আমার ডায়াবেটিক চা

চা, প্রতীকীছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

বাংলা ভাষায় কবিতা লিখি। থাকি পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া বালীতে। প্রথম আলো বন্ধুসভাতে নিয়মিত আমার কবিতা এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে লেখা প্রকাশিত হয়। চাকরি করি কলকাতার স্ট্র্যান্ড রোডে গুজরাটি একটা বিয়ারিং অ্যান্ড মেশিনারি পার্টস বিক্রির সংস্থায়।

৩০ বছর বয়স থেকে আমার রক্তের শর্করার পরিমাণ বেশি। ১০ বছর শুধু ওষুধ খেয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেছি। এরপর থেকে ডাক্তারবাবু রাতে একবার করে ইনসুলিন চালু করলেন।
সিগারেট, বিড়ি, পান বা মধ্যপান—এ ধরনের কোনো নেশা নেই। গরিব উদ্বাস্তু সন্তান হওয়ায় এ ধরনের নেশা ধরার মতো পয়সাও কোনোকালে থাকতো না পকেটে। মগজ পুড়িয়ে লেখালেখি করা মানুষ, একটা নেশা তাই কখনো ছাড়তে পারিনি। তা হলো চা পান করা।

রক্তে সুগার ধরা পড়ার পর থেকে প্রথমে চা-তে চিনি খাওয়া বন্ধ করলাম। চিনি ছাড়া দুধ চা এখনো পান করি। তবে দুধ মেশানো চা পরিমাণে একটু কম। এদিকে কাজের জায়গায় দশটা-আটটা চাকরিতে মাথার ওপর অনেক ঝক্কি, ঝামেলা, চাপ। দিনভর চা ছাড়া চলে না।

অফিসে সারা দিন চা দিয়ে যায় সুরিন্দর নামের এক অবাঙালি চা–বিক্রেতা। সুরিন্দর, ওর ছেলে কৃষ্ণা এবং রাহুল মিলে চা বানায়, নিজেরা এবং কাজের ছেলে মারফত আমার অফিসসহ অন্য অফিসে বিলি করে। ৬ টাকা করে মাটির ভাঁড়ে বা কাগজের কাপে এক কাপ করে দাম নেয়। কফির জন্য নেয় কুড়ি টাকা। অফিসে নিজেদের কর্মী তো রয়েছেই, বাইরের খরিদ্দার বা অতিথি আপ্যায়নের জন্যও লাগে। সব মিলিয়ে রাতে ওদের গড়ে দৈনিক ৬০০ টাকা করে মিটিয়ে দিই। আমাদের অফিসের আবার বড় হেড অফিস, গোডাউন অনেক শাখা আছে। আমি যেহেতু সংস্থার ক্যাশিয়ার, টাকা-পয়সা দেখাশোনা করি; সেখানে চায়ের টাকাও প্রতিদিন পরিশোধ করতে হয়। সেখানে অন্য বিক্রেতারা চা দেয়। হেড অফিস ডায়মন্ড হেরিটেজ নামের একটা বড় বিল্ডিংয়ের ছয় তলায়। সেখানে ৬০ জনের মতো কর্মী চাকরি করে। উন্নত অফিস এলাকা বলে চায়ের দামও কাপ প্রতি ১০ টাকা।

স্ট্র্যান্ড রোডে কোম্পানির বিক্রয়কেন্দ্রের খরিদ্দার মুটিয়া মজদুর পরিবৃত এঁদো গলির সুরিন্দর এবং ওর ছেলেরা শুধু আমার জন্য একটা নতুন ডায়াবেটিক চায়ের ব্যবস্থা করেছে। প্রথমে শুধু রং চা দিত। কিন্তু সারা দিন সবাই মিষ্টি চা, মিষ্টি কফি খায় আর আমার জন্য শুধু চা পাতা সেদ্ধ করে পাঠানো ওদের ভালো লাগত না। কাজের জায়গায় খাজাঞ্চি বাবুরা অবশ্য সবার কাছে একটু বেশি নজর পায়।

স্পেশাল ডায়াবেটিক চাটা হলো একধরনের লেবু–চা। স্বাদ আবার একেবারে ভিন্ন। চা পাতা ফুটানোর সময় তাতে সামান্য আদা থেঁতো করে দেয়। কাপে নিয়ে লেবুর রস দেয় এবং জলজিরা নামের একটা গুঁড়ো পাউডার দোকানে কিনতে পাওয়া যায়, পরিমাণ মতো সেটা মিশিয়ে দেয়। এই অন্য ধরনের চায়ের জন্য ওরা মূল্য ধার্য করেছে ১৫ টাকা। সকালে চা বানানো শুরু করার আগে ওদের দেখি অনেকগুলো লেবু কেটে রস একটা বোতলে ভরে রাখে। লেবু কচলে সারাদিন যাতে কাপে কাপে দিতে না হয়।

লেখকের ডায়াবেটিক চা
ছবি: লেখক

জলজিরা জিনিসটা হলো একটা হজমি পাউডার। সবাই জলের সঙ্গে মিশিয়ে খায়, স্বাদ হলো হাজমোলা বা কিছুটা সৈন্ধব লবণের মতো। বাংলাদেশেও নিশ্চয়ই পাওয়া যায়। প্রথম প্রথম যখন এই চা খেতাম, মনে হতো যেন আয়ুর্বেদিক কোনো টনিক খাচ্ছি। ছোটবেলায় চট্টগ্রাম শহরে সাধনা ঔষধালয় থেকে আমাদের বাসায় নিয়মিত হজমি টনিক আনা হতো। সেই টনিকের স্বাদও মনে পড়ে যায়।

যা হোক, ধীরে ধীরে জলজিরা মেশানো চিনি ছাড়া লেবু চা খেতে ভালো লেগে গেল। কখনো কখনো ওদের একটু বারণ করি জলজিরাটা কম দিতে। লবণের পরিমাণ বেশি হলে আবার অন্য রকম সমস্যা হতে পারে। ওরা ভালোই বানায়। চা বানানোটা ওদের বংশগত পেশা। বাড়িতে বানালে হয়তো এই স্বাদ পাব না।

জীবন যখন আমার মিষ্টিহীন, এধরনের স্পেশাল চা খাওয়া ছাড়া আর উপায় কী? দুপুরে টিফিনের পর এক কাপ চা ঘুম আসে না চোখে। বিকেলে বা সন্ধ্যার দিকে চা সারাদিনের কাজের ক্লান্তি কেটে যায়। অফিসে ঢুকে মাত্র এক কাপ চা কাজ শুরু করার আমেজ এনে দেয়। বাড়ি ফিরে বোনের হাতে মুড়ি চানাচুরের সঙ্গে এক কাপ চা না খেলে লেখালেখির ভাবনাটা আবার শুরু হবে না। রবিবার বাড়িতেও সারা দিন বোন আমাকে বহুবার লাল চা বা চিনি ছাড়া দুধ চা বানিয়ে এনে দেয়।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত