বদরুদ্দীন উমরের ভাবনায় নজরুল

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামছবি: সংগৃহীত
নজরুল ইসলামের কবিতা পাঠ করে ও গান শুনে লক্ষ লক্ষ মানুষ মনে করত নজরুল ইসলাম তাঁদের কথাই লিখেছেন।

শোষণ-নিপীড়ন-বঞ্চনা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের দুই মহান পুরুষ কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও লেখক বদরুদ্দীন উমর। দুজনের জন্ম অবিভক্ত বাংলার রাঢ় অঞ্চলের বর্ধমান জেলায়। প্রথমজন সাহিত্যিক, মূলত কবি। আর দ্বিতীয়জন তাত্ত্বিক, গবেষক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার। দুজনই চেয়েছেন বাঙালি সংস্কৃতির প্রগতিশীল বিকাশ ও রূপান্তর। নজরুল অখণ্ড মানবিকতায় বিশ্বাসী ভাবুক-কবি, অন্যদিকে বদরুদ্দীন উমর সর্বতোভাবে মার্ক্সসবাদী তাত্ত্বিক।

নজরুলের জন্ম বর্ধমানের চুরুলিয়া গ্রামের এক ক্ষয়িষ্ণু মুসলিম পরিবারে। মাত্র ৯ বছর বয়সে তিনি তাঁর বাবা ফকির আহমেদকে হারান। বাবার মৃত্যুতে নজরুলের জীবনে ঘটে চরম ছন্দপতন। বৈরী পরিবেশ ও পারিবারিক প্রতিকূলতার কারণে এন্ট্রান্স পাসের আগেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ছেদ পড়ে। জীবিকা হিসেবে বেছে নেন মোল্লাগিরি, মসজিদে ইমামতি, কখনো রুটির দোকানের কাজ। অপরজনের জন্ম ১৯৩১ সালে বর্ধমান শহরের শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। বদরুদ্দীন উমরের বাবা আবুল হাশিম ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের অন্যতম পুরোধা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, অখণ্ড বাংলা গড়ার অন্যতম চিন্তানায়ক ও স্বপ্নদ্রষ্টা। মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের প্রধান সংগঠক ছিলেন তিনি। পিতামহ আবুল কাশেম বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল। সাম্প্রদায়িকতার কারণে ১৯৫০ সালে বদরুদ্দীন উমর সপরিবার ঢাকায় চলে আসেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। বদরুদ্দীন উমর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে এমএ পাস করেন। ১৯৫৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ইতিপূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬১ সালে অক্সফোর্ড থেকে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি তিন বিষয়ে অনার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ষাটের দশকে প্রকাশিত তাঁর সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৬), সংস্কৃতির সংকট (১৯৬৭) ও সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৯) গ্রন্থত্রয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে অনন্য ভূমিকা পালন করে। এসব লেখা ‘বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে’ পথ দেখিয়েছে, মুসলমান বাঙালিকে রূপান্তরিত করেছে মৃত্তিকালগ্ন বাঙালি মুসলমানে।

নজরুল ও উমরের জীবনচর্যা, সংস্কৃতিবোধ ও লেখার পদ্ধতি ও ফর্মের মধ্যে যেমন বিস্তর মিল আছে, তেমনি অমিলও খুঁজে পাওয়া যায় ভূরি ভূরি। দুজনই পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল, অর্গানিক বুদ্ধিজীবী। দুজনই সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ, শোষক–নিপীড়ক, জুলুমবাজদের দুশমন। নজরুল তাঁর গান-কবিতা-উপন্যাসকে পরিণত করেছিলেন সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের শাণিত হাতিয়ারে; অপর দিকে উমর কেবল লেখালেখির মধ্যে সীমিত থাকেননি, সমাজের বিপ্লবী রূপান্তর ও মানবমুক্তির সংগ্রাম ত্বরান্বিত করতে নিজেকে বিস্তৃত করেছেন, যুক্ত করেছেন সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে। কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য ‘বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশন’ এবং প্রগতিশীল সংস্কৃতিচর্চা ও বিকাশের জন্য ‘বাংলাদেশ লেখক শিবির’ প্রতিষ্ঠা করেন।

