একুশের বিকেল

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

শহরের কোল ঘেঁষে বয়ে গেছে টাঙ্গন নদ। সেনুয়া ব্রিজের কাছে গোরস্তান-সংলগ্ন মসজিদে প্রতিদিন আসরের নামাজ পড়তে আসেন আসগর আলী। আজ নাতি একুশকে নিয়ে এসেছেন। গোরস্তানের সীমানাপ্রাচীরের বাইরে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট অনেক দোকান। নামাজ শেষে একটা দোকানের বেঞ্চে এসে বসলেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে রাস্তায় পড়ে থাকা লাল টুকটুকে শিমুল ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এই ফুলের নাম জানো?

হ্যাঁ, শিমুল ফুল।

ফাল্গুনের এই শিমুল, পলাশ আর কৃষ্ণচূড়া সেদিনের সেই রঞ্জিত রাজপথের কথা খুব করে মনে করিয়ে দেয়। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার, ৮ ফাল্গুন ১৩৫৮, ভাষা আন্দোলনের মাস।

সেটা আবার কোন ভাষা আন্দোলন, দাদু?

দাদু বললেন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন আর ৮ ফাল্গুন ১৩৫৮ ভাষা আন্দোলন একই দিনের কথা! এটা বাংলা তারিখ।

আমি তো জানি না।

জানবে! আরও অনেক কিছু জানবে!

সেদিন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রমহলের রক্তে উত্তাল ঢেউ উঠেছিল, তীব্রভাবে প্রতিবাদ করেছিল উর্দু নয়, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। তখন আমাদের ৫৬ শতাংশ মানুষের মুখের ভাষা ছিল বাংলা, যে ভাষাতে কিষানি দিবানিশি স্বপ্ন বুনে, রাখাল তার বাঁশিতে সুর তোলে, শিশু-কিশোর খেলায় মাতে, মায়ের ভাষায় সুখ-দুঃখের জীবনগাথা। মায়ের ভাষায় কথা বলার মতো সুখ অন্য কোনো ভাষায় পাওয়া সম্ভব নয়। তরুণ ছাত্রসমাজ আপামর বাঙালির মুখের ভাষায় মর্মকথা বুঝতে পেরেছিল। তারা সিদ্ধান্ত নিল, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলবে।

কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত থেকে ১৪৪ ধারা জারি করল। সব ধরনের সভা-মিছিল বন্ধের ঘোষণা দিল। এ ঘোষণায় বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রমহলের রক্তে আগুনের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে প্রতিবাদের মিছিল নিয়ে রাজপথে বেরিয়ে আসেন, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই বলে স্লোগানে স্লোগানে মুখর করলেন ঢাকা শহর। সেখানে পুলিশ নির্মমভাবে গুলি ছুড়লে মুহূর্তেই অসংখ্য তরুণের তাজা রক্তে রঞ্জিত হলো রাজপথ। কেউ কেউ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নেন, তাঁরা মায়ের কোলে আর ফেরেননি, দুঃখিনী মা পথ চেয়ে ছিলেন তাঁর খোকা ফিরবে বলে। মিছিলের ওপর বর্বরতার খবর শুনে সেদিন সবাই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রাণের বিনিময়ে বাংলা ভাষার দাবিকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। বাঙালি জাতিই প্রথম বিশ্বে ভাষার জন্য আন্দোলন করেছে। সেটির প্রতি সম্মান দেখাতে ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়।
এটা তো আমাদের জন্য অনেক সম্মানের আর গর্বের বিষয়, তাই না দাদু!

গর্বের অবশ্যই। তবে ভাষার সম্মান কি আমরা আসলেই রক্ষা করতে পেরেছি?
আমরা তো প্রতিবছর শহীদ মিনারে যাই, ফুল দিয়ে তাঁদের স্মরণ করি। এটাই তো তাঁদের প্রতি সম্মান দেখানো। আর কী?

আসগর আলী তাঁর পকেট থেকে একুশের মোবাইল বের করলেন এবং বন্ধুর কাছে পাঠানো টাইপ করা লেখাগুলো দেখিয়ে বললেন, তবে এটাকে কী বলে?
একুশ তার টাইপ করা বাংলিশ লেখাগুলোর দিকে অপলক তাকিয়ে রইল, সে নিজের ভুল বুঝতে পারে। যদি লেখাগুলো বাংলায় লেখা হতো, তবে দেখতে যেমন সুন্দর হতো, তেমনি এর উচ্চারণ ও শব্দের অর্থ ঠিক থাকত; এ কথা ভেবে তার চোখ দুটো জলে ভরে গেল।

