বন্ধু! ভয় কি তোর!

রাজধানীর বিজয় স্মরণীতে মানুষের ঢলছবি: জাহিদুল করিম

জীবদ্দশায় রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর, বিশেষ করে একক কোনো আন্দোলনকে কেন্দ্র করে, এত অল্প সময়ে, এত জীবনের ক্ষয় আমাদের দেখতে হয়নি। এত মৃত্যু, এত কান্না, এত দীর্ঘশ্বাস আর হাহাকারে ভারী বাতাসে নিশ্বাস নেওয়াই বোধ হয় দায়! সবারই তো তা-ই! যে বাবা সন্তান হারায়, যে মায়ের কোল খালি হয়, যে ভাই তার বোনকে রেখে আসে কবরে, যে বোন তার ভাইকে কী কথায় আমরা সান্ত্বনা দেব তাকে!
সময়ের চোরা স্রোতে যেন সময় থমকে আছে! তীব্র আর্তনাদ আর বুকফাটা কষ্ট চেপে তবু আমরা এখনো স্বপ্ন দেখি আগামীর, অসম্ভব সুন্দর এক আগামীর; এক নির্মাণের, হীরকোজ্জ্বল আলোকিত ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের। মানুষকে তো আশা নিয়েই বাঁচতে হয়! জীবনটা আর কত বড়! কতটাইবা রাঙানো যায় একটা জীবন! অন্যের তরে কাজের মধ্য দিয়েই তো বেঁচে থাকে মানুষ। যে মুগ্ধ ‘পানি লাগবে, পানি!’ বলে ক্লান্ত শরীরটা টেনে বেড়াচ্ছিল, সেই মুগ্ধ কি জানত, খানিক পরই তার রক্তভেজা শরীরটা বয়ে বেড়াবে হয়তো তার কাছ থেকেই পানি নিয়ে তৃষ্ণা মেটানো কেউ! তবু মুগ্ধরা মুগ্ধতা ছড়িয়ে স্বেচ্ছাসেবায় কমতি রাখে না। আরও এমন শত বীরের গল্পগাথাতেই রচিত হয় সুন্দর আগামী।
জানি, আর্তনাদ আর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকা কতটা কঠিন! কতটা ভারী—দীর্ঘ মৃত্যুর সারি পাড়ি দিয়ে সব স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়া।

হয়তো একটা সময় সব খুব স্বাভাবিক নিয়মেই চলবে। পৃথিবী কখনো শূন্যস্থান রাখে না। কেউ না কেউ তা পূরণ করেই। কিন্তু জীবনের শূন্যতার কী কোনো পূর্ণতা আছে? হয়তো নেই, হয়তো আবার আছে! যেসব কর্মবীরের আত্মত্যাগে একটি সুন্দর আগামীর স্বপ্ন রচিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়, তাদের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখা, সেগুলো পূরণ করাও তো সেই কর্মবীরের পূর্ণতা! নিশ্চয়ই আকাশের তারা হয়ে সেসব শহীদ আমাদের কাজগুলো দেখবে! দেখবে, কতটা ভালো রাখতে পেরেছি তার রেখে যাওয়া দেশটাকে।
দুঃসময় কেটে যাবে, অশান্ত ক্ষণ বদলে যাবে, কিন্তু যদি নিজেই বদলাতে না পারি, তাহলে দুঃসময়ে যারা আমাদের হয়ে লড়েছিল, তাদের লড়াইয়ের প্রতি কী দিয়ে সম্মান জানাব আমরা? তাই সময়ের সব কাঁটা উপড়ে ফেলে, সময়ের সব ক্ষোভ কেটে গেলে, নতুন এক লড়াইয়ের জন্য আমাদের এখনই প্রস্তুত হতে হবে। প্রস্তুত হতে হবে, সেই আগামীর জন্য, যার জন্য লড়েছিল বীর তরুণেরা।
বন্ধুত্বের আহ্বানে হাত বাড়াতে হবে বন্ধুর প্রতি। চারপাশের সবাই তো আমার বন্ধু! তাদের বিপদে, তাদের সংকটে পাশে দাঁড়ানোই তো বন্ধুত্বের দাবি। বন্ধু তো সেই, যে সুসময়-দুঃসময়, সব সময়ই পাশে থাকে, হাতটা ধরে রাখে। বলে—বন্ধু! ভয় কি তোর আমি তো আছি!
বন্ধু! আসুন, নিজের জন্য, মানুষের জন্য যা ভালো, সেই কাজটাই করি, দেশের তরে সর্বোচ্চটা দিয়ে লড়ি। সেই লড়াইয়ে আমার-আপনার ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা থাকতে পারে, কিন্তু লড়াইটা হতে হবে, ন্যায়ের, সাম্যের, সততার আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলীয়ান হয়ে সব অন্যায় আর অসমতার বিরুদ্ধে; যা কিছু ভালো, তার পক্ষে। আমাদের সময় ফুরোয়নি, কিচ্ছু শেষ হয়ে যায়নি, সামনে পড়ে আছে অফুরন্ত সম্ভাবনাময় এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। আসুন, ব্যক্তিক ও সামষ্টিকভাবে সামর্থ্যের সেরাটা দিয়েই নিজেকে প্রস্তুত করি, গড়ে তুলি। নিজ ও আশপাশের সবার সুস্থতা ও নিরাপত্তা ‘অগ্রাধিকার’ বিবেচনায় নিয়ে, সর্বদা স্বেচ্ছাসেবার যে আদর্শ আমরা লালন করি, তার তো ক্ষয় নেই! মানুষের জন্য, মানবতার তরে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার যে আনন্দ, তার কি কোনো বিকল্প হয়!