খসে পড়া তারা

অলংকরণ: আরাফাত করিম

২ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, গত রাতে ঝুম বৃষ্টি ছিল। এখন আকাশ ঝকঝকে। মেঘের কোনো ঘনঘটা নেই। বাইরে টুংটাং ভ্যানগাড়ির শব্দ। কয়েকজন মধ্যবয়সী লোক ফেরি করে সবজি বিক্রি করছে। বগলে খবরের কাগজ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে জনৈক কিশোর।
অকস্মাৎ মেসের টেলিফোনটা বেজে উঠল। ক্রিং ক্রিং ক্রিং।
‘স্লামুলাইকুম। কারে চান?’
‘সেলিম সাহেব আছেন? তাকে একটু দেওয়া যাবে, প্লিজ? খুবই দরকার।’
গফুর মিয়া হাঁক দিয়ে বলল, ‘তোমার ফোন আইছ্যা গো সেলিম। জলদি আহো।’
গফুর মিয়া আদর্শ শান্তিনিকেতন মেসের বাবুর্চি। বাজার, রান্নাবান্না, চা-টা প্রভৃতি টুকটাক কাজে নিয়োজিত। সহজ-সরল, বড় ভালো মানুষ। হুকুম তদবির করতে দেরি নেই। সঙ্গে সঙ্গেই কাজে নেমে পড়ে। কাজ ও ব্যবহার দিয়ে সবার নজর কেড়েছে। এ জন্য সে মাস শেষে মাইনের চেয়ে বাড়তি কিছু টাকাপয়সাও পায়।
সেলিম সবে স্নানঘর থেকে বের হলো। তোয়ালেটা গলায় ঝোলানো। আয়না দেখে চুল আঁচড়াচ্ছেন ১০টায় অফিস। ঘণ্টাখানেক পরপরই তাকে বের হতে হবে। গফুরের হাঁক শোনে সে তড়িঘড়ি করে রিসিভারটা তুলল।
‘হ্যালো! সেলিম স্পিকিং।’
‘শুনতে পাচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ,বলুন।’
‘নাতাশার অবস্থা খুব একটা ভালো না। প্রসবযন্ত্রণায় ছটফট করছে। ইমিডিয়েটলি আমরা তাকে একটা বেসরকারি হসপিটালে নিয়ে এসেছি। আপনি যত দ্রুত সম্ভব রাজশাহী ফিরে আসুন।’
সেলিমের ভেতরটা কেঁপে উঠল। সে গলার স্বরটা চিনতে পারল। বাড়িওয়ালার ছোট মেয়ে মিলির। খানিক চুপ থেকে সে বলল, ‘আজকেই রওনা করব। আমি না আসা অবধি নাতাশাকে একটু দেখে রাখবেন...প্লিজ।’ লাইন কেটে গেল।