দাদু একুশের মুখ উঁচু করে তুলে ধরে বললেন, কাঁদছ কেন? এ ভুল তো তোমার একার নয়। আর এমন ভুলের থেকেও বড় বড় ভুল আছে। সেসব ভুল তোমাকে দেখাব বলে সঙ্গে নিয়ে এসেছি। তুমি যখন আজ ভাতঘুমে আচ্ছন্ন, তখন তোমার মোবাইলে একটা শব্দ হলো, হাতে নিয়ে দেখি, তোমার বন্ধু তোমাকে একইভাবে খবর পাঠিয়েছে। তখন মনে হলো, ভাষা আন্দোলনে শহীদ হওয়া রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত ও শফিউরের মতো আরও অনেকের তাজা প্রাণের রক্ত, তাঁদের স্বপ্নের নীরব কান্না কি বৃথা যেতে বসেছে? আজ তোমরা তরুণ। তোমাদেরই ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে হবে।

আসগর আলী একুশের হাত ধরে রাস্তায় হেঁটে হেঁটে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। রাস্তার পাশে গড়ে ওঠা বিভিন্ন নামীদামি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে চোখ রাখলেন, তাতে ব্যানারে, দেয়াললিখনে ভুল বানান, বিভিন্ন পোস্টারে, গাড়ির গায়ে ভুল বানান। যা কিনা শব্দের অর্থের পরিবর্তন ঘটায়। বাংলা ভাষার জন্য ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগ আর বর্তমান বাংলা ভাষা প্রয়োগের সমন্বয় ঘটাতে পারে না একুশ।

বাসায় ফিরে সারা রাত একুশের চোখে ঘুম আসে না। সে বদলে যাওয়ার শপথ নেয়। মুঠোফোনটা বন্ধ করে শুয়ে পড়ে। নানা চিন্তা মাথায় আসে, বিছানার এপাশ-ওপাশ করে রাত যখন শেষের পালা, পাড়ার সব বন্ধু দরজায় কড়া নাড়তে থাকে। একুশ দরজা খুলে দেখতে পায়, মেহেদি, সাকিব, আরজুসহ সব বন্ধু কালো ব্যাচ ধারণ করে খালি পায়ে ফুলের তোড়া নিয়ে একুশকে নিয়ে যেতে এসেছে।

তুমি শহীদ মিনারে যাবে না? এখনো তৈরি হওনি? মেহেদির প্রশ্ন।
গিয়ে কী হবে?

কেন, আজ তো একুশে ফেব্রুয়ারি। বেদিতে ফুল দেব। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গান গাইব। ভাষাশহীদ দিবস পালন করব!

তাই বুঝি? যদি বেদিতে ফুল দেওয়া আর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গান গাওয়ার মানে ভাষাশহীদ দিবস পালন করা হয়, তবে আমি এমন শহীদ দিবস পালন করতে চাই না।

তুমি তবে কী চাও?

তা জানতে হলে আমার বাসায় কিছুক্ষণ বসতে হবে। সময় হবে?

পাড়ার বন্ধুরা সব উৎসুক হয়ে একুশের ঘরে গিয়ে বসল। একুশ তার বালিশের নিচ থেকে মুঠোফোন বের করে বাংলিশ লেখাগুলো দেখাল আর দাদুর গল্পও শোনাল। এরপর ধীরে ধীরে গতকাল রাস্তার ধারের বিভিন্ন সাইনবোর্ডে লেখা ভুল বানানের তুলে আনা ছবিগুলো দেখাল।

ছেলেদের কোলাহলে দাদুও এসে হাজির হয়েছেন। তিনি বোঝালেন, বাংলা ভাষার ব্যবহার এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে জাতির ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। দাদুর কথায় বাংলা ভাষার প্রতি ছেলেদের উৎসাহ ও ভালোবাসা বেড়ে যায়। বাংলা বানানের প্রতি তারা সতর্ক এবং যেসব সাইনবোর্ডে বানান ভুল আছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তা ঠিক করার জন্য অনুরোধ করবে।

এরপর তারা দাদুকে সঙ্গে নিয়ে শহীদ মিনারের দিকে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়। কিন্তু যাওয়ার সময় একুশ ফুলের তোড়া না নিয়ে চুনের গোলাভর্তি ছোট একটা বালতি আর তুলি হাতে নিল। এমন কাণ্ড দেখে সবাই হেসে ওঠে। দাদু বলল, এসব দিয়ে কী হবে?

সে মুচকি হেসে বলল, শহীদ দিবস পালন করব। সে সবার সঙ্গে প্রভাতফেরিতে যুক্ত হয়। প্রভাতফেরি এগিয়ে চলছে। একুশ রাস্তার দেয়ালে দেয়ালে তুলির ছোঁয়ায় লিখছে, ৮ ফাল্গুন ১৩৫৮, শহীদ দিবস অমর হোক, অমর হোক।