নিজেকে ভালোবাসেন তো

পরিবারের মজবুত সুসম্পর্ক সুখী জীবনের জন্য অন্যতম উপাদান। মডেল: সাইদা আহমেদ, আদিব, তারেক হাসান ও দৃণা।ছবি: সুমন ইউসুফ

২০১৩ সালে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টের এক প্রফেসর ৭৫ বছর ধরে চলছিল এমন একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করতে গিয়ে সবাইকে চমকে দিলেন। গবেষণার বিষয় ছিল—‘একটি সুন্দর সুখী জীবনের জন্য কোন জিনিসটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?’ ফলাফল আসলেই চমকে দেওয়ার মতো। টাকাপয়সা নয়, খ্যাতি নয়, ধনদৌলত নয়, ক্ষমতা নয়—এটি হলো সম্পর্ক। সুসম্পর্ক। ছান্দিক একটা সম্পর্ক নিজের পরিবার, বন্ধু আর প্রতিবেশীদের সঙ্গে; যা অন্যতম উপাদান একটি সুন্দর সুখী জীবনের জন্য।

সত্যিই তো, একটু নিজের ভালো থাকা নিয়ে ভেবে দেখুন তো...। আপনি কি জানেন, মা–বাবা সবচেয়ে বেশি সুখ অনুভব করেন, যখন তাঁদের সন্তানদের নিয়ে একসঙ্গে ভালো সময় কাটান। একবার ভাবুন, অনেক ধনী দম্পতির কথা, যাঁদের কোনো সন্তান নেই। আরও ভাবুন, আমরা কি শুধু পরিবার নিয়েই ভালো থাকি? একদম নয়। আমাদের নানা বিপদ-আপদে, উৎসবে বা অকারণে প্রতিবেশী আর বন্ধু, যাঁদের সঙ্গে সরাসরি রক্তের বা আনুষ্ঠানিক কোনো সম্পর্ক না থাকলেও তাঁদের বাদ দিয়ে ভালো থাকা হয় না আমাদের।

নিজের প্রতি যত্নশীল হলেই আত্মবিশ্বাস ও আত্মশক্তি বেড়ে যায়। অন্য মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে এই শক্তি অত্যাবশ্যকীয়। আর এমন সব অভ্যাস গড়ে তুলতে প্রয়োজন বিকশিত মন।

ভালো থাকার অন্যতম উপাদান ছান্দিক এই সুসম্পর্ক। কিন্তু অনেক বড় প্রশ্ন হলো, কীভাবে সম্পর্কে ছন্দ ও সৌন্দর্য যোগ করব? এ ক্ষেত্রে গবেষণা বলছে, সম্পর্ক হয় একজন মানুষের আত্মার সঙ্গে আরেকজন মানুষের আত্মার। আর এ কারণে হয়তো বাংলা প্রতিশব্দটি হলো আত্মীয়।

সম্পর্কে ছন্দের অভাব হয় তখনই, যখন আমরা আত্মার প্রয়োজনের তুলনায় শরীরের প্রয়োজন বেশি প্রাধান্য দিই। খেয়াল করে দেখুন, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানসহ সব মেটেরিয়াল হলো শরীরের জন্য। কিন্তু আত্মা বা হৃদয়ের প্রয়োজন একটু ভিন্ন আর তা হলো বিশ্বাস, সম্মান, শ্রদ্ধা, গৌরব, যত্ন, ভালোবাসার মতো অমূল্য সব অনুভূতি।

আমাদের প্রিয়জনদের সঙ্গে ভালোবাসার এই সম্পর্ক ছান্দিক, সুখময় ও শান্তিতে পরিপূর্ণ করতে গেলে প্রয়োজন তাঁদের জন্য ওপরের ওই বিশেষ অনুভূতিগুলো নিয়মিত ও পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ করা।
আবারও আরেকটি প্রশ্ন—যদি আপনার পানি পানের জন্য সুন্দর একটি কাচের মগ থাকে আর সেটি সম্পূর্ণ খালি থাকে, তাহলে কি কাউকে একটুও পানি দিতে পারবেন? না, আপনার মগই শূন্য, তাহলে অন্যকে কীভাবে দেবেন! সুতরাং অন্যকে ভালোবাসতে চান, নিজেকে আগে ভালোবাসতে হবে, নিজের সম্পর্ক হতে হবে মধুর ও ছান্দিক। তবেই অন্যের সঙ্গে ছান্দিকতা ফিরে পাবেন। প্রশ্ন চলে আসে মনে, কীভাবে নিজের সঙ্গে সম্পর্ক পাকা করব? ওই যে একই পদ্ধতি। নিজের প্রতি নিজের বিশ্বাস, নিজেকে সম্মান, শ্রদ্ধা ও যত্ন করতে হবে।

