সেই মেয়েটি

গল্পটি ২০২৪ সালের জুনে প্রকাশিত বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের ‘তারুণ্য’ ম্যাগাজিনের দশম সংখ্যা থেকে নেওয়া।

অলংকরণ: অভিনয় আহমেদ

শিক্ষাজীবনের বিভিন্ন পরীক্ষার রেজাল্ট বিবেচনায় আমাকে মধ্যবিত্ত পর্যায়ের ছাত্র বলা যায়। শিক্ষকদের শাসন-বারণ ও স্নেহের মধ্য দিয়ে শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেছি। আজকের মতো আমাদের সময়ে এত নিয়ম ছিল না। শিক্ষকেরা স্কুলে ভাবনাচিন্তা ছাড়াই শাসন করতে পারতেন। অঙ্ক স্যার আর বিজ্ঞান স্যার আমাদের দেদার পিটিয়েছেন। আমার জীবনে তাঁদের অনেক অবদান। প্রায় টিচার্স রুমে ডেকে অনুপ্রাণিত করতেন। বলতেন, ‘তোর সামর্থ্য আরও বেশি। অঙ্ক, বিজ্ঞান ভালো বুঝিস। আর একটু বেশি পরিশ্রম করলে ভালো রেজাল্ট করতে পারবি।’ কিন্তু পরিশ্রমের অভাবে, ফাঁকিবাজি স্বভাবে কোনো পরীক্ষাতেই চোখধাঁধানো রেজাল্ট করা হয়নি। নম্বর কম পাওয়ায় স্যারদের কাছে কত যে বকা শুনেছি, মার খেয়েছি, হিসাব নেই।

প্রায়ই বাড়ির কাজ না করে স্কুলে যেতাম। তেমনই একদিনের ঘটনা, তখন দশম শ্রেণিতে পড়ি। বাড়ির কাজ না করে নিয়ে যাওয়ায় হাই বেঞ্চের ওপর কান ধরে দাঁড়াতে বললেন স্যার। উঠে দাঁড়িয়েছি, স্যার উপপাদ্য বোঝাচ্ছেন। ত্রিভুজের পরিকেন্দ্র, ভরকেন্দ্র ও লম্ববিন্দু সমরেখ। উচ্চতর গণিতের ১০ নম্বর উপপাদ্য, বেশ কঠিন। এর মধ্যে প্রিন্সিপাল স্যার ক্লাসে ঢুকলেন। যারা কান ধরে দাঁড়িয়েছিলাম, সবাইকে হাত নিচু করে বসতে বললেন। মনের ভেতর উসখুস করছে। প্রিন্সিপাল স্যার আমাদের প্রতিবেশী, বাবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক। নিশ্চয়ই দেখা হলে বাবাকে বলবেন। স্যার কি যারা কান ধরে দাঁড়িয়েছিলাম, তাদের প্রসঙ্গে কথা বলছেন? কয়েক মুহূর্ত যেতেই ভাবনার অবসান হলো। অফিস সহায়ক আন্টির সঙ্গে লম্বা, সুশ্রী, আয়তলোচনা, লাল সালোয়ার–কামিজ পরা একটি মেয়ে ক্লাসে এল। প্রিন্সিপাল স্যার আঙুল দিয়ে তাকে দেখিয়ে, আরও কিছু সময় অঙ্ক স্যারের সঙ্গে কথা বলে বেরিয়ে গেলেন। এর পরপরই আন্টি আর মেয়েটিও বের হলো। ক্লাসজুড়ে ফিস ফিস কলরব। স্যার ডাস্টার দিয়ে টেবিলের ওপর বাড়ি দিতে দিতে বললেন, ‘একটাও শব্দ না, সবাই চুপ।’ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ‘কোনো সমস্যা, স্যার?’ জিজ্ঞেস করল ফার্স্ট বয়। ‘না, না, ওই মেয়েটা নতুন ভর্তি হয়েছে। ক্লাস নাইনে। ওর বাবা সরকারি চাকরি করেন, বদলি হয়ে এসেছেন। স্যার, পরিচয় করিয়ে দিলেন।’ অঙ্ক স্যারের জবাব।

