একাত্তর ও একটি ছোট পরিবার

১৯৭১ সালের অবরুদ্ধ বাস্তবতায় জয়নুল আবেদিনের চিত্রকর্ম ‘মুক্তিযোদ্ধা’ছবি: সংগৃহীত
আর কোনো কথা হয় না তাদের মধ্যে। আবারও সেই চিরচেনা নীরবতা। দুজনেই যেন কী এক মহাচিন্তায় পেরেশান।

একটু আগেই সন্ধ্যা নেমেছে। এরই মধ্যে চারপাশ ঘন অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। যেন অমাবস্যার রাত। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। বিকেলের দিকে বৃষ্টি হয়েছিল। রাস্তার পাশের ডোবায় থেমে থেমে ব্যাঙের ডাক শোনা যাচ্ছে। আশপাশ নিঝুম হওয়ায় সামান্য ব্যাঙের ডাকের শব্দ কেমন গগনবিদারি চিৎকার বলে মনে হয়। মাথা ঘুরিয়ে সেদিকে তাকাচ্ছে খোরশেদ সাহেব। ব্যাঙের ডাক কোনো অশুভ সংবাদ বয়ে আনছে যেন। কেবলই সন্ধ্যা ছয়টার সংবাদ শেষ হলো। সবাই নিশ্চুপ। কারও মুখে সামান্য টুঁ শব্দও নেই। চায়ের দোকানের চিরচেনা টুংটাং শব্দটুকুও যেন আজ বন্ধ হয়ে গেছে। রেডিওতে সংক্ষিপ্ত সংবাদ। রাত আটটায় একটু বিস্তারিত শোনা যায়। সংবাদ সামান্য হলেও প্রচণ্ড ভীতিকর। দেশের বিভিন্ন জায়গায় কয়েক মাস আগে থেকেই যুদ্ধ শুরু হয়েছে। কিন্তু এখানে হয়নি। হয়নি বলতে গোলাগুলি হয়নি। তবে মিলিটারিদের আনাগোনা আছে। প্রস্তুতি নিচ্ছে মুক্তিযোদ্ধারাও।

আশপাশের নীরবতা ভেঙে খোরশেদ সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে ওঠেন। তার পাশেই বসে থাকা মারুফের হাত ধরে বলেন, মারুফ! চল বজান বাড়ির দিকে যাই। মারুফও উঠে দাঁড়ায়।

খোরশেদ সাহেব এলাকার সম্ভ্রান্ত লোক। পাশেই মারুফদের বাড়ি। খোরশেদ সাহেব বৃদ্ধ হলেও সচল ছিল। গত বছর আচমকাই প্যারালাইসিস হয়ে দুটো পা–ই অবশ হয়ে যায়। চলাচলের মাধ্যম এখন হুইলচেয়ার। বাড়ি থেকে খুব একটা বের হন না। মাঝেমধ্যে এর–ওর সাহায্য নিয়ে ছুটে আসেন নান্টুর দোকানে। দেশ-বিদেশের খবর শোনার জন্য। শেখ সাহেবের ভাষণও এখান থেকেই শুনেছেন।

ভগ্নমনোরথে বাড়ির দিকে যায় খোরশেদ সাহেব ও মারুফ। মাঝেমধ্যে বিষণ্নতম দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। বাড়ির উঠানে পৌঁছে খোরশেদ সাহেব বলেন, ‘আবদুর রশিদেরা কোথায় আছে কিছু বলতে পারিস?’ দুঃখ ভারাক্রান্ত স্বরে মারুফ উত্তর দেয়, ‘না চাচা, জানি না। কোথাও ব্যায়ামট্যাম করছে বোধ হয়। আমার শরীরটা খারাপ তাই যাইনি।’ ‘ও আচ্ছা।’ বলে কথা শেষ করে দেন। আর কোনো কথা হয় না তাদের মধ্যে। আবারও সেই চিরচেনা নীরবতা। দুজনেই যেন কী এক মহাচিন্তায় পেরেশান। খোরশেদ সাহেবের সুবিধার্থে উঠান থেকে ঘরে যাওয়ার পথ একেবারে সমান রাখা হয়েছে। যাতে সহজেই তিনি উঠানে নামতে পারেন। উঠান অব্দি এনে দিয়ে চলে যায় মারুফ। আস্তে আস্তে ঘরে ওঠেন খোরশেদ সাহেব। প্রচণ্ড ক্লান্ত অনুভব করছেন। নিজেই হুইলচেয়ার ছেড়ে খাটে উঠতে পারেন। কিন্তু তিনি উঠছেন না। ঘুম আসছে না। স্ত্রী রাবেয়া বেগমের মৃত্যুর পাঁচ বছর হয়ে গেল। এখন হয়তো তারও যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। এখনো স্ত্রীকে হারানোর ব্যথায় কাতর। বড্ড মায়া হয় বেচারির জন্য। খুবই ভালো মানুষ ছিল।

