‘এক কাপ চা’ আর মিষ্টি প্রেমের লিলুয়া বাতাস

এক কাপ চা ছবির দৃশ্যে ফেরদৌস ও মৌসুমী
কলেজে শেক্‌সপিয়ারের ‘রোমিও–জুলিয়েট’ থেকে ‘ইট ইজ মাই লেডি। ও, ইট ইজ মাই লাভ...’ সংলাপ অংশটুকু পড়াতে পড়াতেও শফিক গভীরভাবে দীপার মধ্যে ডুবে যায়।

ক্ষীরের পুতুল ফেরদৌস আর গোলাপসুন্দরী মৌসুমী জুটির একটা মিষ্টি প্রেমের ছবি ‘এক কাপ চা’। বাসু চট্টোপাধ্যায়ের গল্পটা যদিও একটু বোকা বোকা; সর্বসাধারণের মনোরঞ্জনে কখনো কখনো এ ধরনের বোকা কাহিনিও দাঁড়িয়ে যায়। ফেরদৌস-মৌসুমী রোমান্টিক জুটি এবং অন্য বিশিষ্ট শিল্পীদের সমবেত প্রয়াসে নঈম ইমতিয়াজ নেয়ামুলের এই চলচ্চিত্রও বাউন্ডারি পেরিয়ে ছয়ে ছয়ে সয়লাব হলো।

শুরুতে ক্ষীরের পুতুল আর গোলাপসুন্দরীর বিয়ের আসরে মন ব্যাকুল করা লিলুয়া বাতাস বইল। এ বিয়ের আসরে অতিথি হয়ে আসেন কিংবদন্তি অভিনেতা আলমগীর ও আঁখি আলমগীর। তাঁদের কণ্ঠে ‘লিলুয়া বাতাস’ গানটি লিখেছেন আবহমানকালের প্রেমের জাদুকর হুমায়ুন আহমেদ। বাঁশবন, কাশবন, কদম্বতল, ফুলবনে প্রেমের দুষ্টু মিষ্টি দমকা বাতাস বয়ে যায়।

এরপর আমরা বুঝতে পারলাম নায়ক শফিক বাবু আসলে বিয়ের স্বপ্ন দেখছিল। নায়িকা দীপা দেবীকে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে চুমু খেতে গিয়ে ভোরের অ্যালার্ম শুনে ঘুম ভেঙে গেল। কলেজে ইংরেজি সাহিত্য পড়ায় শফিক। একই কলেজের লাইব্রেরিয়ান দীপাকে মনে মনে ভালোবাসে। এই একপক্ষীয় নীরব প্রেম নিজের কলেজজীবন থেকে শুরু। দীপাকে একপলক দেখার জন্য তখনো শফিক হোস্টেলের গেটে দাঁড়িয়ে থাকত। নিয়তির বন্ধনে দুজনেই আজ একই জায়গায় চাকরি করছে।

রোজ এখন তাড়াতাড়ি কলেজে গিয়ে দীপার টেবিলে একটা করে গোলাপ রেখে আসে শফিক। দীপা যদিও জানতে পারে না কে এই গোলাপ রেখে যায়। প্রেমিকের হৃদয়নিংড়ানো রক্তগোলাপ সে হাতে তুলে নেয়, পরক্ষণেই আবর্জনা ফেলার জায়গায় ফেলে দেয়।

শফিক ক্লাসে গিয়ে শেক্‌সপিয়ারের ‘রিচার্ড দ্য থার্ড’ পড়ায়। ভীরু কে? ছাত্রদের বোঝাতে বোঝাতে নিজেও বিভোর হয়ে দীপার ছোঁয়া পায়। ভীরু হলো সে, যে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছতে ভয় পায়। যে পরাজয়কে ভয় পায় না, সে বীর হয়। নিজের যা লক্ষ্য তার দিকে নির্ভয়ে এগিয়ে যায়। শফিক ভীরু হতে চায় না। প্রেমে ব্যর্থ হওয়ার ভয় পায় না। নিজের লক্ষ্যে প্রতিদিন অবিচল, নির্ভয়ে দীপার জন্য গোলাপ নিয়ে আসে। কলেজ গ্রন্থাগারে বই ফেরত দেওয়ার নাম করে বারবার দীপাকে দেখতে আসে। বইয়ের রেকের আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি মারে। দীপাও শফিক স্যারের এই পাগলামো দেখে মনে মনে হাসে।

