ফুফু এবং আমার ছেলেবেলা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কিছু সম্পর্কের বিশ্লেষণ দুই বা এক শব্দে করা যায় না; কিংবা বিশ্লেষণ করার জন্য যথাযথ শব্দও আমাদের ঝুলিতে থাকে না। কিছু সম্পর্ক বড়-ছোটর হিসাব কষে চলে না। ফুফুর সঙ্গে আমার সম্পর্কটাও তেমন। এখানে নেই ছোট-বড় দেয়াল, নেই গুটিকয় শব্দের সীমাবদ্ধতা। মানুষটা একাধারে আমার ফুফু, আমার বন্ধু ও সেই সঙ্গে আমার অভিভাবক।

আমার জীবনের সোনালি মুহূর্তগুলো কেটেছে এই মানুষটার সঙ্গে। শৈশবের কতশত স্মৃতি জড়িয়ে আছে তাকে কেন্দ্র করে—ডুবসাঁতার, মাছধরা, চড়ুইভাতি, অন্যের বাগানের ফল পেড়ে খাওয়া,  ফুল তুলে আনা, গাছে ওঠা, ঘুড়ি ওড়ানোসহ আরও কত কী! ফুফু না থাকলে শৈশব এত সুন্দর হতো না, হতো না এত আমোদে শৈশবকে উপভোগ করা।

মা অসুস্থ থাকার কারণে অধিকাংশ সময় নানাবাড়ি থাকতেন। পড়াশোনার কারণে আমাকে দাদাবাড়িতে থাকতে হতো। দাদাবাড়ি আমার কাছাকাছি বয়সের কেউ না থাকায় বন্ধু বলতে ফুফুই ছিল সবকিছু। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধান আমাদের মধ্যে; কিন্তু আমি বা ফুফু কারও মাথায়ই সেটা আসেনি কোনো দিন। নির্দ্বিধায় ফুফুকে নাম ধরে তুই সম্বোধনে ডাকতাম—এটা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা না থাকলেও প্রথম প্রথম পরিবারের লোকজন ভীষণ আপত্তি করত। দুজনকে বলে দেওয়া হয়েছিল, আমি তাকে নাম ধরে ডাকলে আমার শাস্তি হবে আর আমার ডাকে সে সাড়া দিলে তার শাস্তি হবে; কিন্তু কে শোনে কার কথা! আমরা আমাদের মতোই চলতাম-বলতাম। পরে অবশ্য পরিবারের লোকজন বুঝতে পেরেছিল আমরা শুধরানোর নই। তাই শাস্তিও তুলে দেওয়া হয়েছিল।

শৈশবের পুরোটা সময় ফুফু পাশে ছিল—বন্ধু, কখনো ফুফু আবার কখনো অভিভাবক হয়ে। ফুফুর সঙ্গে শুধু আমারই এমন সম্পর্ক ছিল, তা কিন্তু নয়; আমরা চাচাতো-ফুফাতো সব ভাইবোন ফুফুকে চোখে হারাতাম। ফুফুও আমাদের অভিভাবকের মতো আগলে রেখে দিনমান আনন্দে মাতিয়ে রাখত। মনে পড়ে, একদিন আমি আর ছোট ভাই ফুফুর সঙ্গে বাড়ির পাশের নদীতে গোসল করতে যাই। ফুফু তার অন্য খেলার সাথিদের সঙ্গে নদীর তীরে বালু দিয়ে ঘর বানাচ্ছিল। কিছুটা দূরে আমরা দুই ভাই হাঁটুপানিতে নেমে জলকেলি করছিলাম, ঝাঁপাঝাঁপি করার সময় হঠাৎ আমার ভাই কিছুটা গভীর পানির দিকে চলে যায়। তাকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে গিয়ে দুই ভাই গলাগলি ধরে গভীর পানির দিকে চলে যেতে থাকি, স্রোতের তোড়ে পায়ের নিচ থেকে বালু সরে গিয়ে বুক থেকে পানি চলে আসে প্রায় নাকের কাছাকাছি। ফুফুকে চিৎকার দিয়ে ডাকার চেষ্টা করছি, কিন্তু মুখের ভেতর পানি ঢুকে শব্দ হচ্ছে না খুব একটা। ফুফু আমাদের ডাক শুনতে পাচ্ছে না; কিন্তু আমি খুব করে চাইছি ফুফু পেছন ফিরে তাকাক। সে পেছনে তাকালেই আমরা বেঁচে যাব। যখন প্রায় একেবারেই ডুবে যাচ্ছি, পানি আমাদের চোখ পর্যন্ত চলে এসেছে, ঠিক সেই মুহূর্তে ফুফু কী ভেবে পেছনে তাকাল আর বাজপাখির মতো উড়ে এসে ছোঁ মেরে আমাদের তুলে নিল পানি থেকে। তার ছত্রচ্ছায়ায় বেশ কেটে যাচ্ছিল সকাল, সন্ধ্যা, রাত। কিন্তু হঠাৎ করে একদিন ফুফু আমাদের জীবন থেকে অনেক দূরে হারিয়ে যায়...।

এর মধ্যে কত কিছুর পরিবর্তন! কত চেনা মুখ পাড়ি জমিয়েছে দূর আকাশে, কত বাগান কেটে বানানো হয়েছে বাসস্থান, কত গাছ হয়ে গেছে ঘরের ফার্নিচার, কত মাঠ চলে গেছে বাউন্ডারির ভেতরে, ঘুড়ি ওড়ানোর জায়গাগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে ড্রেজার মেশিন। আমার সব শৈশব যখন তার হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে, স্মৃতিপটে ধূসর হয়ে যাচ্ছে অবয়ব, ঠিক এই সময় হঠাৎ এক যুগ পর ফুফুর সঙ্গে আবার দেখা!

এত দিন পর ফুফুকে দেখে আমার অথর্ব হয়ে যাওয়ার উপক্রম। দৌড়ে এসে সে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমার হাত-পা কাঁপছে—একবার আপনি বলছি, একবার তুমি আর একবার তুই। সব গুলিয়ে যাচ্ছে। সেদিনের পর থেকে আমি আবার আমার শৈশবকে খুঁজে পাচ্ছি প্রতিনিয়ত। ফুফু আমার হারিয়ে যাওয়া শৈশবকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এসেছে।

বনশ্রী, ঢাকা