শৈশবের ঈদ আনন্দ

শৈশবের ঈদ আনন্দ, প্রতীকীফাইল ছবি

এক, দুই, সাড়ে তিন
রাইত পোহাইলে ঈদের দিন।

তখন সন্ধ্যায় চাঁদ ওঠার পর এ স্লোগানে সবাই মিছিল করতাম। আমাদের লিডারশিপ দিত কখনো এলাকার বড় ভাই, কখনো আমি।

আমরা সমবয়সী কয়েকজন চাঁদ দেখা কমিটিতে ছিলাম। শেষ রমজানে ইফতার করে চাঁদ খোঁজা ছিল আমাদের মূল কাজ। ২৯ রোজায় কোনোরকমে ইফতার খেয়েই বের হয়ে যেতাম চাঁদ খোঁজার জন্য, না পেলে হতাশ হতাম। আবার এটা ভেবে খুশি হতাম, আগামীকাল চাঁদ উঠুক আর নাই উঠুক পরশু ঈদ হবেই।

যত বড় হচ্ছি, ঈদের আনন্দগুলো মলিন হয়ে যাচ্ছে। আশপাশে প্রিয় বন্ধুরা নেই, যান্ত্রিক জীবনে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফিরে যেতে ইচ্ছা করে সোনালি দিনগুলোর কাছে।

তারপর আকাশে যখন চাঁদ উঠত, হাততালি দিতাম। অনেক খুশি হতাম আর সবাই মিলে ছড়াটা কাটতাম—আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ছোট ঢোল, বোতলে বাড়ি দিয়ে শব্দ করত আর হাততালি দিত।

ঈদের আগের রাতে সমবয়সীদের বাসায় হামলা দিতাম, কাপড় দেখব বলে। কারও কাপড় ঈদের আগে দেখে ফেললে তার ঈদ চলে যাবে, এমনটা তখন সবাই বিশ্বাস করতাম। কারও কাপড় কোনোভাবে দেখে ফেললে খ্যাপাতাম, ‘তোর ঈদ চলে গেছে’ বলে। একবার আমার কাপড় দেখার জন্য হামলা চালায় একদল, অনেক চেষ্টা করেও ওদের আটকাতে পারিনি। নতুন জামা দেখেই ফেলে। তারপর শুরু হয় খ্যাপানো।

ঈদের দিন সকালে কনকনে ঠান্ডায় গোসল শেষ করে বাবার হাত ধরে ঈদগাহ মাঠে যেতাম। ভৈরবের মডেল স্কুলের ঈদগাহ মাঠে নামাজ পড়তাম। এরপর কোলাকুলি শেষে বাসায় এসে চলত পরবর্তী অভিযান ‘সালামি সংগ্রহ’। কে কত সালামি পেলাম, এটা নিয়ে হতো প্রতিযোগিতা। বাবার কাছ থেকে কয়েকবার সালাম করে সালামি নিয়ে যেতাম।

একবার ঈদে চাচাতো বোন সালামি নিতে আসে মা–বাবার কাছে। সুযোগ খুঁজছিলাম ওকে সালাম করে সবগুলো টাকা নিয়ে নেব। আকাশের দিকে তাকিয়ে যখন এসব ভাবছিলাম, কখন যে হুট করে এসে আমাকে সালাম করে হাত বাড়িয়ে বলে, ‘এখন সালামি দে’। উপায়ান্তর না দেখে পকেট থেকে নতুন চকচকে টাকা দিতেই হলো।

ঈদের দিন বিকেলে বাজি ধরে ক্রিকেট খেলাটাও ছিল শৈশবের ঈদ আয়োজনের একটি অংশ। আমি বাজি লাগাতাম না, বাবা বলতেন বাজি ধরা ভালো নয়। একবার দলের জোরাজুরিতে তিন টাকা বাজি লাগাই। কিন্তু তখন ম্যাচটা হেরে যাই। এরপর আর কোনো দিন বাজি ধরিনি। কিন্তু আমার টিমে বাজি লাগিয়ে অনেকেই জিতে যেত। আমার সিক্স আর উইকেটের ওপরেও বাজি ধরে জিতেছে অনেকে।

সবাই মিলে একসঙ্গে হইচই, ঘোরাঘুরি ও খেলায় আনন্দে ঈদের সময়টা কেটে যেত বেশ। সন্ধ্যার পর আমরা আকাশের দিকে তাকিয়ে হেঁটে হেঁটে বলতাম, ‘এই দেখ ঈদের চাঁদ আমার সঙ্গে সঙ্গে যায়’। তখন সে–ও খানিক দূরে গিয়ে বলত, ‘তোর সঙ্গে না, আমার সঙ্গে যায়’। আরেকজন বলত, ‘তোদের কারও সঙ্গে না, আমার সঙ্গে যায় চাঁদ।’

একটা চাঁদ একসঙ্গে কয়েকজনের সঙ্গে কীভাবে থাকে, এটা ভেবে অবাক হতাম। এরপর তারা গোনার প্রতিযোগিতা চলত।

যত বড় হচ্ছি, ঈদের আনন্দগুলো মলিন হয়ে যাচ্ছে। আশপাশে প্রিয় বন্ধুরা নেই, যান্ত্রিক জীবনে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফিরে যেতে ইচ্ছা করে সোনালি দিনগুলোর কাছে।

বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা