ঘরে ফেরার দিনগুলো

ঘরে ফেরা। প্রতীকীছবি: রাকিবুল ইসলাম

ঈদের ছুটি ঘনিয়ে এলে বেশ চনমনে হয়ে যাই। উত্তেজনা বিরাজ করে নিজের মধ্যে। বাঁধনহারা পাখির মতো ওড়াউড়ি করতে থাকি এদিক-ওদিক। সবার খবর নিই। কবে ছুটি হচ্ছে? কবে বাড়ি যাবে? কীভাবে যাবে? ইত্যাদি ইত্যাদি। যে আমি সারা বছর তেমন কারোর খবর নিই না, সেই আমি এই সময় হয়ে উঠি সেরা যোগাযোগকারী। কিন্তু এবার ঈদের আগের দিনগুলো খুব বিষণ্নতায় কেটেছে। বিষাদের এক চাদর মুড়িয়ে রেখেছিল পুরোটা সময়। অফিস, আহার, ঘুম কোনো কিছুতেই মন লাগাতে পারিনি। বুকের মধ্যে জেঁকে বসে থাকা বিষাদগুলো দীর্ঘশ্বাস হয়ে বাতাসে মিশে গেছে।

ছুটির দিন যত ঘনিয়ে আসছিল, বিষাদের মাত্রা তত গভীর হচ্ছিল। এত দিন যাঁদের খবর নিয়ে এসেছি, তাঁরা নিজ থেকে খবর নিচ্ছিল; ছুটি কবে? বাড়ি কবে যাব? কিন্তু আমার ঠিকভাবে জবাব দিতেও ইচ্ছে করছিল না। আসলে সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। বিপত্তি বাঁধল, যখন ছোটভাই কল করে করুণ কণ্ঠে বলল, ‘এই ঈদে ওর ছুটি হবে না।’ শুনেই সব আনন্দ-আহ্লাদ বিষাদের চাদরে ঢেকে যায়। ও শুধু আমার ছোট ভাই-ই না, আমার সন্তানের মতো। অল্প বয়সেই মা-বাবা হারিয়েছে। ওকে কোলেপিঠে করে বড় করেছি। কয়েক বছর আগেও সে আমার বুকের সঙ্গে লেপ্টে ঘুমিয়েছে। ওর ভালো-মন্দ, আনন্দ-বেদনার সমস্ত খবর আমার জানা। যে ছেলেটা ঈদের ছুটিতে প্রজাপতির মতো নেচে বেড়ায়, সেই ছেলেটা ঈদে ছুটি পাবে না, এমনকি ঈদের দিনও তাকে কাজের দায়িত্ব পালন করতে হবে। এটা মেনে নেওয়া তো দূরের কথা, ভাবনাতেও আনতে পারিনি।

বিষাদে বুঁদ হয়ে দিন কেটে যাচ্ছে। ছোট ভাইয়ের জন্য কিছু করতে পারছি না ভেবে নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল। অজানা এক ভয়ে ওকে মেসেজ কিংবা কল করার সাহসও পাচ্ছিলাম না। কল দিয়ে কী বলল? কী বলে সান্ত্বনা দেব? ভেতরে যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে, কিছুই ওকে আঁচ করতে দিচ্ছিলাম না। জানি, এসব আঁচ করতে পারলে ওর কষ্ট আরও বেড়ে যাবে। শুধু আকাশের দিকে মুখ করে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছিলাম। বলছিলাম, ‘আপনি নিশ্চয় ভেতরের খবর জানেন। কী ঝড় ভেতরে বয়ে যাচ্ছে, তা আপনার অজানা নয়। আপনি যা সহজ করেন, তা-ই আমাদের জন্য সহজ হয়ে যায়। আপনি চাইলে, কঠিনতর বিষয়কেও করে দিতে পারেন অতি সহজ। আমি কোনোভাবেই আমার ভাইকে ছাড়া ঈদের আনন্দ গায়ে মাখতে পারব না, কোনো খাবার খেতে পারব। আপনি তো জানেন, ও সারাক্ষণ আমার সঙ্গেই লেপ্টে থাকে। ওকে রেখে বাড়িতে গিয়ে কীভাবে মন বসাব? আপনি আমাদের ঈদ আনন্দে রং ছড়িয়ে দিন।’ দিনরাত শুধু এই প্রার্থনা করে গেছি।

দুই সপ্তাহে ওর সঙ্গে আমার দুই থেকে তিন দিন কথা হয়েছে। এর মধ্যে একদিন সে জানাল, ১২ তারিখ বুধবার চূড়ান্ত হবে ছুটির বিষয়। আমি বুধবার সারাদিন প্রার্থনায় ডুবে রইলাম, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতে ওর কল পেলাম। প্রবল হৃদ্‌স্পন্দন নিয়ে কল রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে খবর এল, ওর ছুটি হয়েছে। ১৩ তারিখ অফিস করেই ছুটি! আমার চোখে অশ্রু। শেষ কবে এরকম আনন্দমাখা খবর পেয়েছি মনে নেই। অশ্রুসিক্ত মুখ থেকে রবের শুকরিয়ার বেড়িয়ে এল আলহামদুলিল্লাহ্!

শুরু হলো ব্যস্ততা; নিজের জন্য কেনাকাটা, পারলারে লম্বা সিরিয়ালে থেকে চুল ঠিক করা, ফেশিয়াল করা, ব্যাগ গোছানো ইত্যাদি। ভাইয়া পূর্বেই গাড়ি ঠিক করে রেখেছিলেন। শুক্রবার বাদ ফজর বাড়ির উদ্দেশে ঢাকা ছেড়ে যাব। যথারীতি ফজরের নামাজ শেষ করে তৈরি হয়ে বসে আছি। কিন্তু গাড়ির দেখা মিলছে না। সকাল আটটায় ভাইয়া কল করে জানাল, পথে গাড়ির টায়ার পাঞ্চার হয়ে গেছে। আশপাশে কোনো গ্যারেজ খোলা নেই। গাড়ি ঠিক হতে দুপুর হয়ে যাবে। তাই আমরা জুমার পর রওনা করব। কল কেটে ঘুমিয়ে গেলাম।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল, গাড়ির দেখা নেই। ভাইয়াকে কল দিলাম। ভাইয়া বলল, ‘গ্যারেজ না খোলায় গাড়ি ঠিক করা যায়নি। নতুন গাড়ির খোঁজ করছি। গাড়ির ব্যবস্থা হলে বাদ মাগরিব বের হব।’ অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে একটি গাড়ির ব্যবস্থা হলো। রাত আটটায় শুরু হলো আমাদের যাত্রা। রাস্তার জ্যাম ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছি বাড়ির পথে। কিছুক্ষণ পর পর সজীব কল করে খবর নিচ্ছে। সজীবই আমার ছোটভাই। দীর্ঘ জার্নি শেষে রাত তিনটায় গন্তব্যে পৌঁছালাম।

বাড়িতে দুই ভাতিজা সুফিয়ান, সাফওয়ান আর ওদের মা থাকে। এত বড় বাড়ির প্রায় পুরোটাই ফাঁকা পড়ে থাকে। আমরা রুটিরুজির তাগিদে পড়ে থাকি জাদুর শহরে। সুফিয়ানের জন্ম থেকে শুরু করে বেড়ে ওঠার অনেকটা সময় আমি সঙ্গে ছিলাম। ও আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। বাড়িতে গেলে সারাক্ষণ আঠার মতো লেগে থাকে। চলে আসার সময় কেঁদেকেটে বুক ভাসায়। সাফওয়ানের জন্মের বেশ আগেই বাড়ি ছেড়েছি। ও আমাকে বছরে চার-পাঁচ দিনের বেশি কাছে পায়নি। ভাবতাম, আমার প্রতি ওর মায়া জন্মাবে না। কিন্তু ধারণা একদম ভুল। ছুটির দিনগুলোতে সে আমাকে এক মুহূর্তের জন্যেও চোখের আড়াল করতে চায়নি। ওয়াশরুমে গেলেও দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছে। বাবাই, বাবাই ডেকে মনের দখলদারিত্ব নিয়েছে।

আমি, সজীব, সুফিয়ান আর সাফওয়ান ঈদের ছুটিগুলো বেশ উপভোগ করেছি। এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়িয়েছি, একসঙ্গে কার্টুন দেখেছি, পরিবারের সবাই মিলে খাবার খেয়েছি, গল্প-আড্ডায় মেতে উঠেছি। মনে মনে চাইছিলাম, যদি এই অবসরের সময়গুলো আর একটু দীর্ঘ হতো, তাহলে আরও কিছু সময় মায়ায় জড়িয়ে পার করা যেত। কিন্তু অবসর ফুরিয়ে প্রাণের মেলা ভাঙল। অনিচ্ছায় পেছন থেকে টেনে ধরা মায়ার বাঁধন আলগোছে আলগা করে ফিরতে হলো জাদুর শহরে।

ব্লক-জি, বনশ্রী, ঢাকা