স্মৃতিচারণ
বন্ধুসভায় ১৬ বছর
১১ নভেম্বর ছিল প্রথম আলো বন্ধুসভার ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এ উপলক্ষে প্রথম আলো ও বন্ধুসভাকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন কুষ্টিয়া বন্ধুসভার বন্ধু ইমাম মেহেদী।
২০০৮ সাল। এইচএসসি পাস করে সদ্য অনার্সে ভর্তি হয়েছি। প্রথম আলোর ছাপা কাগজে বন্ধুসভার পাতা দেখে ইচ্ছা হলো যুক্ত হওয়ার। কুমারখালী বন্ধুসভার দীপু মালিক ও এম এ ওহাবের মাধ্যমে যুক্ত হলাম কুমারখালী বন্ধুসভায়। এর মধ্যে গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের বাস্তুভিটায় বসে মিটিং করার একটি দলগত ছবি ছাপা হলো বন্ধুসভার পাতায়। নিজের ছবি পত্রিকার পাতায় দেখে পুলকিত হলাম। পরের বছর কুমারখালী বন্ধুসভার কমিটিতে আমি সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পেলাম।
২০১০ সালে কুমারখালী বন্ধুসভার সদস্য হিসেবে গাজীপুরের মৌচাকে জাতীয় বন্ধু সমাবেশে অংশগ্রহণ করি। জীবনে প্রথমবারের মতো সমাবেশে প্রচণ্ড শীতের মধ্যে তাঁবুবাস করলাম। সারা দেশ থেকে আসা অনেক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো। ‘আলোকিত মানুষ চাই’ স্লোগানের কথার জাদুকর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের বক্তব্য শুনলাম অত্যন্ত কাছ থেকে। স্যারের বক্তব্য শুনে মুগ্ধ হলাম। তখন বুঝলাম, সুন্দর করে কথা বলাও একটি শিল্প। দেখা হলো কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক, এভারেস্টজয়ী মুসা ইব্রাহিম ও অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীর সঙ্গে। এই বয়সে এত গুণী মানুষের সঙ্গে সামনাসামনি সাক্ষাৎ হবে, তা কল্পনাও করতে পারিনি।
এরই মধ্যে কুষ্টিয়া বন্ধুসভার সভাপতি তৌহিদী হাসান বন্ধু থেকে প্রথম আলোর কুষ্টিয়া প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ পেলেন। পড়াশোনার জন্য যেহেতু কুষ্টিয়া শহরে থাকি, সেহেতু আমার জন্য কুমারখালী যাতায়াত কষ্ট হয়ে যেত। এ কারণে যুক্ত হলাম কুষ্টিয়া বন্ধুসভায়। সভাপতি তখন মনিরুজ্জামান কাজল। ২০১২ সালে কুষ্টিয়া বন্ধুসভার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করলাম। লেখালেখির একটু অভ্যাস থাকায় প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক তৌহিদী হাসান ভাই সব সময় উৎসাহ দিতেন। বন্ধুসভার অনলাইন দেখতেন তখন ইমরুল কায়েস ভাই। কয়েকটি গল্পও তখন প্রকাশিত হলো অনলাইনে। লেখালেখির আগ্রহটা বেড়ে গেল।
২০১৩ সালে আমার সম্পাদনায় কুষ্টিয়া বন্ধুসভা থেকে প্রকাশিত হলো ম্যাগাজিন ‘আলোর পথে’। বাস ভাড়া করে নেচেগেয়ে গাজীপুরের মৌচাকে বন্ধুসভার জাতীয় সমাবেশে গেলাম। সমাবেশে বন্ধুসভা জাতীয় পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক সাইদুজ্জামান রওশন ভাই ‘আলোর পথে’ ম্যাগাজিনের মোড়ক উন্মোচন করে কাঁধে হাত রেখে প্রশংসা করলেন। লেখালেখিটাও যেন বন্ধ না করি, সে বিষয়ে সাহস দিলেন। একই বছর কুষ্টিয়া বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করলাম।
ভালো লাগার বিষয় ছিল অনুষ্ঠান উপস্থাপনা। প্রথম আলোর ইন্টারনেট উৎসব, জিপিএ-৫ সংবর্ধনা, গণিত উৎসব, ভাষা প্রতিযোগিতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ছাড়াও অন্য অনুষ্ঠানগুলোর উপস্থাপনা সাধারণত আমিই করতাম। উপস্থাপনায় আমাকে সামনে এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করতেন তৌহিদী হাসান ভাই। নিজেকে উপস্থাপক হিসেবে গড়ে তুলতে অনুষ্ঠানগুলো আমাকে দারুণভাবে সহযোগিতা করেছে।
প্রচণ্ড শীতে কম্বল বিতরণ করতে ছুটে গিয়েছি কুষ্টিয়া জেলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে। অল্প একটু সহযোগিতা দিয়ে হলেও প্রথম আলো ও বন্ধুসভার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে পাশে দাঁড়িয়েছি বীর মুক্তিযোদ্ধা রাবেয়ার পাশে।
কুষ্টিয়া বন্ধুসভা থেকে নাটোর ও পাবনায় বন্ধু উৎসবেও যোগ দিয়েছি। বার্ষিক বনভোজনে গিয়েছি নাটোরের রানি ভবনে। কুষ্টিয়াতেও বন্ধু উৎসবের আয়োজন করেছি এক বছর। একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করে গড়ে তুলতে প্রথম আলো ও বন্ধুসভার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, নেতৃত্ব প্রদান ও দায়িত্ব পালন আমাকে সহযোগিতা করেছে।