দেখতে দেখতে রাত অনেক হয়। ক্রমেই আকাশের মেঘ কেটে যায়। ঘুটঘুটে অন্ধকার এখন অনেকটাই পরিষ্কার। খোরশেদ সাহেব এখনো আগের জায়গাতেই বসে আছেন। সন্ধ্যায় নান্টুর দোকানে দুই কাপ চা খেয়েছেন। এর পর থেকে আর কিছু খাননি। খাওয়ার মতো ক্ষুধাও নেই। যেকোনো সময় মিলিটারিরা হামলা করতে পারে। এলাকার অনেকেই পলাতক। ছেলে আবদুর রশিদ তাকেও পালিয়ে যেতে বলেছে। তিনি যাননি। গায়ের জোর কমে গেলেও মনের জোর এখনো প্রবল। ছেলেকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ‘তোমার যদি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিতে ভয় হয়, তাহলে দিয়ো। কিন্তু আমাকে পালিয়ে যেতে বলবা না। মরতে হলে আমি এখানেই মরব।’

খোরশেদ সাহেবের না খেয়ে থাকার কারণ হলো তার সামনে খাবার প্রস্তুত করে আনার মতো কেউ নেই। নিজেরও খাবার তুলে খেতে ইচ্ছে করছে না। ছেলের বউ বাপের বাড়ি চলে গেছে। কী এক কারণে ছেলেও তাকে আনতে যায় না। আর সে নিজেও আসছে না। তাদের মধ্যে কী হয়েছে কে জানে। আজ এ বিষয়ে কথা বলার জন্যই তিনি অপেক্ষায় আছেন।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। হাঁপাতে হাঁপাতে পাশে এসে বসে আবদুর রশিদ। জিজ্ঞেস করে, ‘কী হইছে আব্বা? এখনো ঘুমান নাই কেন?’ গুরুগম্ভীর স্বরে খোরশেদ সাহেব বলে, ‘এমনিই। ঘুম আসে না রে বাপু।’ ‘ও আচ্ছা, খাইছেন কিছু?’ এবার কিছুটা বিরক্তি নিয়ে খোরশেদ সাহেব উত্তর দেয়, ‘কী আর খাব? বাবার কাজ করতে হবে বলে তুই তো তোর বউকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিস।’ কথাটা বলে তিনি নিজেও ইতস্তবোধ করেন। তিনি জানেন ছেলে কখনোই তার জন্য বউকে বাপের বাড়ি পাঠাবে না। ছেলে নিজেই সব কাজ করে দিচ্ছে। বউ থাকলে তারও অনেক সুবিধা হতো। বয়স বেড়েছে, কথায় কথায় কারণে-অকারণে মেজাজ বিগড়ে যায়।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, ‘আসল কারণ হয়তো আপনি জানেন না। তাই এ কথা বলছেন। ওই দিন ১৫–২০ গাড়ি মিলিটারি এসে বাহাদুর পুর কারিগরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে ক্যাম্প করেছে। আর আপনার বেয়াই ইদ্রিস মল্লিক তাদেরকে আপ্যায়ন করাচ্ছে। তাদের গিয়ে সংবাদ পৌঁছে দেয় মুক্তিযোদ্ধারা কে কোথায় আছেন।
কথাগুলো বেশ ঝাঝাল কণ্ঠে বলে আবদুর রশিদ। খোরশেদ সাহেবের হৃৎপিণ্ড কেঁপে ওঠে। কিছুক্ষণ থেমে কোমর থেকে কী যেন বের করতে করতে আবারও আবদুর রশিদ বলে, ‘আজ বিকেলে উত্তরপাড়ার কালিমুদ্দির মাধ্যমে এই পত্র পাঠিয়েছে আপনার ছেলের বউ। তাতে স্পষ্টভাবে আমাকে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যেতে বারণ করে দিয়েছে। আগামীকাল রাতেই নাকি আমাদের গ্রামে হামলা করবে মিলিটারিরা। তাই আপনাকে নিয়ে ওদের বাড়িতে যেতে বলেছে।’ একটু থেমে আবার বলতে শুরু করে, ‘আপনিই বলেন, যেখানে দেশের জন্য মা-বাবারা পর্যন্ত যুদ্ধ করতে তাদের ছেলেদের পাঠিয়ে দিচ্ছেন। মা-বোনেরা মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সেখানে এই কুলাঙ্গার কিনা আমাকে বারণ করছে যুদ্ধে না যেতে। কীভাবে আমি ওকে আবার আমার ঘরে নিয়ে আসব আব্বা, বলেন?’ আবদুর রশিদ এবার শক্তভাবে বাবার হাত চেপে ধরে। এরপর বলে, ‘আব্বা, আমি নিজের সঙ্গে প্রতিজ্ঞা করেছি। যদি মারা যাই যাব, আমার বাবা যদি মারে যায় যাক, তবু আমি ওকে এ বাড়িতে আনব না। কখনোই না। জানেন, ওদেরকে রাজাকার বলা হয়। ওরা রাজাকার। আমরা এই দেশটাকে স্বাধীন করবই ইনশা আল্লাহ। যদি বেঁচে থাকি তাহলে আমিই আপনার সেবাযত্ন করব। আর মরে গেলে তো কিছু করার নেই।’

এরপর কী এক অজানা কারণে বাবা-ছেলে দুজনই উচ্চ আওয়াজে কেঁদে ওঠেন। নিজেদের জীবন ও যাবতীয় স্বার্থের চেয়ে দেশটাই তাদের কাছে বড় হয়ে ধরা দেয়। বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই তারা কাঁদতে থাকেন।

হাটহাজারী, চট্টগ্রাম