হে আমার প্রিয় মাতৃভূমি

কবি শামসুর রাহমানছবি: সংগৃহীত

জন্মভূমিকে ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হয়
ফুল ফোটা ভোর
পাখির কণ্ঠে সূর্যোদয়
পালকে আঁকা ভালোবাসা
মায়াময় সকালের গর্ভ থেকে উঁকি দেওয়া অঙ্কুর
ছিন্ন তরণী, এলোমেলো স্বপ্নের ধোঁয়াশায়
নারীর বুকের উষ্ণতা ছেড়ে
নকশি কাঁথায় বোনা শিল্পের ঘেরাটোপ ছেড়ে হারিয়ে যেতে
কষ্ট হয়, খুবই কষ্ট হয়
হয়তো জন্মভূমির বুকে স্ফটিক স্বচ্ছ জলে
অথবা কুয়াশায় মাটির বুকে মাটি হয়ে মিলিয়ে যাওয়া
হয়তো একজন্মের তরে ঘুমিয়ে পড়া মহাকালের বহু জন্মকে সাক্ষী রেখে
কমলে কমলে চুম্বন চিহ্ন
পাপড়িতে পাপড়িতে শিশির বিন্দু
তবু আমি জেগে উঠি
রাতের অন্ধকারে ভারী বুটের শব্দ হয়
আমার স্বাধীনতার দুয়ারে এসে
হিংস্র উদ্ধত রাইফেল হাতে ওরা লাথি মারে
তবু আমি জেগে উঠি

আতঙ্কিত নারীর ঘরে এসে মাটির কলসি ভেঙে চুরমার
ওরা করে যায় বলাৎকার
চারিদিকে লাশ আর লাশ, আমার ভাই আর বোনের
কচি কচি শিশু, আবাল–বৃদ্ধ–বনিতার লাশের পচা গন্ধ
আমার পেট গুলিয়ে উঠে বমি পায়
আমার দুচোখে জন্মান্ধের জ্বালা
আমার মাথা ভন ভন করে ওঠে
তবু আমি চিৎকার করে উঠি
তবু আমি অভিশাপ দিয়ে যাই
ততক্ষণে আমার দিকে ঘুরে গিয়েছে বন্দুকের নল
হে জন্মভূমি তোমাকে সাক্ষী রেখে আমি ভয় পাইনি
হে আমার মাতৃভূমি আমার মায়ের চরম অপমানের যোগ্য জবাব
উচিত শিক্ষা দিতে আমি সর্বক্ষণই প্রস্তুত
নির্মম নির্দয় স্বৈরাচারের ভাষা আমাদের ভাষা নয়
তোমরা কেন, কাদের ভয়ে দেশান্তরী হতে চাও?
এই দেশটা তোমার আমার আমাদের সকলের রক্ত দিয়ে গড়া
আমাদের ভাষা, আমাদের বর্ণমালা কারও কাছে দাসখত লিখে দেয়নি
তবু যদি অনাচার হয়, তবু যদি অবিচার হয়
তবু যদি মানবতার মানহানি ঘটে, মরণেও শান্তি নেই
আমি জন্ম নিই, প্রতিটি ক্ষণে ক্ষণে জন্ম নিই
হে আমার প্রিয় মাতৃভূমি আমি তোমার কোলে ঘুমিয়ে আছি মাত্র