‘চোখের বালি’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম আধুনিক উপন্যাস। উনিশ শতকের শেষ দশকের যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এবং সমসাময়িক কালের জাতিক ও আন্তর্জাতিক সময়, সমাজ ও সংস্কৃতির অন্তরস্থিত মানব অস্তিত্বের সর্বগ্রাহী সমস্যাই প্রথম বাংলা সাহিত্যে এই উপন্যাসের মাধ্যমে শিল্পরূপ লাভ করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইতিহাস–আশ্রিত রচনার মধ্য দিয়ে উপন্যাসের জগতে প্রবেশ করেছিলেন। এতে তাঁর তৃপ্তি মেটেনি। কল্পনাকে বাদ দিয়ে বাস্তব জীবনের প্রেক্ষাপটকে আশ্রয় করে তিনি নতুন ধারা সৃষ্টি করেন। এ চেষ্টার প্রতিফলন দেখা যায় ‘চোখের বালি’ উপন্যাসে।
১৮৮০ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বিনোদিনী’ নামে একটি গল্প লেখেন। পরবর্তী সময়ে এটিই ‘চোখের বালি’ উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয়। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ কুশলতা এ উপন্যাসের চরিত্রাঙ্কনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এতে লেখক চরিত্রগুলোর ব্যক্তিত্বকে শুধু বাইরের ক্রিয়াকর্মে নয়, মনের দিক থেকে পূর্ণ বিকশিত করে বিশ্লেষণ করেছেন। পারিবারিক গণ্ডির মধ্যকার ব্যক্তিজীবনের সমস্যা ও টানাপোড়েন খুব গভীরভাবে বিশ্লেষায়িত হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়কে অবলম্বন করে মনের বিমিশ্র গভীর অনুভূতির বিবরণ দিয়ে শিল্পী চরিত্রে রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন।
উপন্যাসের শুরুতেই বিনোদিনীর পরিচয় পাই। এই চরিত্রকে ঔপন্যাসিক অতি সূক্ষ্ম ও জটিল মনস্তত্ত্বে বিশ্লেষণ করেছেন। এটি কেন্দ্রীয় চরিত্র। বিনোদিনী যেমন সুশিক্ষায় শিক্ষিত, সুদর্শনা, তেমনি কাজকর্মে নিপুণ। সে মার্জিত, রুচিসম্মত; অন্য বাঙালি নারীদের চেয়ে বেশিই শিক্ষিত।
মহেন্দ্রর সঙ্গে বিনোদিনীর বিয়ের কথা বলে মহেন্দ্রর মা। মহেন্দ্র প্রথমে সম্মতি দিলেও শেষ পর্যন্ত বিনোদিনী তার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়। দারিদ্র্যের অপঘাতে অসুস্থ ও অযোগ্য ঘাটের মড়ার গলায় সে মালা পরাতে বাধ্য হয়। ভেঙে যায় তার সব স্বপ্ন। অল্প বয়সে বৈধব্য বরণ করায় জীবনে নেমে আসে দুঃখকষ্ট। বিহারীর প্রত্যাশায় সমাজের উপেক্ষা, অল্প বয়সে বৈধব্য বরণ, দারিদ্র্যের যন্ত্রণা বিনোদিনীর আত্মসম্মানে আঘাত হানে।
মহেন্দ্রর খামখেয়ালিপনা উপন্যাসের গতিপ্রকৃতিকে বারবার পরিবর্তন করে। যে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণহীন বলেই বিহারীর বিয়ের পাত্রী আশালতাকে বিয়ে করেছে। বিয়ের পর উদ্দাম প্রণয়লীলায় মত্ত হয়ে জগৎ–সংসার ভুলে যায়। তার মা রাজলক্ষ্মী ছেলের এমন অবস্থা দেখে কষ্ট পায়। সে অন্নপূর্ণাকে দোষারোপ করে। ফলে অন্নপূর্ণা সংসার ছেড়ে কাশীতে চলে যায়। আর রাজলক্ষ্মী চলে যায় গ্রামের বাড়ি বারাসাতে। সেখানে বিনোদিনী তার সেবা করে মন জয় করে নেয়।