দীপা কর্মজীবী হোস্টেলে থাকে। কলেজছাত্র সালমান, দীপাকে ছোট্ট পিটারদের বাড়িতে অতিথি হয়ে ভাড়া থাকার সুযোগ করে দেয়। পিটার টারজানের গল্প শুনতে ভালোবাসে। দীপার সঙ্গে তার খুব ভাব জমে যায়। শফিক বলে, আগে জানতে পারলে সে দীপাকে কোথাও থাকার ব্যবস্থা করে দিত। কলেজের অধ্যক্ষ (অভিনয়ে রাজ্জাক) একদিন শফিককে ডেকে পাঠায়। রাজ্জাকের কথা শুনে শফিক প্রথমে মনে মনে ভয় পায়, সে যে দীপাকে অনবরত বিরক্ত করে চলে, দীপা বুঝি সব কথা অধ্যক্ষকে বলে দিয়েছে। শফিক পরম প্রেমিক হলেও বেশ বোকা। অধ্যক্ষ অবশ্য রাতে ছাত্রদের হোস্টেলে, হোস্টেল সুপারের অবর্তমানে দায়িত্ব সামলাতে বলে। শফিক হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।

কলেজে শেক্‌সপিয়ারের ‘রোমিও–জুলিয়েট’ থেকে ‘ইট ইজ মাই লেডি। ও, ইট ইজ মাই লাভ...’ সংলাপ অংশটুকু পড়াতে পড়াতেও শফিক গভীরভাবে দীপার মধ্যে ডুবে যায়। কবিতার মানসীর মতো দীপা তার কবিতা, দীপা তার কবিতালোক, বুকের মধ্যে জেগে বসে। দীপার চোখ, দীপার মুখের লাবণ্য, দীপার মধ্যে স্নিগ্ধ সপ্রতিভ ঔজ্জ্বল্য তাকে বাইরে নিয়ে আসে। হৃদয়ে প্লাবন নামে। প্রেমের বারিষধারায় সে সিক্ত, মোহিত, মুগ্ধ ভিজে চলে। ক্লাস শেষে ঘণ্টা বাজে। আবেগপ্রবণ শিক্ষকের বচনে বাচনে ছাত্ররাও বিমুগ্ধ।

এভাবে শয়নে-স্বপনে-জাগরণে-শিহরণে শফিকের প্রতিটা সময় এখন শুধু দীপাময়। একদিন আবার স্বপ্নে দেখে, দীপা বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র তুলে দিচ্ছে। বজ্রাহত শফিক পকেট থেকে পিস্তল বের করে দীপার দিকে তাঁক করে। পিস্তলের মুখ পরক্ষণেই নিজের দিকে ঘুরে যায়। নিজেকে হত্যা করার বিকট আর্তনাদে ঘুম ভেঙে যায়। প্রেম যে এমনই প্রবল চাওয়া।

এবার একটা প্রবল বোধ জেগে ওঠে। সাহসী হয়ে আজই দীপাকে মনের কথা বলে ফেলতে হবে। এবার কলেজ গ্রন্থাগারে দীপার টেবিলে ফুল রাখতে এসে ধরা পড়ে যায়। দীপা বলে, নিজের হাতেই তো দিতে পারেন ফুলটা। শফিক বলে, এবার আর ফেলে দেবে না তো? দুজনের মাঝখানে বহু শতাব্দীর বাধার কাচের দেয়াল ঝনঝন করে ভেঙে যায়। দুজনের মাঝখানে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বয়ে আসা অনন্ত প্রাণের মুহূর্তের স্তব্ধতা খেলা করে যায়।

সেই সালমান দীপার কান ভাঙাল। ডাক্তারের বাড়ি না গিয়ে শফিক গণিকার দরবারে এসে মজা লুটছে। সব শুনে দীপা রেগে আগুন। শফিক অবশ্য ফোন করে সব বিস্তারিত ঘটনা জানিয়ে দীপার রাগ ভাঙায়।

শফিক বলে, চলো দুজনে সিনেমা দেখতে যাই। দীপা বলে, আমি মাঝে মাঝে সিনেমা দেখতে যাই; কিন্তু যে বাড়িতে ভাড়া থাকি, সে বাড়ির বাচ্চাটা মানে পিটার খুব অসুস্থ। এই অবস্থায় সিনেমা দেখতে যাওয়া ঠিক হবে না। দয়িতার মনের সহমর্মিতা, সমবেদনা দয়িতের হৃদয়েও এসে নাড়া দেয়। সে বলে, ঠিক আছে কাল তো শুক্রবার, তোমার বাড়িতে তবে এক কাপ চা খেতে আসব।

এখান থেকে শুরু হয় ‘এক কাপ চা’–এর নতুন গল্প। কাহিনির এই অংশটা খুব দুর্বল। আসলে একধরনের বাণিজ্যিক সিনেমার গল্প লেখকেরা যে ধরনের এলেবেলে কাহিনি বুনে মজা পায়, এই অংশেও তার প্রতিফলন। তবে এক কাপ চায়ের মূল গানটা লিখেছেন নচিকেতা চক্রবর্তী। সুরও নচিকেতার। কাহিনির সঙ্গে বেশ মিলে যায় গানটা।

দীপাকে জয় করতে পারার আনন্দে আত্মহারা শফিক। শুক্রবারে ফুল আর মিষ্টির প্যাকেট হাতে দীপার ভাড়া বাড়িতে যায়। বাড়িওয়ালা মিস্টার গোমজের স্ত্রী মিসেস গোমেজ ভাবে, পিটারকে দেখতে ডাক্তার এসেছে। শফিকের কোনো কথা শুনতে না চেয়ে তাকে অসুস্থ পিটারের ঘরে নিয়ে যায়। মিস্টার গোমজও শফিককে ডাক্তার ভেবে বসে। দীপা এসে ওদের ভুল ভাঙায়। শফিক তখন ডা. আফজাল চৌধুরীর বাড়িতে পিটারের জন্য ইনজেকশন আনতে ছোটে। গাড়ি না পেয়ে রাস্তায় বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। শেষ পর্যন্ত একজনের সাহায্যে তার গাড়িতে উঠে ডা. আফজালের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছায়। ডাক্তার বাইরে যাওয়ায় সেই বাসায় চুরি করতে এসেছে চোরেরা। কালো–মোটা চোর নেতার নাম ফেসবুক আর তার এক সহযোগীর নাম গুগল। চোরেরা শফিককে আফজাল ভেবে আক্রমণ করে। প্রকৃত পরিচয় এবং আসার কারণ জানতে পেরে মুক্তি দেয়। শফিক ফ্রিজ থেকে পিটারের জন্য ওষুধ খুঁজে বের করে। ওষুধের ইউনিট নাম্বার পঞ্চাশ হাজার দেখে ফেসবুক ভাবে, ওষুধের দাম নিশ্চয়ই পঞ্চাশ হাজার টাকা। সুতরাং পাঁচটা ওষুধ নিয়ে যেতে পারলেই আড়াই লাখ টাকা!

এবার শফিককে মেরে আহত করে চোরেরা পালায়। যে গাড়িতে শফিক এসেছিল, সেই গাড়িটাও চোরেরা নিয়ে যায়। সাহায্যদাতা গাড়িমালিক বন্ধু তখন শফিককে খুঁজতে ডা. আফজালের বাসায় আসে। শফিক বুঝতে না পেরে অন্ধকারে তাকে মেরে আহত করে বেরিয়ে আসে। শফিককে গাড়িচোর ভেবে সে আবার থানায় গিয়ে ডায়েরি করে।

এদিকে শফিক ফেসবুক চোরের সন্ধান খুঁজতে খুঁজতে অন্য একজন গাড়িচালকের সাহায্য নিয়ে হোটেলের নর্তকী, গণিকা দিলরুবার কাছে এসে পৌঁছায়। দিলরুবা চরিত্রে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত মনে দাগ কেটে যায়। পুলিশ হানা দিয়ে দিলরুবার ঘর থেকে শফিককে তুলে নিয়ে যায়। পুলিশকর্তা চরিত্রে অমল বোসের অভিনয়ও বেশ মজার। পুরোনো এক ছাত্র-পুলিশের সাহায্যে শফিক থানা থেকে মুক্তি পায়। অন্যদিকে সালমান শফিককে পানশালায় গণিকার সঙ্গে দেখতে পেয়েছিল। শফিকও সালমানকে দেখতে পায়। নিজেকে সালমানের যমজ ভাই শাহারুখ পরিচয় দিয়ে এড়িয়ে গিয়েছে তখন।

সেই সালমান দীপার কান ভাঙাল। ডাক্তারের বাড়ি না গিয়ে শফিক গণিকার দরবারে এসে মজা লুটছে। সব শুনে দীপা রেগে আগুন। শফিক অবশ্য ফোন করে সব বিস্তারিত ঘটনা জানিয়ে দীপার রাগ ভাঙায়। দিলরুবার কাছে ফেসবুকের ঠিকানা পেয়ে শফিক সেখানে হানা দেয়। দীপাও মিস্টার গোমজ এবং সালমানের দলবল আর পুলিশ নিয়ে সেখানে চলে আসে। দীপার সঙ্গে শফিকের যুদ্ধের ময়দানে এখানে একটা ক্ষণিকের অন্তরঙ্গ মুহূর্ত তৈরি হয়। শফিকের অনুরোধে দীপা অবশ্য আবার বাসায় ফিরে যায়।

