‘একদিন ওরা থাকবে না, তুমি থাকবে’

কবি সৈয়দ শামসুল হকফাইল ছবি

কোনো কোনো দিন পূর্ব গগনে সূর্য ওঠার আগেই ঘুম ভেঙে যায়। তৎক্ষণাৎ বিদীর্ণতাও ঘিরে ধরে। আমি পড়ার টেবিলের সামনে গিয়ে বসি। আজকের দিনটিও ব্যতিক্রম নয়। তবে চেয়ার টেনে বসতেই বুকের ভেতর দুটি পঙ্‌ক্তির অস্তিত্ব টের পাই। ‘আমার থিকাও দুঃখী যমুনার নদীর কিনার।/ আমার তো গ্যাছে এক, কত কোটি লক্ষ গ্যাছে তার।’ পঙ্‌ক্তিদ্বয় সৈয়দ শামসুল হকের পরানের গহিন ভিতর কাব্যের। পঙ্‌ক্তি দুটি নিয়ে ভাবতে শুরু করি। ক্যালেন্ডারে চোখ পড়তেই খেয়াল হয় আজ ২৭ সেপ্টেম্বর। ২০১৬ সালের এই দিনে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক না–ফেরার দেশে পাড়ি জমান। তবে কি লেখকের সঙ্গে অপার্থিব ভালোবাসার যোগসূত্র আছে! না, বেদনার ভারে প্রলুব্ধ মনে শামসুল হক শান্তির পরশ বুলিয়ে দিতে পারেন? তাঁর কবিতা পড়লে অনুভব করা যায়। কী নিদারুণভাবে তিনি কষ্টের কথা, ব্যথার কথা, হারানোর কথা, হাহাকারের কথা শব্দে শব্দে এঁকেছেন।

সৃষ্টির সাধনায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ ছেড়ে দেওয়া এই মানুষটি একটা জীবন নিরলসভাবে কেবল লিখে গেছেন। তাই তো যাপিত জীবনের প্রতিটি বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ফুটে উঠেছে তাঁর লেখায়। কিন্তু গল্পে কথা বলা মানুষটির গল্প লেখারই ইতি ঘটে যেতে পারত যদি প্রথম গল্পের প্রকাশক তাঁর কাঁধে সেদিন হাত না রাখতেন। গল্পটা বলি।

তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ‘অগত্যা’ নামের একটি পত্রিকায়। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন ফজলে লোহানী। এক লেখায় লেখক লিখেছেন, ‘আমার প্রথম গল্পটি...ষোলো আনা আমার ছিল না—প্রবোধকুমার স্যানালের ‘ক্ষয়’ নামে একটি গল্পকে অদলবদল করে তৈরি করেছিলাম লেখাটি। আর এই অদলবদলের ব্যাপারটা পত্রিকার সম্পাদক লোহানী পরে ধরে ফেলেছিলেন।’ কিন্তু এর জন্য স্নেহ থেকে বঞ্চিত করেননি তিনি। সব্যসাচীও তত দিনে দ্বিতীয় গল্প লিখে ফেলেন। গল্পের নাম ‘শেষের কবিতার পরের কবিতা’। গল্পটি তাঁর নিজের। একান্তই আপন কল্পনায় আঁকা। তখন পাটুয়াটুলীর ‘সওগাত’ প্রেসে পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের পাক্ষিক বৈঠক হতো। এ বৈঠকে গল্পটি তিনি পড়লেন। মনে অনেক আশা, এই এক গল্প সাহিত্যে তাঁকে ঘর দেবে। কিন্তু ঘটনা ঘটল ঠিক উল্টো, বৈঠকে গল্পটি পড়ার পর উপস্থিত অনেকেই তাঁকে ‘ধুয়ে’ দিলেন। ফলে সভা শেষে সবাই যে যার মতো আনন্দ-হুল্লোড় করতে করতে চলে গেলেও প্রেসের নিচের ডালিমগাছের তলায় বিষণ্ন মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন সৈয়দ শামসুল হক। হঠাৎ কাঁধে হাতের স্পর্শ অনুভব করে মুখ ঘোরাতেই দেখলেন ফজলে লোহানী। ব্যথার ভারে চোখ দুটি ছলছল। লোহানী তাঁকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘ঐ যে ওদের দেখছ, একদিন ওরা থাকবে না, তুমি থাকবে।’

এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক বাংলা সাহিত্যে সোনার ফসল ফলিয়েছেন তিনি। কবিতা, গল্প, উপন্যাসসহ সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি ধারায় তাঁর কলমে সোনা ঝরেছে। এমনকি অর্থকষ্ট কাটাতে যে চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করেছিলেন। সেখানেও উদিত হয়েছে সূর্য। শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগে পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

এ তো গেল চিত্রনাট্যের কথা, গান লিখেও মানুষের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছেন সৈয়দ হক। ‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘তোরা দেখ দেখ রে চাহিয়া’র মতো অনেক কালজয়ী গান রয়েছে তাঁর। ৬২ বছরের বিস্তৃত জীবনে লেখক হিসেবে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। ১৯৬৬ সালে মাত্র ৩১ বছর বয়সে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান তিনি। এ ছাড়া বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৮৪ সালে একুশে পদক এবং ২০০০ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন।

১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম জেলায় সৈয়দ শামসুল হকের জন্ম। বাবা-মায়ের আট সন্তানের বড় সন্তান সৈয়দ হক স্কুলজীবন অতিবাহিত করেন কুড়িগ্রামে। উচ্চমাধ্যমিক জগন্নাথ কলেজ থেকে। এবং পরে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। তবে পড়ালেখা শেষ না করে সৃষ্টির সাধনায় নিমগ্ন হন। আর সমগ্র জীবনের পরতে পরতে স্থাপন করেন সৃষ্টির দৃষ্টান্ত। তাঁর লেখা পাঠককে ভাবায়, কাঁদায়, আন্দোলিত করে। যুগযুগান্তরে তাঁকে নিয়ে সর্বত্র জয়গান হবে। বাংলা সাহিত্যের সব্যসাচী এই লেখকের প্রয়াণদিবসে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।

কেশবপুর, যশোর