‘চোখের বালি’ উপন্যাসের দুটি পুরুষ চরিত্রের মধ্যে প্রধান চরিত্র মহেন্দ্রকে লেখক গঠন করেছেন আত্মকেন্দ্রিকতার ধাতুতে। বাল্যকাল থেকেই সে বাবাহারা হয়ে মা ও কাকিমার আদরে–প্রশ্রয়ে শুধু নিজেকেই ভালোবাসতে শিখেছে। তার মধ্যে মানবিক গুণাবলির জন্ম হয়নি। প্রথমে দেখা যায়, মায়ের প্রতি ভালোবাসার ঘাটতির অভাব হবে বিয়ে করলে, এ কারণে সে বিয়ে করতে চায় না। পরে আবার বিহারীর পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে জগৎ–সংসার, মা—সবাইকে ভুলে স্ত্রীর প্রতিই বেশি মনোযোগী হয়ে পড়ে। বিনোদিনীর ক্ষেত্রেও তার আত্মকেন্দ্রিকতাই কাজ করেছে। প্রথমে সে বিনোদিনীর সম্পর্কে উদাসীন, কিন্তু তার সম্পর্কে যে বিনোদিনীও উদাসীন, এটি তাকে বেদনাহত করে।
উপন্যাসে বিহারীকে আবিষ্কার করে বিনোদিনী। এই চরিত্রের অপূর্ণতা দূর করে, গোপনে আবেগের দুর্বলতার খাদ মুক্ত করে তাকে খাঁটি সোনায় পরিণত করার দায়িত্ব বিনোদিনীই পালন করে। বিহারীর অন্তরে শুধু প্রেম নয়, বরং তার পৌরুষের জাগরণ ঘটেছে বিনোদিনীর সংস্পর্শে। বিহারীকে রবীন্দ্রনাথ মনস্তাত্ত্বিক একটি সূক্ষ্ম সূত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত করে তাকে বিকশিত করেছেন।
রাজলক্ষ্মী চরিত্রটিও অতি সূক্ষ্ম একটি মনস্তাত্ত্বিক সূত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত। মহেন্দ্র সম্পর্কে রাজলক্ষ্মীর স্নেহের মনোভাব বাড়াবাড়ি মনে হলেও মনস্তাত্ত্বিক বিচারে তার মনোভাব আত্মপ্রতিষ্ঠার নামান্তর। মহেন্দ্রর ভেতর দিয়ে রাজলক্ষ্মী রসিয়ে রসিয়ে নিজের প্রাধান্য উপভোগ করেছে। মায়ের প্রাধান্য ক্ষুণ্ন হবে মনে করে বিয়ে করলে রাজলক্ষ্মী যেমন খুশি হয়েছে, তেমনি তার অমতে বিয়ের পর বউ নিয়ে মাতামাতি রাজলক্ষ্মীর ক্ষোভে পরিণত হয়। তখনই সে বিনোদিনীকে দেখে বলে ওঠে, ‘মা, তুই আমার ঘরের বউ হলিনে কেন, তা হইলে তোকে বুকের মধ্যে করিয়া রাখতাম।’
রাজলক্ষ্মী তার স্বরূপ বুঝতে না পারলেও বিনোদিনী ঠিকই বুঝেছিল। তাই সে প্রত্যুত্তরে বলে, ‘সে কথা ঠিক পিসিমা, কেহ কাহাকেও জানে না। নিজের মনও কি সব জানে। তুমি কি কখনো তোমার বউয়ের উপর দ্বেষ করিয়া এই মায়াবিনীকে দিয়ে তোমার ছেলের মন ভুলাইতে চাও নাই? একবার ঠাওর করিয়া দেখো দেখি।’ এখানেই রাজলক্ষ্মী চরিত্রের পূর্ণ রূপটি ধরা পড়ে।
উপন্যাসে আশা চরিত্রটি ছোট মনে হলেও তার বিবর্তন কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রথম দিকে অবলা, সরলা, অপরিণত বুদ্ধির বালিকা আশা শেষের দিকে কিছুটা আত্মবোধসম্পন্ন হয়। শেষের দিকে আশার চরিত্রের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। তা মহেন্দ্রও লক্ষ করে। শেষে তার কাছে আশার যে মূর্তি ধরা দেয়, এ যেন মহেন্দ্রর কাছে নতুন। এই আশার মধ্যে কোনো সংকোচ নেই, দীনতা নেই; এই আশা নিজের অধিকারের মধ্যে অধিষ্ঠিত। যেটুকুর জন্য সে মহেন্দ্রর কাছে ভিক্ষাপ্রার্থী নয়।
উপন্যাসে অন্নপূর্ণার বিশেষ ভূমিকা নেই, তবে অবান্তর বলা যায় না। তিনিই বিহারী ও আশার, বিশেষ করে আশার আত্মাধিক শক্তি। সে চাইলে মহেন্দ্রকে ফেরাতে পারত, আবার আশাকেও শিক্ষিত করতে পারত। কিন্তু অশান্তি এড়াতে সে অভিমানবশত কাশি গমন করে। এ চরিত্রটির মধ্যে সূক্ষ্ম অভিমানের রেশ ও সামান্য একটু জটিলতার সঞ্চার করেন লেখক। কাহিনির ওপর ভর করে রবীন্দ্রনাথ চরিত্রের অন্তর্জগতের জটিল রহস্য উদ্ঘাটনে উৎসাহী হন। বিধবা তরুণীর মনোবেদনা ও সামাজিক অবস্থান মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণের প্রয়াস রয়েছে।
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, ঢাকা কলেজ