অনেকেই বিভিন্ন সময়ে আমাকে নানা ধরনের প্রশ্ন করেন। যেমন কীভাবে গান লিখব? গানের ছকটা কীভাবে সাজাব? আমি কিছু গান লিখেছি, হয়েছে কি না, দেখবেন?
রেডিও, টেলিভিশন, অডিও অ্যালবাম ও চলচ্চিত্রে নিয়মিত গান লিখি বলেই হয়তো প্রায় সময়ই অনেকে গান বিষয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। কিন্তু এমন এমন সময় তাঁদের ফোন আসে, যখন আমি অফিসের কাজে ভীষণ ব্যস্ত। তাঁদের সময় দেওয়া আমার পক্ষে তখন অসম্ভব। এ জন্য তাঁরা হয়তো মন খারাপ করেন। কিন্তু আমি একটা নিয়মের মধ্যে চলি বলে তাঁদের মন রক্ষা করতে পারি না। যা-ই হোক, আমি গান লিখি দীর্ঘদিন। শখের বশে শুরু করেছিলাম সেই ১৯৮৭ সালে। এখন নিজেকে একজন পেশাদার গীতিকবি হিসেবে দাবি করি।
যদিও বাংলাদেশে গান লেখাটাকে পেশা হিসেবে নিয়ে জীবন যাপন করা অসম্ভব। কিন্তু আমি যেহেতু একটি চাকরি করি, এর পাশাপাশি গান লিখি, সেহেতু আমার জন্য হয়তো এটা ঠিক আছে। কিন্তু কেউ যদি প্রশ্ন করেন, শুধু গান লেখাটাকে কি পেশা হিসেবে নেওয়া যায়? আমি বলব, না। নেওয়া যায় না। এর বড় কারণ, আমাদের অডিও বাজার অত বড় নয়। চলচ্চিত্রেও সেই সুযোগ কমে গেছে। আর গান লিখে ঠিকমতো রয়্যালটিও পাওয়া যায় না। লেখার শুরুতেই এ ধরনের কথা বলছি বলে ভাববেন না, যাঁরা গান লেখায় উৎসাহী, তাঁদের থামিয়ে দিচ্ছি কি না। আসলে গান লেখাটা একটা সৃজনশীল কাজ। এটা মনের তাগিদে হবে। ভাবনার জগৎ থেকে শব্দ উঠে আসবে আপনার কলমে। পেশাদারত্বের মনোভাবটা যেন সৃজনশীলতার অন্তরায় না হয়, তাই এ কথাগুলো বলে রাখা।
অনেকেই বিভিন্ন সময়ে আমাকে নানা ধরনের প্রশ্ন করেন। যেমন কীভাবে গান লিখব? গানের ছকটা কীভাবে সাজাব? আমি কিছু গান লিখেছি, হয়েছে কি না, দেখবেন? যাঁদের মনে এ ধরনের প্রশ্ন আছে, তাঁদের জন্য এই লেখাটা কিছুটা সহায়ক হলেও হতে পারে। নিজের কথা যদি বলি, আমি গীতিকবি (লোকজন আমাকে তা-ই মনে করে। কিন্তু আমি এখনো শিখছি। এখনো ভুলভ্রান্তি হয় আমার গীতিকবিতায়) হয়ে গেছি। সৃজনশীলতার প্রকাশটাই এমন। পুঁথিগত কোনো বিদ্যা দিয়ে একজন গীতিকবি হওয়া যায় না। এটা মনের তাগিদ থেকে, চর্চায় কেবল সম্ভব।
যাহোক, যেহেতু গান লেখার আঙ্গিক বা কলাকৌশল সম্পর্কে সঠিক তথ্যটা এ লেখায় উপস্থাপন করতে চাই, তাই আমিও সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে দেশের অন্যতম গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের ‘আধুনিক বাংলা গান রচনার কলাকৌশল’ বইটিকে বেছে নিয়েছি। কারণ, কবিতা লেখার ছন্দ নিয়ে অনেক বই থাকলেও গান লেখার কলাকৌশল নিয়ে সম্ভবত এই একটি বই-ই আমার চোখে পড়েছে। বলাবাহুল্য, গানের বিষয়ে খুঁটিনাটি অনেক কিছুই আমি এই মহান ব্যক্তির কাছ থেকে জেনেছি, শিখেছি। তিনি বিভিন্ন সময় আমার অনেক ভুলও ধরিয়ে দিয়েছেন।
মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের একটি কথা আমার ভালো লাগে। তিনি বলেছেন, ‘হাজার হাজার অশুদ্ধ গান লেখার চেয়ে একটি শুদ্ধ গানের কবিতা লেখো।’