নজরুল কবিতা রচনা এবং সাহিত্যচর্চার জন্য কারারুদ্ধ হয়েছেন, ব্রিটিশ রাজশক্তির রোষানলে পড়েছেন। ষাটের দশকে বাঙালি সংস্কৃতির প্রগতিশীল বিকাশের জন্য ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’ নিয়ে লিখতে গিয়ে বদরুদ্দীন উমর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়েন। বাধ্য হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার কাজে ইস্তফা দেন এবং যুক্ত হন সক্রিয় রাজনীতিতে। বেছে নিয়েছেন সার্বক্ষণিক লেখক-জীবন, রাজনীতির প্রয়োজনে নিয়মিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা করছেন। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৬০-এর বেশি। প্রকাশিত, কিন্তু অগ্রন্থিত প্রবন্ধের সংখ্যাও অজস্র। এই মার্ক্সসবাদী তাত্ত্বিকের স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ আমাদের সময়কার জীবন–এর পাঠ শেষ করলাম কদিন আগে। এ গ্রন্থে তিনি শেরেবাংলা ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, শেখ মুজিবুর রহমান, জাহানারা ইমাম, গোবিন্দচন্দ্র দেব, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আহমদ শরীফ, আরজ আলী মাতুব্বর, কলকাতার প্রখ্যাত লেখক-বুদ্ধিজীবী হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, বিপ্লবী সুখেন্দু দস্তিদার প্রমুখ সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করেছেন। এঁদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথাও উল্লেখ করেছেন। কবি বিষ্ণু দে, সমর সেন, নাট্যকার ও অভিনেতা উৎপল দত্ত প্রমুখের প্রসঙ্গ এসেছে, কিন্তু নজরুলকে পেলাম না। তবে বইয়ের এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘নজরুল ইসলামের কবিতা পাঠ করে ও গান শুনে লক্ষ লক্ষ মানুষ মনে করত নজরুল ইসলাম তাঁদের কথাই লিখেছেন। (আমাদের সময়কার জীবন, পৃষ্ঠা: ১৪)।

বদরুদ্দীন উমর
ফাইল ছবি

বাঙালির নাড়ির স্পন্দন ও মনের কথা বুঝতেন বলেই এত সব রাজনৈতিক উত্থান-পতনের পরও বাঙালির স্মৃতি থেকে নজরুল বিস্মৃত হয়নি। মৃত্যুর এত বছর পার হয়েছে, তারপরও তিনি বাঙালির জীবন থেকে, সশ্রদ্ধ দূরত্বের ফ্রেমে বন্দী হয়ে যাননি। বাঙালি তাঁকে গভীরভাবে মনে রেখেছে, প্রদান করেছে জাতীয় কবির স্বীকৃতি। তবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির অভিধা ছাপিয়ে জেগে আছে তাঁর প্রতি কবিতানুরাগী, দেশপ্রেমী, সংগীতপিপাসু বাঙালির অকুণ্ঠ ভালোবাসা। তাঁর সৃজনস্পর্শে সমকাল যেমন মথিত ও উদ্বেলিত হয়েছে, একইভাবে চার দশকের নির্বাকপর্ব এবং প্রয়াণের ৫০ বছর পেরিয়েছে; তারপরও তাঁকে জানার আগ্রহ ফুরায়নি। নজরুলের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে মূল্যায়নধর্মী প্রবন্ধ-নিবন্ধ, গ্রন্থ নেহাত কম রচিত হয়নি। ঘনিষ্ঠজনদের স্মৃতিচারণার সূত্রেও উঠে এসেছে অনেক কিছু। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে কমরেড মুজফ্‌ফর আহমদ রচনা করেন ‘কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’ নামের এক মহামূল্যবান আকরগ্রন্থ। বদরুদ্দীন উমরও তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধে নজরুল সাহিত্য সম্পর্কে ইতিবাচক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। উমর স্যারকে মুঠোফোনে জিজ্ঞেস করলাম, নজরুল ও আপনি বর্ধমানের মানুষ। নজরুল মূলত বিশ শতকের প্রথমার্ধের কবি, আর আপনার জন্ম বিশ শতকের ত্রিশের দশকে। আপনার কি নজরুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে? তিনি বললেন, না। ইচ্ছে থাকলেও বয়োস্বল্পতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। আরও স্বীকার করলেন, তাঁর বাবা আবুল হাশিমের সঙ্গেও নজরুলের তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু নজরুল-সাহিত্যের প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ রয়েছে।

২.
বুদ্ধদেব বসুকে দোহাই দিয়ে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ হলেন বাংলা সাহিত্যের বটবৃক্ষ। বটবৃক্ষের ছায়ার নিচে সাধারণত অন্য কোনো বৃক্ষ জন্মায় না। তেমনি রবীন্দ্রনাথের দোর্দণ্ড প্রতাপে কয়েক দশক বাংলা সাহিত্যে কোনো প্রতিভাবানের জন্ম হয়নি। তারপরও বটবৃক্ষের ছায়ার নিচে বিপুল শক্তি ও সম্ভাবনা নিয়ে বাংলা সাহিত্যের রঙ্গমঞ্চে নজরুলের মতো বিস্ময়কর প্রতিভার অভ্যুদয় হয়। তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। জনমানুষের মনের ভাষা বুঝতেন তিনি এবং সেই ভাষায় দুহাত উজাড় করে লিখতে পারতেন। শোষণ, নিপীড়ন, অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁর কলম সব সময় সরব ও সক্রিয় ছিল।

