চৈত্রসংক্রান্তি ও বাঙালির লোক উৎসব

চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের চড়কপূজাসহ নানা আয়োজন রয়েছেছবি: মঈনুল ইসলাম

বাংলা ও বাঙালির সর্বজনীন উৎসব চৈত্রসংক্রান্তি। বাংলা বছরের অন্তিম দিবসও এটি। বসন্তকে বিদায় জানিয়ে গ্রীষ্মের সূচনা হয় চৈত্রসংক্রান্তির মাধ্যমে। এ যেন বাংলা নতুন বছর আসার প্রতীক্ষাপ্রহর। চৈত্রসংক্রান্তিকে ঘিরে প্রচলিত আছে বহু লোকাচার থেকে শুরু করে পূজা–অর্চনা ও বিভিন্ন সামাজিক বিধি–বিধান। এসব আচার–অনুষ্ঠান হিন্দু, মুসলিমসহ পুরো বাঙালি সমাজে ব্যাপক সমাদৃত। লোককথায় প্রচলিত আছে, চৈত্র মাস এবং শেষ দিন যেহেতু সংক্রান্তি, তাই এই দুই শব্দ মিলে হয়েছে চৈত্রসংক্রান্তি। পঞ্জিকামতে, এই দিনই বিগত বছরের পঞ্জিকার অবসান হয় এবং পরদিন পয়লা বৈশাখ থেকে নতুন বছরে নতুন পঞ্জিকার ব্যবহার শুরু হয়।

প্রাচীন লোককাহিনিতে প্রচলিত আছে, মহারাজ দক্ষ তাঁর ২৭ কন্যার নামকরণ করেছিলেন ২৭টি নক্ষত্রের নামে। তন্মধ্যে দক্ষ রাজের দুই কন্যার নাম ছিল চিত্রা ও বিশাখা। কালক্রমে চিত্রা ও বিশাখা নাম দুটি রূপান্তরিত হয়ে চৈত্র ও বৈশাখ নামে পরিচিতি লাভ করে। এমন কাহিনি এপার ও ওপার, দুই বাংলায়ই প্রচলিত রয়েছে। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে বিভিন্ন আচার–অনুষ্ঠানের প্রচলন রয়েছে।

শাকান্ন উৎসব: গ্রামবাংলার বউ-ঝিরা প্রথা মেনে ঝাড় থেকে ১৪ প্রকারের শাক তুলে আনতেন। সেই শাক রান্না করে খাওয়া হতো। আজও দুই বাংলার অনেক স্থানে এ প্রথার প্রচলন রয়েছে। এ ছাড়া চৈত্রসংক্রান্তির দিন নিরামিষ খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। এদিন বাস্তুভিটায় মাছ–মাংস আনা নিষেধ।

হালখাতা: প্রাচীনকাল থেকে জমিদারি খাজনার হিসাব-নিকাশ হতো চৈত্রসংক্রান্তির দিনে। এরপর বৈশাখের প্রথম দিন নতুন খাতায় সেই হিসাব তোলা হতো এবং প্রজাদের মিষ্টিমুখ করানো হতো। পরবর্তীকালে এই হালখাতার চল বিভিন্ন বাণিজ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামবাংলায় আজও মানুষ এই হালখাতার আনন্দ নিয়ে মেতে থাকে।

গমের ছাতুর শরবত উৎসব: এদিন যেমন খাজনার নতুন হিসাব হতো, তেমনি এর পরদিন গ্রামে গ্রামে গমের ছাতু, দই ও পাকা বেল দিয়ে তৈরি বিশেষ একধরনের শরবত খাওয়ার প্রচলনও বহুকাল থেকে।

তালতলার শিরনি: চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে গ্রামবাংলার আরও এক বিশেষ উৎসব তালতলার শিরনি। এদিন প্রতিটি বাড়ি থেকে চাল ও তালের গুড় সংগ্রহ করা হতো। যেসব বাড়িতে এসব উপকরণ থাকত না, তারা নগদ অর্থ-কড়ি দিত। এরপর গ্রামের কোনো একটি তাল বা বটগাছের নিচে এসব উপকরণ একত্রে মিশিয়ে তৈরি হতো শিরনি, যা তালতলার শিরনি নামে পরিচিত।

নীল উৎসব: একজন শিব আরেকজন পার্বতী সাজেন, এদের সঙ্গে একজন পাগল সাজেন; এরপর একদল লোক খোল-করতাল, ঢাক-ঢোল, মৃদঙ্গসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে শিব-পার্বতীর গান গেয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ান। এই সং সাজার উৎসবকে নীল উৎসব বলে।

গম্ভীরাপূজা: বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বরেন্দ্র অঞ্চলগুলোয় চৈত্রসংক্রান্তির দিন এখনো গম্ভীরাপূজার প্রচলন রয়েছে।

বিজু বা বৈসাবি উৎসব: বাংলাদেশের চাকমা সম্প্রদায়ের লোকজনের অন্যতম প্রধান পর্ব হলো, বিজু বা বৈসাবি উৎসব। বিজু বা বৈসাবি উৎসব পালিত হয় দুই দিন ধরে। এদিন সকালবেলায় বুদ্ধের মূর্তিকে স্নান করানো হয়। ছেলেমেয়েরা নদী বা বৃহৎ জলাশয় থেকে জল বয়ে এনে তাদের দাদু-দিদিমাকে স্নান করিয়ে আশীর্বাদ নেয়।

পাজন উৎসব: পাজন হলো নানা রকম সবজির মিশালি একধরনের তরকারি। এই দিনে বাড়িতে যেসব বন্ধুবান্ধব বা অতিথি আসেন, তাঁদের এই পাজন দিয়ে আপ্যায়ন করে চাকমারা। এটা ওদের রীতি। তাদের ধারণা, বছরের শেষ দিনে সব ধরনের সবজি দিয়ে তরকারি খেলে মঙ্গল হয়।

ত্রিপুরায় চৈত্রসংক্রান্তি: চৈত্রসংক্রান্তির আগের দিন ত্রিপুরায় বসবাসকারী মানুষজন বাজার অথবা পাহাড় থেকে ফুল সংগ্রহ করেন। চৈত্রের শেষ দুই দিন ও বৈশাখের প্রথম দিন ত্রিপুরায় পালিত হয় বৈসু উৎসব। এই দিনে এখানে পিঠাপুলির ব্যাপক আয়োজন করা হয়।

বিশ্বের বিভিন্ন বাংলাভাষী মানুষের কাছে দিনটি অক্ষয় তৃতীয়া নামেও পরিচিত। বাঙালি হিন্দু সমাজে অক্ষয় তৃতীয়া উপলক্ষে বিভিন্ন পূজা-পার্বণের আয়োজন করা হয়। চৈত্রসংক্রান্তি আজও অঞ্চল ভেদে নানা আনুষ্ঠানিকতা ও জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয়।

নওগাঁ সদর, নওগাঁ