ফার্স্ট বয় স্যারের মুখে কথাটা শুনে সেদিন খুশি হয়েছিল কি না, জানি না। তবে আমার মনটা খুশিতে নেচে উঠেছিল। ভেবেছিলাম, এবার একটা হিল্লে হয়েই যাবে। কিন্তু টিফিন পিরিয়ডে সে আশায় ভাটা পড়ে। জানতে পারি, যে বন্ধুটি আমার চেয়ে লেখাপড়ায় ভালো, তারও মেয়েটিকে মনে ধরেছে। শক্ত প্রতিযোগী, নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু ছুটির পর স্কুলের যেদিকটায় ডিপ টিউবওয়েল, তার ঠিক সামনের চটপটি-ঝালমুড়ির দোকানে মেয়েটাকে দেখতেই মনের ভেতর প্রজাপতিটা ফড়ফড় করে ওঠে। শপথ করি, কোনো দিন যদি বিয়ে করি, তাকেই করব।

প্রথম ভালো লাগা, মনে নানা ভাবনা আসে। বিয়ে পর্যন্ত যেতে হলে অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করতে হবে। ধাপগুলো ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করি। ১. পছন্দ করি, এটা তাকে বোঝানো। ২. ‘ভালোবাসি’ কথাটা বলা। ৩. রাজি না হলে, ভদ্রোচিতভাবে রাজি করানো। ৪. সযত্নে সম্পর্কটিকে কয়েক বছর বয়ে নিয়ে যাওয়া। ৫. চাকরি পেয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। ৬. দুই পরিবারকে রাজি করানো। ৭. শুভ পরিণয়।

দ্বিতীয় ধাপ অতিক্রমের জন্য মন মরিয়া। কিন্তু স্কুলের গেট, রাস্তার মোড়, এমনকি তার বাসার নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলেও সুযোগ হচ্ছিল না। সে বাবার মোটরসাইকেলে করে স্কুলে আসা-যাওয়া করত। তা ছাড়া আমার এসএসসি পরীক্ষাও সন্নিকটে। নির্ঝামেলায় ভালো করে পরীক্ষা দিতে হবে। পরীক্ষা শেষে ‘ভালোবাসি’ কথাটা বলব বলে সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু নিয়তি সায় দেয়নি। আমার পরীক্ষা শেষ হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে তারা অন্য শহরে চলে যায়।

জীবনের এই দুঃখের বিবরণী কখনো কারও কাছে বলিনি। এমনকি ভালোবাসার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী বন্ধুটিও আঁচ করতে পারেনি। আজ সে আরেকজনকে ভালোবাসে। কিন্তু আমি পারিনি। সেই মেয়েটির প্রতি ভালোবাসা বুকে ধরেই কলেজ শেষ করি, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পড়ালেখায় যুক্ত হই। সময়ের প্রয়োজনে একটা অ্যান্ড্রয়েড ফোন ও ল্যাপটপ হয়। ফেসবুক আইডি খুলি। এর পর থেকে নিয়মিত তাকে ফেসবুকে খুঁজতাম। পাই না, পাই না...করতে করতে একদিন আইডি পেয়ে যাই। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাই, কিন্তু সে অ্যাকসেপ্ট করে না, ডিলিট করে দেয়। প্রিয় মানুষের প্রত্যাখ্যান কী ভয়ানক, সেদিনই প্রথম উপলব্ধি করি। কিন্তু আশা ছাড়ি না। গভীর ভালোবাসা বোধ হয় শক্তি জোগায়। সে মেডিকেলে পড়ে, তাকে যে ভালোবাসবে, তার ন্যূনতম একটা যোগ্যতা থাকা চাই। যদিও ভালোবাসার যোগ্যতা কেবল ভালোবাসা দিয়েই নিরূপিত হওয়া উচিত। তারপরও নিজেকে প্রস্তুত করতে লেখাপড়ায় ভালো করার চেষ্টার পাশাপাশি পছন্দের একটি কাজেও মনোনিবেশ করি।

তিন বছর অতিবাহিত হয়েছে। পছন্দের কাজটিতে ভালো করায় দেশ-বিদেশের অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আমাকে চেনে। জীবনে ব্যস্ততাও বেড়েছে। তারপরও তাকে ছাড়া শূন্য শূন্য লাগে। তাই প্রত্যাখ্যানের বেদনা লুকিয়ে আবারও ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি। আমার বিশ্বাস, নিয়তি আর আমাকে কাঁদাবে না। আমি নিশ্চয়ই তাঁকে নিজের করে পাব।