তবে আমি তাঁর পথে হাঁটতে পারিনি। পেশাদারত্বের কারণে আমাকে দুই হাতে গান লিখতে হয়েছে। আর তাতে আমার লেখা অনেক গানেই কিছু ভুলভ্রান্তি রয়ে গেছে। এর অনেকগুলোই দারুণ শ্রোতৃপ্রিয়। কিন্তু এখন যখন সেই গানগুলো কোথাও শুনি, তখন আনমনে নিজের দুর্বলতাগুলো বুঝতে পেরে জিব কেটে ফেলি। একটা অস্বস্তিও কাজ করে তখন।
এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। বাংলা আধুনিক গানের কাঠামোর মূলত চারটি স্তর। আস্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ। তবে এ সময়ের আধুনিক গানে সঞ্চারী থাকে না। এ সময়ের একটি গানের নমুনা দেওয়া হলো:
আস্থায়ী:
তোমার সঙ্গে এক কাপ চা
তোমার সঙ্গে এক পথে পা
তোমার সঙ্গে এক মনে মন
তোমার সঙ্গে একটা জীবন
তোমারই সঙ্গে হাতে রেখে হাত
দিন থেকে রাত—তোমারই সঙ্গে
অন্তরা:
তোমারই সঙ্গে রোদ্দুর মিষ্টি
তোমারই সঙ্গে ভিজব বৃষ্টি
তোমারই সঙ্গে স্বপ্ন বুনব
তোমারই সঙ্গে সব তারা গুনব
তোমারই সঙ্গে চোখে রেখে চোখ
সব কথা হোক তোমারই সঙ্গে।
আভোগ:
তোমারই সঙ্গে হাওয়া হব
তোমারই সঙ্গে জোছনা ছোঁব
তোমারই সঙ্গে খুনসুটি আড়ি
তোমারই সঙ্গে যত বাড়াবাড়ি
তোমারই সঙ্গে এক প্রাণে প্রাণ
মান অভিমান—তোমারই সঙ্গে।
গানটি ফেরদৌস প্রযোজিত ‘এক কাপ চা’ ছবির। আমারই লেখা। সুর করেছেন এস আই টুটুল। প্লেব্যাক করেছেন এস আই টুটুল ও দিনাত জাহান মুন্নী।
গীতিকবিতাটি ভালো করে পড়ে দেখুন। প্রতি দুই লাইনে অন্ত্যমিল, ছন্দ—সবকিছু মিলিয়ে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ গীতিকবিতা। প্রতিটি গানেই একটি গল্প থাকতে হয়। এই গানেও ছবির গল্পের প্রেক্ষাপট (দুজন ভালোবাসার মানুষ তাঁদের মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন) খুঁজে পাওয়া যাবে।
যদি কেউ ভেতরে–ভেতরে গান লেখার তাগিদ বোধ করেন, তবে ভাবনা এলেই লিখে ফেলবেন। অল্প কথায়, সহজ ভাষায় গান লিখতে চেষ্টা করবেন। যে ভাষা সবাই বোঝেন।
লেখা শেষ হলে বারবার পড়বেন। দেখবেন, যে ভাবনা থেকে যে বিষয় নিয়ে লেখা, সেটা ফুটে উঠেছে কি না। অন্ত্যমিল, ছন্দ ঠিক আছে কি না। ‘করে’ শব্দের সঙ্গে পরে, ঝরে, মরে মেলাবেন। পারে, মারে, হারে মেলাবেন না। তাতে অন্ত্যমিল দুর্বল হবে। অনেকেই এভাবে মেলান। আমিও প্রথম প্রথম না জেনে এভাবেই মিলিয়েছি। এ ধরনের অন্ত্যমিলে আমার অনেক গানই শ্রোতৃপ্রিয়। সেই গানগুলো এখন কানে এলে একটু অস্বস্তি লাগে বটে। কিন্তু ওই সময় না জেনে, না বুঝেই লিখেছি। এখন জেনেশুনে এটা করা অপরাধের শামিল। তাই আমি চাইব, নতুন যাঁরা গান লিখছেন, তাঁরা এ ব্যাপারে প্রথম থেকেই সচেতন থাকবেন।