নিজের প্রতি যত্নশীল হলেই আত্মবিশ্বাস ও আত্মশক্তি বেড়ে যায়। অন্য মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে এই শক্তি অত্যাবশ্যকীয়। আর এমন সব অভ্যাস গড়ে তুলতে প্রয়োজন বিকশিত মন।

বিকশিত মনের নকশা
ইগলের বাসায় হামলা। অদম্য ইগল জানপ্রাণ দিয়ে নিজের তা দেওয়া ডিম রক্ষা করে একটি মুরগির খাঁচায় রেখে এল। মুরগি নিজের ডিম মনে করে ইগলের ডিমটি তা দিল। একসঙ্গে মুরগির বাচ্চাগুলোর সঙ্গে বড় হতে লাগল ইগলের বাচ্চা। একঝাঁক মুরগি, দলনেতা মা নিজেও মুরগি, এমন অবস্থায় ইগল নিজেকে মুরগি ছাড়া আর কী ভাববে? নিজের ওড়ার অদম্য শক্তি থাকা সত্ত্বেও কখনো ইগল পাখিটি চেষ্টা করল না ডানা মেলে ওড়ার। কেন? শুধু ছকে বাঁধা মাইন্ডসেট বা মনের নকশার জন্য। পারা না পারা তো অনেক পরের কথা। শুধু মনে মনে যদি ভেবে নিই—আমি পারব না, তাহলে সব দুয়ার বন্ধ। আমাদের মন সব সময় একটা নকশা অনুসরণ করে চলে। সিদ্ধান্ত ও কাজ, যা কিছু করে, তা সেই নির্দিষ্ট নকশা মেপে।

কারও কারও ক্ষেত্রে এই নকশা পূর্বনির্ধারিত, আবার কেউ কেউ নিজের মন এমনভাবে প্রস্তুত বা নকশা করে রাখে যে প্রয়োজন অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য আচরণ করতে পারে।
এমন যদি হতো আমি পাখির মতো। চিন্তা করে দেখুন, মানুষ পাখি হতে না পারার কারণে যদি ভাবত আমরা উড়তে পারব না, তাহলে কিন্তু উড়োজাহাজে ওড়ার স্বপ্ন ভুলেও দেখত না। পাখি না হয়েও, ডানা না থাকলেও আপনি উড়তে পারেন। আর এমন সব মুক্তচিন্তা বা স্বপ্ন দেখা—কী নেই তা নিয়ে না ভেবে কী আছে এবং আরও কী হতে পারে, তা নিয়ে ভাবে এই বিকশিত চিন্তাধারার মানুষেরা।

আর গণ্ডির মধ্যে একই ধরনের চিন্তা করা মানুষ শুধু অভিযোগ করে আর বলে—এটা নেই, ওটা নেই। আমি পারব না। আমার মেধা থাকলে দেখিয়ে দিতাম। সুচিন্তা করার মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে সারা দিন দুশ্চিন্তা করে আর অন্যদের ওপর দোষারোপ করে। এ রকম অনুর্বর চিন্তার জন্য ব্যক্তি নিজে সম্পূর্ণ দায়ী নয়, বরং অনেক দিন ধরে অনুশীলন ও অনুসরণ করা মাইন্ডসেট বা মনের নকশা এর জন্য দায়ী। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসা খুব কঠিন নয়, আবার একেবারে সহজও নয়।

ফিক্সড মাইন্ডসেট থেকে বেরিয়ে গ্রোথ মাইন্ডসেট অর্জন করতে পারলে জীবন সহজভাবে উপলব্ধি করা যায় এবং সমস্যাগুলো সমাধানের নতুন ও অভিনব উপায় খুঁজে পাওয়া যায়।
আসুন বিজয়ের আনন্দে মুক্তির এই দিনে নিজের মন মুক্ত করে সত্যিকারের স্বাধীনতা উপলব্ধি করি। হয়ে উঠি অদম্য। শুধু টিকিয়ে রাখা নয়, গড়ে তুলি টেকসই সম্পর্ক৷

সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক, প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ

প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের প্রকাশনা ‘তারুণ্য’, অষ্টম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০১৯ থেকে নেওয়া।