বদরুদ্দীন উমর মার্ক্সসবাদী তাত্ত্বিক, তারপরও নজরুল ইসলামকে প্রগতিশীল ধারার সাহিত্যিক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘নজরুল ইসলাম সাহিত্যিক হিসেবে প্রগতিশীল হলেও কোনো নির্দিষ্ট জীবনদর্শনের মধ্যে ধরা দেননি। অর্থাৎ তিনি তাঁর চিন্তার মধ্যে তেমন কোনো শৃঙ্খলা কোনো দিন আনতে পারেননি অথবা চেষ্টাও করেননি।’ (নজরুল ইসলাম অহিফেন, সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা)। উমরের মনে হয়েছে, নজরুল প্রগতিশীল হলেও মার্ক্সীয় সাম্যবাদের অনুগামী ছিলেন না, তাঁর সাম্যবাদী ধারণার মধ্যে ভ্রান্তি ছিল। তারপরও বলা চলে, তিনি মানুষের কবি ছিলেন, সারা জীবন বৃহত্তর জনমানুষের কথা বলেছেন হৃদয় দিয়ে। শ্রেণিগত বিবেচনায় তিনি বাংলা তথা ভারতবর্ষের বিশাল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করেছেন। এ অনুভব থেকেই তাঁর মানবিকতা, প্রগতিশীলতা ও স্বাদেশিকতার উৎপত্তি। তাঁর জীবনচর্যা, সাহিত্য-ভাবনা, কর্মপ্রয়াস—সবকিছুই মানুষের প্রতি একাত্মতা বোধ থেকে উৎসারিত।

নজরুলের সৃজনকর্মের দিকে তাকিয়ে উমর বলেছেন, নজরুল যে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন, সেখানে হিন্দু-মুসলমান ফারাক নেই। এ সাহিত্যে হিন্দুর যতখানি অধিকার, মুসলমানের অধিকারও ঠিক ততখানি। এদিক দিয়ে বিবেচনা করলে বলা চলে যে নজরুল ইসলামই একমাত্র সাহিত্যিক, যিনি বাঙালি সংস্কৃতিকে আত্মসাৎ করেছিলেন সম্পূর্ণরূপে। (নজরুল ইসলাম অহিফেন, সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা)। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের সঙ্গে নজরুলের পৃথকতা থাকলেও বাঙালিত্ব, মানবিকতা ও অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে নজরুল ছিলেন অতুলনীয় এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

নজরুলের জীবনচর্যা ও সৃষ্টিবিশ্বের সবখানে রয়েছে কেবল সমন্বয় ও সম্প্রীতি ভাবনার উজ্জ্বল উপস্থিতি। তিনি তাবৎ ধর্মের অন্তর্নিহিত নির্যাস গভীরভাবে আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন বলেই বাঙালির প্রাণের কবি হতে পেরেছিলেন।

৩.
নজরুল সাহিত্যের সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা ভালোভাবেই জানেন, তিনি হিন্দুপুরাণ ও ঐতিহ্য গান-কবিতা রচনা করেছেন, ইসলামি ঐতিহ্যের আলোকেও সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। তাই হিন্দু-মুসলমানকে একসূত্রে গাঁথার অভিপ্রায়ে তিনি গানে গানে উচ্চারণ করেছেন মিলন ও মানবিক সম্প্রীতির বাণী: ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান/ মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।’

নজরুলের জীবনচর্যা ও সৃষ্টিবিশ্বের সবখানে রয়েছে কেবল সমন্বয় ও সম্প্রীতি ভাবনার উজ্জ্বল উপস্থিতি। তিনি তাবৎ ধর্মের অন্তর্নিহিত নির্যাস গভীরভাবে আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন বলেই বাঙালির প্রাণের কবি হতে পেরেছিলেন। ধর্মান্ধতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার মধ্যে বাস করেও তিনি লড়াই করেছেন সাম্প্রদায়িকতা, সংকীর্ণতা এবং অমানবিকতার গাঢ় অন্ধকারের বিরূদ্ধে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় নজরুল যে অভেদ সুন্দর, সাম্য প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন, তা থেকে তিনি বিচ্যুত হননি আমৃত্যু।

৪.
নতুন ধাঁচের সংগীত ও তাতে সুরারোপের ক্ষেত্রে নজরুল অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। নজরুলের সংগীত সাধনা সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে কাজী মোতাহার হোসেন বলেন, ‘১৯২৭ সালে সাহিত্য-সম্মেলনে আমি যখন “সংগীতচর্চায় মুসলমান” শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করছিলাম, তখন আমার প্রবন্ধ শুনে মোল্লা সম্প্রদায়ের মুখ থেকে যে উক্তি বেরিয়েছিল সে হলো—“ও বাব্বাহ! দাড়ির মধ্যেও কুফরি?” আর নজরুলের গান শুনে যে উক্তি বেরিয়েছিল, তা হলো, “বা! বা! কী সুন্দর ইসলামি গান—ঠিক যেন গজল!”...শাহি দরবারের সানাই, রূপ-ওয়ালির নূপুর-ঝঙ্কার, শিরি-ফরহাদ ও লায়লি-মজনুর মজলিসে, শরাব-সাকির উৎসবের উল্লাসে, পলাশ-অশোক থেকে উপচে-পড়া ‘ফুল-ডালি’তে হিন্দুয়ানির সামান্য গন্ধটুকু মালুম হয়নি।’

এসব উদাহরণ টেনে কেউ কেউ নজরুলকে মুসলিম সাহিত্যের প্রতিনিধি বানাতে চেয়েছেন। এ ধরনের প্রয়াস কোনো কোনো ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে। অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছে, তাহলে নজরুল কি মুসলমানদের কবি? এর উত্তর এসেছে, ‘না, কখনোই না।’  ইসলামি গান শুনে নজরুলকে নিষ্ঠাবান মুসলমান ভাবার কোনো সুযোগ নেই। ভাবলে সত্যেরই অপলাপ হবে। বদরুদ্দীন উমর বলেছেন, নজরুল হিজ মাস্টার্স ভয়েস কোম্পানির ফরমাশে কিংবা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ইসলামি গান রচনা করেছেন, কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মচর্চা ছিল না। তিনি ইসলামি গান রচনা করেছেন, তারপরও মুসলমান সমাজ তাঁকে ইসলামের খাদেম বলে মনে করেননি। বরং হিন্দুপ্রীতি ও স্বাদেশিকতার জন্য ধিক্কৃত হয়েছেন। শ্যামাসংগীত রচনা করেছেন অজস্র; কিন্তু তাঁকে কালীসাধক ভাবার কোনো অবকাশ নেই। উমর আরও বলেছেন, বৈষ্ণব সাহিত্যকে কোনোভাবেই হিন্দুর সাহিত্য বলা যায় না। এ সাহিত্যে হিন্দুধর্ম ও ইসলামি চিন্তার যে সমন্বয় সাধন হয়েছে, সেটা কোনোভাবেই সম্ভব হতো না, যদি আমাদের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সেই সমন্বয় না থাকত। বৈষ্ণব সাহিত্য যেমন বাংলা সাহিত্যের অবিভাজ্য অংশ, তেমনি নজরুলের ইসলামি গানকেও বাঙালি সংস্কৃতির মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ নেই।

বদরুদ্দীন উমর একজন আপাদমস্তক মার্ক্সসবাদী। সেই কারণে মার্ক্সসীয় দর্শনের আলোকে তিনি রাজনীতি, সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। মার্ক্সসীয় তত্ত্বের ভিত্তিতে নজরুলকে তিনি সাম্যবাদের কবি বলতে নারাজ। তাঁর মতে, নজরুল-সাহিত্যে শ্রেণিসংগ্রামের মর্মচেতনা প্রতিফলিত হয়নি। সুকান্ত ভট্টাচার্যকে তিনি শ্রেণিসংগ্রামের কবি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আর অসাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা যে অর্থে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি, সেই অর্থে তিনি নজরুলকে মহান জাতীয়তাবাদী কবি বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। হুমায়ূন আজাদ যখন নজরুলকে ‘বাংলা ভাষায় বিভ্রান্ত কুসংস্কার উদ্দীপ্ত লেখকদের প্রধান’ বলে মনে করেছেন, তখন উমর নজরুলকে মহৎ চিন্তার কবি বলে মান্য করেছেন। প্রফেসর আজাদ তাঁকে বিদ্রোহী কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। এ ক্ষেত্রে বদরুদ্দীন উমর সম্পূর্ণরূপে ব্যতিক্রমী। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পণ্ডিতেরা যখন সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি তেমন আগ্রহ দেখান না, তখন ‘হার না-মানা’ বদরুদ্দীন উমরের নজরুল-ভাবনা ও মূল্যায়ন আমাদের অনুপ্রাণিত করে।

লেখক: গবেষক ও শিক্ষাবিদ। অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত), মেহেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ, মেহেরপুর