অন্ত্যমিল নিয়ে মোটামুটি জানার পরই যে বিষয়টি জানা অত্যাবশ্যক, তা হলো ছন্দ। বাংলা কবিতার প্রধান ছন্দ তিনটি। স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত। মুক্ত শব্দাংশ সব ছন্দেই এক মাত্রা। কিন্তু বদ্ধ শব্দাংশ স্বরবৃত্ত ছন্দে সব স্থানে এক মাত্রা। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে সব স্থানে দুই মাত্রা এবং অক্ষরবৃত্ত ছন্দে শব্দের শুরুতে হলে এক মাত্রা, শব্দের মধ্যে হলেও এক মাত্রা, শব্দের শেষে হলে দুই মাত্রা। বোঝার জন্য একটি শব্দ বেছে নেওয়া যাক। ‘পক্ষান্তর’। শব্দটিতে তিনটি বদ্ধ শব্দাংশ আছে। পক্-খান-তর। স্বরবৃত্ত ছন্দে তিন মাত্রা আছে। ‘পক’ এক মাত্রা, ‘খান’ এক মাত্রা, ‘তর’ এক মাত্রা। (১+১+১) তিন মাত্রা।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দে সর্বত্রই বদ্ধ শব্দাংশ দুই মাত্রা। সে হিসেবে ‘পক’ দুই মাত্রা, ‘খান’ দুই মাত্রা, ‘তর’ দুই মাত্রা। (২+২+২) ছয় মাত্রা। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে শুরুতে এক মাত্রা, অতএব, ‘পক’ এক মাত্রা, মধ্যেও এক মাত্রা, অতএব ‘খান’ এক মাত্রা, শেষে দুই মাত্রা, অতএব ‘তর’ দুই মাত্রা। (১+১+২) চার মাত্রা। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ‘পক্ষান্তর’ শব্দটি স্বরবৃত্তে তিন মাত্রা, মাত্রাবৃত্তে ছয় মাত্রা, অক্ষরবৃত্তে চার মাত্রা। শব্দটি যদি দুই অক্ষরের হয় এবং বদ্ধ শব্দ হয়, যেমন ‘হাত’, ‘সুখ’, ‘সাপ’ ইত্যাদি, তাহলে স্বরবৃত্ত ছন্দে এক মাত্রা, মাত্রাবৃত্তে দুই মাত্রা, অক্ষরবৃত্তেও দুই মাত্রা হবে। (সূত্র: ‘আধুনিক বাংলা গান রচনার কলাকৌশল’, মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান।)
প্রাথমিক ধারণা দেওয়ার জন্য এ ধরনের গ্রন্থের সহায়তা হয়তো নেওয়া যেতে পারে, কিন্তু সৃজনশীল ব্যাপারটি আসে ভেতর থেকে। কাউকে শিখিয়ে–পড়িয়ে গীতিকবি বানিয়ে দেওয়া যাবে না।
মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান তাঁর ‘আধুনিক বাংলা গান রচনার কলাকৌশল’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘গানের বাণী রচনার প্রধান শর্ত হলো, রচয়িতাকে অবশ্যই কবি হতে হবে।’ কবিত্ব কাউকে শেখানো যায় না। ওটা ভেতরের জিনিস। ভেতরে ওই বস্তু থাকলে চর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমে তাতে শাণিত করে নেওয়া যায়। দীর্ঘ সাহচর্য ও কাব্য আলোচনার সাহায্যে কারও কারও ভেতরের কাব্যবোধকে হয়তো জাগিয়ে দেওয়া যায় এবং হয়তো শব্দচয়ন ও প্রয়োগনৈপুণ্য কিছুটা বাড়িয়ে দেওয়া যায়, এর বেশি নয়।
আরেকটি বিষয়, গান লিখতে হলে প্রচুর গান শুনতে হবে। পড়তে হবে প্রচুর কবিতার বই। প্রকৃতির সঙ্গে প্রেম হতে হবে। ভাবনার জগৎ হতে হবে অবারিত। কল্পনায় থাকতে হবে সপ্তম আকাশে চলে যাওয়ার ক্ষমতা। বুলিভান্ডারে থাকবে শব্দের ছড়াছড়ি।
লেখাটি শুধুই একটা ধারণা দেওয়ামাত্র। একজন পূর্ণাঙ্গ গীতিকবি হওয়া অনেক কঠিন। আমি নিজেই গান লিখছি বটে। কিন্তু নিজেই বুঝি, এখনো আমি পরিপূর্ণ গীতিকবি হতে পারিনি।
লেখাটি ২০১৫ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের ‘তারুণ্য’ ম্যাগাজিনের পঞ্চম সংখ্যা থেকে নেওয়া।
গীতিকার