বছর দুয়েক আগে সেলিম নাতাশাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। বাড়িতে মেনে না নেওয়ায় রাগ করে গ্রাম ছেড়েছিল দুজন। পরে  রাজশাহীর একটি সস্তা টিনশেড ভাড়া বাসায় উঠেছিল। ভালোই কাটছিল তাদের দিনকাল। নাতাশা রাজশাহী কলেজে বিএ পড়ার পাশাপাশি  টিউশন করাত। সেলিম কাজ করত ঢাকার একটি প্রেসে।
বিকেলের মিহি রোদবারান্দায় ঢুকে পড়েছে। টেবিলের ওপাশ থেকে তখনো অসমাপ্ত  সিগারেটের টুকরোর ধোঁয়া উড়ছে। জানালা থেকে যত দূর চোখ যায়, জেসমিন ফুলের ছড়াছড়ি। সেলিম আনমনে বাইরে তাকিয়ে আছে। হাতে ফ্রেমে বাঁধাই করা একখানা ফটোগ্রাফ। ফটোগ্রাফে সে হলুদ শাড়ি পরা ২০-২১ বছর বয়সী এক তরুণীর হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। গত মাসে ঢাকায় ফেরার আগে নাতাশা সোহাগ করে বলেছিল, ‘আমাকে একটু সাজিয়ে দাও না গো। মিলিকে বলে রেখেছি তুমি ঢাকায় যাবার আগে একখানা ফটো তুলে দিতে।’
সেলিম নিজ হাতে সাজিয়ে দিয়েছিল সেদিন। কপালে আলতো করে টিপ। হাতে নীল-কালো চুড়ি। টানা টানা চোখে কাজল। পরনে হলুদ শাড়ি। এ যেন নববধূ বেশে নাতাশার নতুন পদযাত্রা। পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে কখন যে সেলিমের চোখে জল এল—সে টের পায়নি।
এমন সময় হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে নিচতলার বেকারির মালিক নীরঞ্জন প্রবেশ করল।
‘মাত্রই খবর পেলাম। সারা দেশে প্রচুর গোলমাল হচ্ছে। শাহবাগে ছাত্ররা আন্দোলনে নেমেছে। মিছিল করছে। চারদিকে টহল দিচ্ছে পুলিশ। স্লোগানে স্লোগানে উত্তপ্ত ঢাকা। যান চলাচল বন্ধ। এ অবস্থায় বের হওয়া তোমার মোটেও ঠিক হবে না।’
হাঁপাতে হাঁপাতে নীরঞ্জন একনাগাড়ে কথাগুলো বলে গেল। চারটার দিকে সেলিমের রাজশাহী ফেরার কথা। মুহূর্তেই তা ভেস্তে গেল। অথচ সকাল থেকেই তার মনটা নাতাশার কাছে পড়ে আছে।
সন্ধ্যার খবরে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো অবিরত বলছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র নিহত হয়েছে। চট্টগ্রামে আরও দুজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। দেশজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ছে পুলিশ।

পরদিন সেলিম সূর্য ডোবার আগেই রাজশাহী পৌঁছাল। সে দেখল, বাসার সামনে সটান দাঁড়িয়ে আছে একটি অ্যাম্বুলেন্স। লোকজন জড়ো হয়েছে। দুজন যুবক অ্যাম্বুলেন্স থেকে  ধরাধরি করে নামাচ্ছে নাতাশার লাশ। গায়ে আটপৌরে একটা নকশিকাঁথা জড়ানো। সেলিম নিজেকে আর সামলাতে পারল না।
‘আমার সব শেষ হয়ে গেল। আমার স্বপ্নগুলো মাটির সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেল। হে খোদা! এখন কী হবে আমার?’ অঝোরে কাঁদতে লাগল সে। বাড়িওয়ালা শফিক আহমেদ তাকে বুকে টেনে নিলেন। সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘কেঁদো না। কেঁদে আর কী হবে? হায়াত-মউত সব খোদার হাতে। সবই তার ইচ্ছা।’
নিস্তব্ধ রাত। আঙিনায় ঝিকঝিক করছে শ্রাবণের জ্যোৎস্না। গোটা কয়েক লোক ধীরপায়ে এগোচ্ছে পুরোনো গোরস্থানের দিকে। নদী থেকে কয়েক ক্রোশ দূরেই এর অবস্থান। সেখানে চাঁদের আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে তিনটা নতুন কবর। রেস্তোরাঁর মালিক রমজান বলল,‘গতকাল তীব্র আন্দোলনে তিনজনই পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। এবড়োখেবড়ো হয়ে রাস্তায় পড়ে ছিল তাদের দেহ। এদের মধ্যে একজন বেশ বোকা টাইপের। ইচ্ছা করেই পুলিশের বন্দুকের নলের সামনে বুক পেতে দিয়েছিল।’
নাতাশাকে তাদের পাশে সমাহিত করা হয়। একই সারিতে চারটি নতুন কবর।
সেই রাতটা সেলিম রোয়াকে বসে কাটিয়ে দিল।
ভোর হয়েছে। শফিক আহমেদ দরদি কণ্ঠে কোরআন পাঠ করছেন।


শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়