মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক পটিয়ার মিয়া আবু মোহাম্মদ ফারুকী

মিয়া আবু মোহাম্মদ ফারুকীর সঙ্গে লেখকছবি: লেখকের সৌজন্যে

‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ওমা, আমি নয়ন জলে ভাসি/ আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি,’ গুন গুন করে জাতীয় সংগীতের শেষ চরণটি গাইছিলেন মিয়া ফারুকী চাচা। ভাবছিলাম জাতীয় সংগীতের শেষ চরণটির কথা কত আবেগ দিয়ে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন। মায়ের মুখ মলিন হলে সত্যি আমরা জলে ভাসি। মা মানে তো একটা দেশ। এটাই সত্যিকারের দেশপ্রেম। আসলে আমরা সোনার বাংলায় বাস করি, কিন্তু দেশে আজ সোনার মানুষের বড় অভাব। যাঁদের জন্য এই মা-মাটি, মানচিত্র পেয়েছি, তাঁদেরকে আজও পারিনি সত্যিকারভাবে মূল্যায়ন করতে। তেমনি একজন সোনার মানুষের খোঁজ পেয়েছিলাম চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার কচুয়াই গ্রামে।

কচুয়াই গ্রামটি শ্রীমতী খালের পাশে অবস্থিত। এই খালকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিসিক শিল্পনগরী। শ্রীমতী ব্রিজ পার হয়ে যে রাস্তাটি দক্ষিণ পাশে চলে গেছে, সেটি কচুয়াই গ্রাম। প্রকৃতি সবুজে ঘেরা, মসজিদ, কবরস্থান, পুকুর, স্কুল—একটু সামনে গেলে ফারুকী পাড়া। ফারুকী পাড়ার বাতিঘরখ্যাত মিয়া আবু মোহাম্মদ ফারুকী। কলেজজীবন থেকে তাঁকে চিনতাম একজন কলামিস্ট হিসেবে। সাপ্তাহিক বীর চট্টগ্রাম মঞ্চ ও মাসিক পটিয়াসহ চট্টগ্রামের জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় কলাম লিখতেন। ওনাকে প্রথম যেদিন দেখেছি, শুভ্র বর্ণের দাড়িওয়ালা, চশমা পরা বর্ষীয়ান এক রাজনীতিবিদ, ভাষাসৈনিক সহজ সরল বিনয়ী একজন মানুষ। একদিন তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য গ্রামে হাজির। মিয়া ফারুকী চাচাকে সালাম দিয়ে পরিচয় দেওয়ার পর বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কুশলাদি জানার পর নিজের সংগ্রহশালায় বসালেন।

আড্ডার ফাঁকে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আপ্যায়ন করানোর জন্য। ফারুকী চাচা বেশ অতিথিপরায়ণ। সংগ্রহশালাটির বুকশেলফে থরে থরে সাজানো বই। গ্রামে এত সুন্দর নিজস্ব পাঠাগার খুব কমই আছে। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাগুলো সংগ্রহ করে কোট ফাইলের মধ্যে সাজিয়ে রেখেছেন, ফাইলের ওপরে পত্রিকার নাম কাটিং করে রেখেছেন। নিভৃতচারী মানুষটি যে বইপোকা, দেখে বোঝা যায়। বাড়িতে বসে তিনি লেখেন, অবসরে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে খুনসুটি করতেন। বেলাবিস্কুট, নিমকি, চনাচুর সঙ্গে ধোঁয়া ওঠা চা এসে হাজির। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, ‘রশীদ এনাম, একদিন আমি থাকব না; আমার পাঠাগার এবং সংগ্রহশালাটি থেকে যাবে কালের সাক্ষী হয়ে।’

১৯৩৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মিয়া ফারুকী পটিয়া চক্রশালা গ্রামে (বর্তমানে কচুয়াই ইউনিয়ন) জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শিক্ষাবিদ মাওলানা খলিলুর রহমান ফারুকী, মাতা সফুরা খাতুন। পিতা চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুলের ধর্মীয় শিক্ষক ও নিখিল ভারত কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন। সে সুবাদে পড়ালেখার হাতেখড়ি গ্রামে হলেও ম্যাট্রিক পাস করেন মিউনিসিপ্যাল স্কুল থেকে। পরে রাজনীতি, সংগঠন, বই পড়া এবং বাবার লাইব্রেরি দেখাশোনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ১৯৬১ সালে খালাতো বোন রোকেয়া বেগমকে বিয়ে করেন। দুই ছেলে ও পাঁচ মেয়ের জনক, সবাই প্রতিষ্ঠিত। মিয়া ফারুকীর বাবা ছিলেন একজন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী ও মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর সহযোদ্ধা। স্কুলবেলা থেকে বাবার সহযোদ্ধাদের সহবতে তাঁর মধ্যে বিপ্লবী, দেশপ্রেম মানবিক গুণাবলি বাসা বাঁধে। ১৯৪৯ সালের কথা, ছাত্রজীবন থেকে মুসলিম লীগ (পরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ) স্থানীয় ইউনিয়ন কমিটিতে যোগদান করেন। পরে মহকুমা, চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে তাঁর পদচারণ।