২০১৬ সালে কুষ্টিয়া ছেড়ে রাজধানী ঢাকায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে চাকরিতে যুক্ত হলাম। বাংলামোটর অফিস থেকে বের হয়ে ১০ মিনিটের পথ হাঁটলেই কারওয়ান বাজার প্রথম আলোর অফিস। ঢাকায় গিয়ে ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার সঙ্গে যুক্ত হলাম। ২০১৯ সালে ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বেও ছিলাম কয়েক মাস।
২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় কুষ্টিয়ায় ফিরে আসি। তার পর থেকে আবার সক্রিয় হই কুষ্টিয়া বন্ধুসভায়। সেই থেকে এখনো বন্ধুদের সঙ্গে চলছি। বন্ধুদের সঙ্গে থেকে সামাজিক ও সাংগঠনিক কাজ করতে পছন্দ করি, ভালো লাগে। বন্ধুদের কোনো বয়স নেই।
বন্ধুসভার বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের ফলে পরিচিত হতে পেরে সান্নিধ্য পেয়েছি প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, নির্বাহী সম্পাদক কবি সাজ্জাদ শরিফ, লেখক লুৎফল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক, অধ্যাপক তারিক মনজুর, প্রাবন্ধিক কুদরত-ই-হুদা, প্রখ্যাত গল্পকার ও শিশুসাহিত্যিক রফিকুর রশীদ, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক কবি সোহরাব হাসান, বার্তাকক্ষের সাবেক সমন্বয়ক অরুণ বসু ও অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর স্যারের মতো মানুষের সঙ্গে।
পুরোনো বন্ধুদের অনেকের নামই হয়তো ভুলে গেছি। তারপরও হাসান মাহমুদ, সজীব মিয়া, আবু সাঈদ, সাইদুল ইসলাম, সৈয়দ রাশিদুল হাসান, মোহতারিমা রিমা, মৌসুমী মৌ, শাহিন মাহফুজ, গাজী আনিস, সোহেল রানা, খায়রুন্নাহার খেয়া, আব্দুল ওহাব, ফারিয়া রহমান নাওমি, হৃদয়, দীপ সরকার, জান্নাতুল বাকের, অনিমেষ বৈদ্য, অনিক সাহা, বিন্দু, উত্তম দাদা, মুমিত আল রশিদ ও ফিরোজ ভাইয়ের নাম স্মৃতিপটে এখনো ভেসে আসে। পরিচিত বন্ধুদের মধ্য থেকে হারিয়েছি কুমারখালী বন্ধুসভার স্নেহের ফরিদ ও ঢাকা বন্ধুসভার জুবায়ের কবির তুষারকে। বড় ব্যথিত হয়েছি দুই বন্ধুকে হারিয়ে। বন্ধুদের এভাবে অসময়ে হারাতে কার ভালো লাগে!
এখনো মিস করি কুষ্টিয়া বন্ধুসভার মনিরুজ্জামান কাজল, আব্দুল্লাহ আল মামুন, হোসাইন মোহাম্মদ সাগর, কামরুজ্জামান মাসুম, শাওন, মামুন, মাসুম, সেঁজুতি ভৌমিক, মোহন ভাই, শাহীন আলম, কোরবান, নাঈম, সাব্বির আহমেদ, রাহিমা আক্তার, রজনী, মৌসুমী, জাহাঙ্গীর, পিয়াস, লুবনা, নাঈম মোশারফ, মেহেদী হাসান, কুমারখালী বন্ধুসভার এম এ ওহাব, সাইদুল, পাবনা বন্ধুসভার জুয়েল ঘোষ, অনিকা তাসনিম, রেহানা সুলতানা শিল্পী, যশোর বন্ধুসভার মুস্তাফিজসহ নাম ভুলে যাওয়া অনেক বন্ধুদের। পুরোনো বন্ধুর মধ্যে রাহুল ও মৌসুমী এখনো সক্রিয় রয়েছে কুষ্টিয়া বন্ধুসভায়। পেশাগত কারণে বন্ধুরা বিভিন্ন জায়গায় হলেও আমাদের ভালোবাসার বন্ধনের নাম বন্ধুসভা। নিজের ভালো লাগা থেকেই নানা ব্যস্ততার মধ্যে মিটিং ও কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করি। বিশেষ করে ভালো লাগে পাঠচক্রের অনুষ্ঠানগুলো।
দেখতে দেখতে প্রথম আলো ও বন্ধুসভার ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী চলে এল। ভালো কাজের অংশ হিসেবে গত ২৫ অক্টোবর সভাপতি অনিক মামুন ও সদস্য রিজিয়া সুলতানার নেতৃত্বে অন্য বন্ধুদের অংশগ্রহণে এবারও একটি ভালো কাজের স্মৃতি রেখেছে কুষ্টিয়া বন্ধুসভা। ৪ নভেম্বর ছিল প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এ উপলক্ষে ৭ নভেম্বর কুষ্টিয়ায় প্রথম আলোর ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান সঞ্চালনাও তৌহিদী হাসান ভাই আমার ওপর দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকলেন। সবকিছু মিলিয়ে প্রথম আলো ও বন্ধুসভা আমার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম। যে প্ল্যাটফর্মটি আমাকে লেখক ও সংগঠক হতে দারুণভাবে সহযোগিতা করেছে।