিলিটারিরা ছোট বাচ্চাটিকেও ছাড়েনি। গুলি করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছে।’
হয়তো ছেলেটি আজও অপেক্ষায় থাকে। তার পিতার অপেক্ষায়। আর কেউ কেউ শেষ ট্রেনের অপেক্ষায় থাকেন, কষ্টগুলো তুলে নিতে কোনো এক কামরায়!
বগুড়া, বাংলাদেশ