মিয়া আবু মোহাম্মদ ফারুকীর কবর
ছবি: লেখক

১৯৫২ সালে ঢাকায় ভাষা আন্দোলন শুরু হলে তিনি এবং প্রয়াত ন্যাপ নেতা আবুল মাসুদ চৌধুরী, রিজুওয়ানুল কবির আনছারীসহ আরও বেশ কয়েকজন বন্ধু মিলে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনসহ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সবাই মিলে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য পটিয়ায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে পটিয়া আদর্শ স্কুল ও রাহাত আলী স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে রাজপথে আন্দোলন করেন।

চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায় নিজেদের ‘চট্টল লাইব্রেরি’ ছিল, যেখানে সন্ধ্যায় আড্ডা বসত। আড্ডায় চট্টগ্রামের তৎকালীন প্রবীণ রাজনীতিবিদ আতাউর রহমান খান কায়সার, এম এ হান্নান, এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, বাঁশখালীর সুলতান আহমেদসহ অনেকে থাকতেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও এই লাইব্রেরিতে এসেছিলেন। মিয়া ফারুকী ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬–এর  ছয় দফা আন্দোলন, ’৬৯–এর গণ-অভ্যুত্থানের সময় প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে সরাসরি ভূমিকা রাখেন।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে মিয়া ফারুকী বলেন, ‘চারদিকে কারফিউ, পাকিস্তানি বাহিনীরা যখন স্টিমরোলার, গণহত্যা, বাড়িঘর জ্বালাও–পোড়াও শুরু করে; মার্চের শেষের দিকে পটিয়ায় পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গঠন শুরু হয়। ১৬ এপ্রিল পটিয়ায় পাকিস্তানিরা বোমা হামলা করলে বেশ কয়েকজন আহতসহ অন্তত ২০ জন শহীদ হন।’ তিনি আরও বলেন, ‘একসময় আমরা অনেকে মিলে ধোপাছড়ি পাহাড়ে আত্মগোপন করি। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতাসহ সংগঠন করে দেশ রক্ষার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করি। ২৪ মে পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের বসতবাড়িতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক থাকায় আমাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই। ১১ ডিসেম্বর গ্রামের পাকিস্তানি দালালেরা আবদুল সাত্তার, কামাল, হাকিম ও খাতুনি বেগমকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। পাকিস্তানিদের সঙ্গে মিলে তারা খুন, ধর্ষণ ও পাশবিক নির্যাতন শুরু করে। সে ভয়াবহ দুঃসহ স্মৃতি মনে পড়লে আজও শরীরের পশম দাঁড়িয়ে যায়, বুকে আগুন জ্বলে। পাকিস্তানি এবং রাজাকারদের প্রতি ঘৃণার সৃষ্টি হয়।’

গ্রামে সবাই মিয়া ফারুকীকে সমাজসেবক ও মানবিক লেখক হিসেবে সম্মান করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও নিভৃতচারী এই মানুষ কখনো বীর মুক্তিযোদ্ধা কিংবা ভাষাসৈনিকের স্বীকৃতি চাননি। ২০০৪ সালে নেওয়া সাক্ষাৎকারটি ছবিসহ ডায়েরির পাতায় খুঁজে পেলাম। মাঝখানে কতগুলো বছর পেরিয়ে গেল। একদিন শুনলাম, তিনি গুরুতর অসুস্থ। দেখতে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ঢাকায় থাকার কারণে আর যাওয়া হয়নি। ২০১৬ সালের ১ জুলাই তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।

পটিয়া বাইপাস সড়ক পেরিয়ে একটু সামনে গেলেই ছোট একটা দিঘির পাশে কবরস্থান। মিয়া ফারুকীর সমাধিটি সবুজ ঘাসে ঢাকা। কচুয়াই আজিমপুর গ্রামে যাওয়ার পথে মিয়া ফারুকী চাচার এপিটাফটা চোখে পড়ে। জলছবির মতো চোখের সামনে ভেসে ওঠে নিভৃতচারী ভাষাসৈনিক মানুষটির চেহারা। ওনার বড় ছেলে আলোকচিত্রী শোয়েব ফারুকীর কাছে জানতে চাইলাম, ‘চাচা কি বীর মু্ক্তিযোদ্ধা বা ভাষাসৈনিকের স্বীকৃতি পেয়েছিলেন?’ শোয়েব ভাই অভিমান করে বললেন, ‘ভাষাসৈনিক বা বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দূরের কথা, পটিয়ার সাবেক এক জনপ্রতিনিধি বলেছিলেন, বাবার নামে সড়কের নামকরণ করে দেবেন। কেউ কথা রাখেননি।’

মিয়া আবু মোহাম্মদ ফারুকীরা ছিলেন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। তাঁর অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকীতে জনপ্রতিনিধিদের কাছে একটাই চাওয়া, মিয়া আবু মোহাম্মদ ফারুকীকে স্বীকৃতি ও তাঁর নিজ গ্রামে সড়কের নামকরণসহ পাঠাগার ও সংগ্রহশালাটি সংরক্ষণ করা হোক।

বন্ধু, চট্টগ্রাম বন্ধুসভা