পথে পরিচয়

অলংকরণ: তুলি

চারদিকে অল্প অল্প করে কুয়াশা পড়া শুরু করেছে। ভোরের হাওয়ায় বেশ ঠান্ডা ভাব। আবহাওয়া জানান দিচ্ছে এখন শীতকাল।
সকালের মৃদু ঠান্ডা হাওয়া আর সূর্যের কোমল রোদকে সঙ্গে করে আমি রিজার্ভ করা গাড়িটার কাছে এলাম। অনেকগুলো গাড়ির ভিড়ে আমাদের গাড়িটা খুঁজে পেতে কষ্ট হয়নি। খয়েরি রঙের গাড়িটা অন্য গাড়িগুলো থেকে অনেক পরিষ্কার আর চকচকে।
গাড়ির কাছে ২৬-২৭ বছরের এক তরুণী দাঁড়িয়ে আছে। গায়ের রং ফরসা, পেঁয়াজ রঙের শাড়ি পরা, হাতে দুখানা বালা, সিঁথিতে লাল সিঁদুর, চুলগুলো ক্লিপে আলতো করে বাঁধা। দেখতে বেশ অপূর্ব লাগছে, যেন শিশিরভেজা কোনো রঙিন বনফুল।

তাকে দেখে আমার চোখ দুটো শীতল হয়ে গেল। সুন্দর একটা হাসি উপহার দিলাম। সে আমায় আদাব জানিয়ে বরণ করে নিল। ‘নতুন ম্যাডাম বুঝি?’ বনফুল মাথা ঝাঁকিয়ে ওপর-নিচ করে সম্মতি জানিয়ে বলল, জি। তার এই ছোট্ট জবাব একতারার মিষ্টি সুর হয়ে কানে বাজল। অন্য সহযাত্রীরা না আসায় তার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলাম।
- নাম কী?
- রাধা। মিষ্টি স্বরে জানাল তরুণীটি।
মনে মনে বললাম, নাম যথার্থই রাখা হয়েছে। মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করি, বড় সিট রেখে ছোট সিটে বসছেন যে? ‘না ঠিক আছে, কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। ওই সিটগুলোতে আপনারা বসেন।’ সে লাজুক হেসে জবাব দিল।

চেহারা-ছবি আর আদবে বনেদি ঘরের বলেই মনে হলো। এদিকে একজন-দুজন করে অন্য সহযাত্রীরাও আসা শুরু করেছে। বললাম, স্কুল কোথায়?
- ঝারগাঁও উচ্চবিদ্যালয়।
- কোথায় থাকা হয়?
- শহরে। এক আন্টির বাসায়, একটা রুম ভাড়া নিয়ে থাকি।
আমি নীলা। নিজ থেকেই পরিচয় দিলাম। আঙুলে ইশারা করে দেখালাম, ওই যে পাড়াটা দেখছেন, ও পাড়ার শিকদার বাড়িতে ভাড়া থাকি। মাসে ১০ হাজার দিতে হয়। আর বাকি পরিচয় বলতে কিছু নেই, সেম টু ইউ বলে দুজনেই মনভরে হাসলাম।
কিছুক্ষণ পর সহযাত্রীদের আড্ডায় সে-ও স-উৎসাহ যোগ দিল। লক্ষ করলাম, আমার সব ইচ্ছাগুলোর সঙ্গে তার অনেক মিল। আমি বই পড়তে ভালোবাসি, ঘুরতে ভালোবাসি। রাধারও এসব পছন্দ।

তার সঙ্গে আমার পরিচয়টা এভাবেই। এরপর দুজনের মধ্যে বিভিন্ন লেখকের বই বিনিময় হতো। কখনো কখনো শহর ঘুরতে বের হতাম রিকশার হুড ফেলে। কখনোবা বইমেলা, কখনো কোনো রেস্টুরেন্টে ভালো মেনুর খোঁজে। দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল বেশ!
একদিন খুব সকালে রাধার ফোন। কণ্ঠে উচ্ছ্বাস বইছে। জানাল, আজ বাড়ি চলে যাবে। সকাল ১০টায় ট্রেন। আগামীকাল স্থানীয় সরকারি প্রাইমারি স্কুলে যোগদান করতে হবে। বলল, মুক্তিযোদ্ধা ও বিজ্ঞানের কোটায় নতুন চাকরিটা পেয়েছে। আমিও খুশি হয়ে তাকে সকালের নাশতার দাওয়াত দিলাম। সে কোনো রকম দ্বিধা ছাড়াই রাজি হয়ে গেল।

রাধার কপালে লাল টিপ, কপালে চিকন সিঁদুর, আজ বেশ পরিপাটি দেখাচ্ছে। নাশতার সাথে চলল আমাদের নানা বিষয় নিয়ে খোশগল্প। নাশতা শেষে একসঙ্গে বের হই। সকালের পরিষ্কার ফাঁকা রাস্তায় পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছি। দোকানপাট সবে খোলা শুরু করেছে। দু-একটা হোটেল খোলা। কয়েকটা কুকুর ঘুরঘুর করছে। রাধা কুকুর দেখলে ভয় পায়। সে আমার দিকে একটু চেপে এল। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা রেলস্টেশনে চলে এলাম।

তার চলে যাওয়ার পথে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। রাধা পথের বাঁকে জনারণ্যে হারিয়ে গেল। আমার চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু জল। এদিকে স্কুলেরও সময় হয়ে আসছে। দ্রুত যেতে হবে।
সূর্য পশ্চিমে ঢলতে শুরু করেছে। স্কুল শেষে বাড়ি ফিরলাম। গৃহকর্ত্রী বারান্দায় বসে ছিল। আমি উঠানের শুকনা কাপড়গুলো নিয়ে ঘরের দিকে যাচ্ছি। এমন সময় গৃহকর্ত্রী বললেন, ‘আপনি কি জানতেন না তিনি অন্য ধর্মের?’ কিছুক্ষণ চুপ থেকে জবাব দিলাম, ‘তিনি মানুষ।’