ফেসবুকের পিছু ধাওয়া করে শফিক ওষুধ উদ্ধার করে। শফিকের সঙ্গে ফেসবুকের টানা লড়াই শেষে সালমানের দলবল চোরেদের পরবর্তী পিটুনির দায়িত্ব নেয়। ফেসবুক চরিত্রে কাবিলা বেশ মজার অভিনয় করেছে। শফিক ওষুধ নিয়ে ফিরলে দীপা, মিস্টার গোমজ সবাই বেশ স্বস্তি অনুভব করে। দীর্ঘ সময় ওষুধের অভাবে পিটারের অবস্থা তখন বেশ খারাপ। আগেই বলেছি গল্পের এই জায়গাগুলো ঠিক গোঁজামিল নয়, গরমিল দিয়ে মেলানো। কিন্তু গল্পে যদি গরু গাছে না ওঠে অধিকাংশ মানুষের মনোরঞ্জন হবেই–বা কী করে? যাহোক, এবার দেখা যায় শফিকের এত লড়াই করে আনা ইনজেকশনের প্যাকেটে আবার ইনজেকশন নেই।

ডা. আফজাল চৌধুরী চরিত্রে হুমায়ুন ফরিদী এবার নিজেই এসে উপস্থিত হয়। নিজের ব্যাগ থেকে সেই দুষ্প্রাপ্য ইনজেকশন বের করে পিটারকে সুস্থ করে তোলে। শফিক আফজালকে গতকালের সব ঘটনা জানায়। কিন্তু ওষুধ উদ্ধার করে এনে দীপাসহ সবার চোখে তৎক্ষণাৎ সে নায়ক হয়ে উঠেছিল। ওষুধ না থাকাতে সেই নায়কত্বে এবার ভাটা পড়ে। পরাজিত বিমর্ষ হতাশ নায়ক এবার নিচে নেমে আসে। এবার বাড়ি ফিরতে হবে। নিজে হেরে গেলেও পিটার সুস্থ হয়ে উঠেছে, সেই আনন্দ তার মধ্যে কাজ করছে। নায়িকা হেরে যাওয়া নায়কের পাশে এসে দাঁড়ায়। এসে বলে, চলো, ঘরে চলো। তুমি তো আমার সঙ্গে এক কাপ চা খেতে এসেছিলে। নায়ক আবার মনে মনে চনমনে হয়ে ওঠে। গতকাল বিকেলে সে চা খেতে এসেছিল। এখন পরদিন সকাল। রোজকার মতো কলেজ যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে।

গতকাল আনা ফুল শফিক আবার দীপার হাতে তুলে দেয়। দীপা শুধু ফুল নয়, প্রেম প্রস্তাব এবং সারা জীবন পাশে থাকার অঙ্গীকারও হৃদয় পেতে নিয়েছে। শফিকের বুকে মাথা রেখে এখন শুধু মৌখিক সম্মতিটুকু জানিয়ে দিল। তেঁতুলবনে এবার শফিকবাবুর বাঁশি বাজার পালা। বাঁশি আকুলি-বিকুলি সুরে মজে, দীপাদেবীর গলায় মালা ওঠে।

এই চলচ্চিত্রের ‘স্বপ্ন দেখি’ গানটা লিখেছেন কবীর বকুল। সংগীত পরিচালনায় নচিকেতা, আইয়ুব বাচ্চু, ফুয়াদ আল মুক্তাদির। আবহ সুর করেছেন ইমন সাহা। বাসু চট্টোপাধ্যায়ের চিত্রনাট্য, সংলাপ বেশ। মাহফুজুর রহমান খানের চিত্রগ্রহণ চোখে আরাম এনে দেয়। অসিত বোস, তৌহীদ হোসেন চৌধুরীর সম্পাদনাও ভালো। গানের কণ্ঠে বাকি যাঁরা ছিলেন এন্ড্রু কিশোর, রুনা লায়লা, আয়ুব বাচ্চু, কুমার বিশ্বজিৎ, আঁখি আলমগীর প্রত্যেকেই কিংবদন্তি। আমজনতার জন্য রসে টইটম্বুর একটা জমিয়ে দেওয়া ছবি ‘এক কাপ চা’।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত