সুপ্তধারার স্বচ্ছ ঝরনায় মন হারাল অজানায়

সুপ্তধারা ঝরনায় আমরা সবাই
মুহূর্তেই ভুলে যাই কমলদহ ঝরনায় যেতে না পারার আক্ষেপ। চারদিকে পাহাড়, চিরসবুজ বন, প্রকৃতি ও দূর থেকে ভেসে আসা পাখির কিচিরমিচির শব্দ। এর মধ্যেই সুমধুর ধ্বনি সৃষ্টি করে পড়ছে ঝরনার কোমল পানি।

সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক ও বোটানিক্যাল গার্ডেন পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। এখানে রয়েছে সহস্রধারা ও সুপ্তধারা নামের দুটি অপরূপ ঝরনা। আরও রয়েছে বিভিন্ন বন্য প্রাণী ও অসংখ্য দুর্লভ প্রজাতির বৃক্ষ। ৩০ টাকায় টিকিট নিয়ে পার্কে প্রবেশ করতে হয়। শুরুতেই একটি বোর্ডে পুরো পার্কের মানচিত্র আঁকা দেখতে পাবেন। এটিকে ভ্রমণ গাইডও বলা চলে।

চার.
দুপুরের খাবার পর্ব শেষে অনিক সরকার সবার জন্য টিকিট কেটে নেয়। একে একে আমরা ভেতরে প্রবেশ করি। সুপ্তধারা ঝরনায় যেতে হলে পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে প্রথমে ওপরে উঠতে হবে। এ পথটা পিচঢালা রাস্তা। হেঁটে ওপরে ওঠা যায়, আবার সিএনজি ভাড়া করেও যাওয়া যায়। আমরা কয়েকজন হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। রাস্তা পুরোনো হওয়ায় অধিকাংশ স্থানে পিচ ও কংক্রিট উঠে গেছে। সবার খালি পা, কেবল অ্যাংলেট পরা। পিচ ও কংক্রিটের ছোট ছোট টুকরাগুলো পায়ের তলায় যেন কাঁটার মতো বিঁধছিল। খুবই সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছিল। রাস্তা ভালো থাকলে কিংবা পায়ে জুতা থাকলে যে পথ পাড়ি দিতে সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ মিনিট লাগার কথা, সেই পথ পাড়ি দিতে আমাদের সময় লেগে যায় প্রায় ৪০ মিনিট। দলের চারজন এই কষ্ট না করে সরাসরি সিএনজি নিয়ে চলে আসে।

আরও পড়ুন

সুপ্তধারা ঝরনায় যাওয়ার প্রবেশপথ থেকে প্রায় ৫০০ সিঁড়ি নিচের দিকে নেমে গেছে। পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা এসব সিঁড়ি বেয়ে শুরু হলো আমাদের যাত্রা। পিচ্ছিল না থাকায় নামতে খুব একটা কষ্ট হয়নি। তার পর থেকে ট্রেইল। পাহাড়ি একটি খাল পার হওয়ার পর পাঁচ মিনিটের মতো পিচ্ছিল ও কর্দমাক্ত পথ। এই পথ পাড়ি দিয়ে আরও পাঁচ মিনিটের ট্রেইল। ঝরনার প্রবাহিত পানি যে পথ দিয়ে চলে গেছে, সেই পথ ধরে ঝরনা পর্যন্ত যেতে হয়। ভরা বর্ষার মৌসুম হওয়ায় পানির স্রোত অনেক বেশি ছিল। পানির নিচে ছোট-বড় পাথরের টুকরা। কোমরসমান পানি। ধীরে ধীরে পায়ের কদম ফেলতে হয়। একটু অমনোযোগী হলেই বিপদের আশঙ্কা। একবার পাথরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে প্রচণ্ড ব্যথা পাই পায়ে। দলের অন্যদেরও একই অবস্থা।

কেবল ভরা বর্ষার মৌসুমেই সুপ্তধারা ঝরনা তার অপরূপ সৌন্দর্য মেলে ধরে। বছরের অন্য সময় এখানে পানি খুবই কম থাকে। যতই দেখছিলাম, মুগ্ধ হচ্ছি। মুহূর্তেই ভুলে যাই কমলদহ ঝরনায় যেতে না পারার আক্ষেপ। চারদিকে পাহাড়, চিরসবুজ বন, প্রকৃতি ও দূর থেকে ভেসে আসা পাখির কিচিরমিচির শব্দ। এর মধ্যেই সুমধুর ধ্বনি সৃষ্টি করে পড়ছে ঝরনার কোমল পানি।
পাশেই একটি স্থানে মোটামুটি শুষ্ক জায়গায় কাঁধের ব্যাগ রেখে নেমে পড়লাম পানিতে। নিজেকে সঁপে দিই ঝরনার স্বচ্ছ পানির নিচে। অসম্ভব সুন্দর এক প্রশান্তির অনুভূতি। শুরু হলো ছবি তোলার পর্ব। একেকজন একেক ভঙ্গিমায় ছবি তুলছে। কারও একটা ফ্রেম সুন্দর হলে অন্যরাও একই ফ্রেমে নিজেদের স্মৃতিবন্দী করে রাখছে। মেয়েদের কেউ কেউ শাড়ি নিয়ে গিয়েছিল ঝরনায় ছবি তুলবে বলে। পানির প্রবাহ এত বেশি ছিল যে মাত্র দুজন কোনোরকমে শাড়ি পরতে পারে। অন্যরা ব্যর্থ হয়ে ব্যাগে রেখে দেয়।

এক ঘণ্টার মতো সেখানে ছিলাম। দিনের আলো কমে আসছিল। কয়েকজন জানাল, তারা গুলিয়াখালী সি বিচ যেতে চায়। সি বিচে যেতে হলে দ্রুত রওনা করতে হবে। এদিকে আমার ব্যাগ রেখেছিলাম শুষ্ক জায়গা দেখে। পরে দেখি পুরো ব্যাগ কাদায় মাখামাখি। প্রথমে ঝরনার পানিতে সেটি ধুয়েমুছে পরিষ্কার করি। আরও যারা ব্যাগ নিয়েছিল, তাদেরও একই অবস্থা। তারপর শুরু হয় ফেরার পালা। ট্রেইল পথ পাড়ি দিয়ে সিঁড়ির নিচে এসে মনে হলো ওপরে উঠতে পারব তো! সারা দিনের ট্র্যাকিংয়ে সবার পায়ের অবস্থা খারাপ। চলতে চাচ্ছিল না। তবু উঠতে হবে, ৫০০ সিঁড়ি।

ইকোপার্কের গেটে যখন ফিরে আসি, সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। ঘড়ির কাঁটায় বিকেল সাড়ে পাঁচটা। গুলিয়াখালী যাব না বলে মত দিলাম আমি। শরীরের পোশাক ভিজে একাকার। একই পোশাক নিয়ে আরও একটি জায়গায় যাওয়া সম্ভব নয়। অবশ্য আরও একটা কারণ ছিল; হাফপ্যান্টের নিচে কিছুটা ছিঁড়ে যায়। অস্বস্তি অনুভূত হচ্ছিল। তাই গুলিয়াখালী না গিয়ে হোটেলে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমার সঙ্গে আরও পাঁচজন একই মত জানাল।
তিনটি সিএনজি ঠিক করা হয়। একটিতে করে ছয়জন যাবে হোটেলে, অন্য দুটিতে বাকিরা গুলিয়াখালীর পথে।

আরও পড়ুন

পাঁচ.
হোটেলে যখন ফিরে আসি, সন্ধ্যা নেমে আসে। সিদ্ধান্ত হলো, ছেলেদের যেহেতু ফ্রেশ হতে সময় কম লাগে, সেহেতু তারা আগে ওয়াশরুমে যাবে। মেয়ে ছিল দুজন। তারা হোটেলের লবিতে বসে অপেক্ষা করে। ছেলে চারজন রুমে গিয়ে সবার আগে ফ্রেশ হয়ে নিই। পালাক্রমে মেয়েরাও নিজেদের তৈরি করে নেয়।

যারা গুলিয়াখালী গিয়েছিল, তারা সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে ফিরে আসে। সি বিচ পর্যন্ত যেতে পারেনি। অন্ধকার নেমে আসায় স্থানীয় লোকজনের পরামর্শে ফিরে আসে। এবার তাদের তৈরি হওয়ার পালা।

রাত আটটা পর্যন্ত সন্ধ্যা হোটেল ভাড়া নেওয়া। আমরা আরও আধা ঘণ্টা অবস্থান করি। এই ফাঁকে আগে যারা এসেছিলাম, তারা নিচে বাজারে গিয়ে হালকা নাশতা করি; প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছিল।
রাত সাড়ে আটটার দিকে হোটেল থেকে বের হয়ে ফেরার পথ ধরি। বাসে ফেনী যেতে হবে। কিন্তু আমাদের বাজেট ভাড়ায় গাড়ি পাওয়া যাচ্ছিল না। আধা ঘণ্টা পর একটি বাস পাই, ভাড়া জনপ্রতি ৯০ টাকা। এক ঘণ্টার যাত্রাপথ।

সুপ্তধারা ঝরনার বর্তমান রূপ

আমাদের ইচ্ছা ছিল ফেরার পথে প্রথম আলোর ফেনী প্রতিনিধি ও ফেনী বন্ধুসভার বন্ধুদের সঙ্গে কিছুটা সময় উপভোগ করা। কিন্তু দেরি হয়ে যাওয়ায় ফেনী বন্ধুসভার সভাপতি বিজয় নাথ দাদা ফোন করে জানান, রাত বেশি হয়ে যাওয়ায় প্রতিনিধি ও বন্ধুরা বাড়ি ফিরে গেছেন। এখন আমাদের অপেক্ষায় আছেন তিনি ও সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন ভাই। তাঁরা মহীপাল বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছেন। কিছুক্ষণ পরপর ফোনে খোঁজ নিচ্ছিলেন কোথায় আছি, আরও কতক্ষণ লাগবে।

মহীপাল পৌঁছাতে রাত ১০টা বেজে যায়। তাঁরা দুজন আমাদের অভ্যর্থনা জানান। এদিকে কারোরই রাতের খাবার খাওয়া হয়নি, প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছে। ভালো একটি রেস্টুরেন্ট দেখে তৃপ্তিসহকারে খাবার খেলাম। খোশগল্প চলল প্রায় ঘণ্টাখানেক। রাত ১১টার দিকে বিজয় দাদা ও দেলোয়ার ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সিএনজিতে চলে গেলাম ফেনী জংশন। দূরত্ব খুব কম, মাত্র ১০ মিনিট।

তূর্ণা এক্সপ্রেসের টিকিট কাটা হয়েছিল আগেই। ট্রেনটি চট্টগ্রাম থেকে ফেনী জংশনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দিবাগত রাত ১২টা ৫০ মিনিট বাজবে। এমনটাই আমাদের জানানো হয়। হাতে আরও দেড় ঘণ্টা সময়। কী করা যায়! সঙ্গে গিটার ছিল। একদল গান-আড্ডায় মেতে উঠল। আরেক দল বসে খোশগল্প করছে। আমি দ্বিতীয় দলে।

হঠাৎ মনে পড়ল বগুড়া বন্ধুসভার বন্ধু সাব্বির শাকিল বর্তমানে ফেনী শহরে থাকে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। তাকে ফোন দিলাম। জানাল, বাসায় আছে, আসতে সর্বোচ্চ ১০-১৫ মিনিট লাগবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সে চলে আসে। তার খোঁজখবর নিলাম, সে আমাদের ভ্রমণের গল্প শুনল।

খাইরুন্নাহার খেয়া আপুর বাড়িও বগুড়া। তিনি সরাসরি বগুড়া থেকে এসে আমাদের ভ্রমণসঙ্গী হন। তবে ফিরতি পথে উনিসহ দুজনের টিকিট ছিল না। একসঙ্গে কাটার সময় পাওয়া যায়নি। আমরা মানুষ ১৫ জন; কিন্তু টিকিট আছে ১৩টি। একজনের সিট নাহয় ম্যানেজ করা যাবে! আরেকজন?

সীতাকুণ্ড থাকার সময় হঠাৎ মনে পড়ল এক বড় ভাইয়ের কথা। উনি আগে-পরেও এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমাদের জন্য ট্রেনের টিকিটের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। বিশ্বাস ছিল, যদি কেউ ব্যবস্থা করতে পারে, তাহলে তিনিই পারবেন। ফোন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বললেন দেখতেছি। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই জানান, এসি বগির একটি সিট পাওয়া গেছে। ওনার মাধ্যমে সেটা কনফার্মও করে ফেললাম।

সংগত কারণেই বড় ভাইয়ের নাম এখানে প্রকাশ করছি না। নয়তো অন্যরাও ওনার কাছে জরুরি মুহূর্তে টিকিট চাইতে পারেন, তাই!

এসি বগির টিকিট খেয়া আপুকে দিলাম। বাকিগুলোর মধ্যে তিনটি এক বগিতে, ১০টি অন্য বগিতে। তিনটি সিট যে বগিতে, সেখানে আমিসহ চারজন গেলাম। এর মধ্যে দুজন একটু স্বাস্থ্যবান, বাকি একজন আমি ও অন্যজন নাঈমা। ফোনে সাফিনের সঙ্গে কথা বলে আরও একটি সিটের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়। ১০ জন যে বগিতে, সেখানে। নাঈমা চলে গেল সেই বগিতে।

ঘুম যখন ভাঙল, দেখি ঢাকা বিমানবন্দর রেলস্টেশনে। আমি, নাঈমা ও মিলন সেখানে নেমে গেলাম। অন্যরা কমলাপুর নামবে বলে জানায়। তারপর যে যার গন্তব্যে...।

বাসায় ফিরে আসার পর শরীরে রাজ্যের ক্লান্তি। অঙ্গে অঙ্গে ব্যথা। দ্রুত গোসল সেরে দিলাম ঘুম। ঘুম ভাঙার পর ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি বিকেল পাঁচটা! চাইলে অফিস না-ও যেতে পারতাম। তবু ভাবলাম ঘুরে আসি। শরীরের ব্যথাও তীব্র আকার ধারণ করে। অন্যদিকে মন বলছিল শিগগিরই আবারও ট্র্যাকিংয়ে যেতে হবে।