ত্যাগের মহিমা নিয়ে প্রস্তুতি চলে ঈদুল আজহার। ঈদের আনন্দের আমেজ শুরুই হয় প্রস্তুতি নিয়ে। যেহেতু এই ঈদে কাজের চাপ অনেক বেশি, তাই প্রস্তুতিটাও বেশি। একদিকে যেমন প্রিয়জনের কাছে যাওয়ার প্রস্তুতি, অপর দিকে কোরবানির। সেই সঙ্গে নিজেকে সুন্দরভাবে পরিবেশন করার যে চেষ্টা করা হয়, এ জন্য সাধারণত রোগীরা তাঁদের ত্বকের যত্নের রুটিনকে একটু বাড়াতে চান। এত দিন ধরে হয়তো যে রুটিনটি পালন করে আসছিলেন, তার থেকে এমন কিছু চান যেন ত্বকের সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারেন। যাঁরা কোনো দিন হয়তো কোনো রুটিন মানেননি, তাঁরাও ঈদের আগে একটি নতুন রুটিন তৈরি করতে চান। সবাই এখন অনেক সচেতন। তাই তাঁরা সাধারণত কোনো ক্লিনিকে এসে সৌন্দর্যের যত্ন নিতে চান।
চুলের যত্ন কীভাবে নেব
প্রথমেই আসি, চুলের যত্ন প্রসঙ্গে। অনেকেই স্ক্যাল্প হেলথকে (মাথার চুল গজানোর স্থান) অবহেলা করি। কিন্তু স্ক্যাল্প হেলথের ওপরই আমাদের চুলের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত সুস্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য নির্ভর করে। অনেকেই জানি না মুখ ও শরীরের ত্বকের থেকে মাথার ত্বকের এজিং অনেক দ্রুত হয়। বলা হয়, শরীরের থেকে ১২ গুণ ও মুখের থেকে ৬ গুণ বেশি বার্ধক্যের ছাপ পড়ে মাথার ত্বকে বা স্ক্যাল্পে। সেই স্ক্যাল্পকে যদি হাইড্রেটেড না রাখি, ময়েশ্চারাইজড না রাখি, তাহলে স্ক্যাল্পের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চুলও ক্ষতিগ্রস্ত, নিষ্প্রাণ ও রুক্ষ হবে এবং কপালের ত্বক কুঁচকে যাবে, বার্ধক্যের ছাপ খুব দ্রুত আসবে।
আমরা সাধারণত যা করি, ঈদের সময় অবশ্যই শেষ মিনিট চুলের যত্নের এক্সপেরিমেন্ট এড়িয়ে চলব। কেননা, এ ভুলটিই আমরা বারবার করে থাকি। যেমন চুলে রং করা, শুষ্ক করা, কেমিক্যাল ট্রিটমেন্ট করা, স্ট্রেইট হেয়ারকে কার্ল বা পাম অথবা কার্ল হেয়ারকে স্ট্রেইট করা। এ ছাড়া তাপ ও স্টাইলিং টুলসও খুব বেশি ব্যবহার করে থাকি এ সময়গুলোয়। ফলে চুল ভেঙে পড়ে, রুক্ষ ও শুষ্ক হয়ে যায়। সে জন্য এ ধরনের চিকিৎসাগুলো ঈদের আগে হঠাৎ না করাই ভালো। যদি নিতেই হয়, তাহলে কমপক্ষে এক বা দুই সপ্তাহ আগে নিয়ে প্রস্তুত করব চুলকে। আর যদি চুলকে কেমিক্যাল ট্রিটেড করেই থাকি, সে জন্য দরকার বিশেষ যত্নের। এ ক্ষেত্রে হেয়ার সিরাম ব্যবহার করব। যে সিরামে থাকে সেরামাইড। এটি চুলের কিউটিকলকে (চুলের খাদ্যের সবচেয়ে বাইরের অংশ) ঠিক করে, চুলকে অতিবেগুনি রশ্মি থেকে রক্ষা করে। সেই সঙ্গে হিটিং টুলসগুলো থেকেও রক্ষা করে বা হিট সুরক্ষা হিসেবে কাজ করে। চুল যদি শুষ্ক বা কেমিক্যাল ট্রিটেড হয়, সেটিকেও রক্ষা করে। অর্থাৎ চুলের রং দ্রুত নষ্ট হতে দেয় না।
শ্যাম্পুর ক্ষেত্রে আমাদের একেকজনের মাথার ত্বক একেক রকম। কারও শুষ্ক, কারও তৈলাক্ত আবার কারও সেনসিটিভ। এ ছাড়া প্রিএগজিস্টিং কোনো রোগ, যেমন সোরিয়াসিস, সিবোসোরিয়াসিস, স্ক্যাল্প ডার্মাটাইটিস থেকে থাকে, সে অনুযায়ী শ্যাম্পু ব্যবহার করা হয়। ত্বকবিশেষজ্ঞরা সে অনুযায়ী শ্যাম্পু দিয়ে থাকেন। যেমন যাঁদের চুল খুব শুষ্ক, তাঁদেরকে জোজোবা অয়েল, আমন্ড অয়েল, অলিভ অয়েলযুক্ত শ্যাম্পু, কন্ডিশনার এবং যাঁদের স্ক্যাল্প খুব তৈলাক্ত, তাঁদেরকে অ্যাপল সিডার ভিনেগারযুক্ত শ্যাম্পুর পরামর্শ দিয়ে থাকি। খুশকির ক্ষেত্রে অ্যান্টি-ড্যানড্রাফ, কিটোকোনাজল এবং যাঁদের সোরিয়াসিস থাকে, তাঁদেরকে স্টেরয়েডযুক্ত শ্যাম্পু সাময়িক সময়ের জন্য ব্যবহার করতে বলি। দেখা যায়, যাঁদের স্ক্যাল্প তৈলাক্ত কিন্তু চুল আবার ভঙ্গুর ও রুক্ষ, তাঁরা তৈলাক্ত স্ক্যাল্পের জন্য খুব রাফ বা হার্শ শ্যাম্পু ব্যবহার করেন, যেন অয়েল নিয়ন্ত্রণে থাকে। ঘন ঘন শ্যাম্পু ব্যবহারের ফলে মাথার ত্বকের তৈলাক্তভাব তো নিয়ন্ত্রণ হয়ই না, বরং চুলের প্রাকৃতিক তেলকে বের করে নিয়ে চুলগুলোকে রুক্ষ ও শুষ্ক করে ফেলে।
যখন কেমিক্যাল ট্রিটমেন্টগুলো নিয়ে থাকি বা চুলের স্টাইলিং করে থাকি, তখন সুরক্ষার জন্য আমরা সাধারণত ঈদের আগে রোগীদের চুলের পিআরপি থেরাপি করতে বলি। যেটি একাধারে চুল পড়া বন্ধ করে, কিউটিকল ঠিক করে ও চুলকে মসৃণ ও উজ্জ্বল রাখে।
ত্বকের যত্ন কীভাবে নেব
এখন যেহেতু হাইড্রা ফেসিয়ালের বেশ প্রচলন, তাই সবাই এসেই বলেন যে হাইড্রা ফেসিয়াল করব। হাইড্রা ফেসিয়ালে বিভিন্ন ধরনের সিরাম ব্যবহার করা হয় ত্বকের ধরন অনুযায়ী। একজন ত্বকবিশেষজ্ঞ যখন হাইড্রা ফেসিয়ালের পরামর্শ দেবেন, তখন তিনি রোগীর ত্বক পরিপক্ব কি না, তাঁর মেছতা ও ব্রণ—এগুলো ভেবেই সিরাম নির্ধারণ করে থাকেন। কিন্তু এটি যখন কোনো স্যালুন বা অথেনটিক জায়গায় না থাকে, তখন কিন্তু বোঝা যায় না কী ধরনের ত্বকে কোন ধরনের সিরাম ব্যবহার করা হবে। ফলে ত্বকে জটিলতা দেখা দেয়।
আবার সবার জন্য হাইড্রা ফেসিয়াল প্রযোজ্য নয়। যেমন ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী রোগীদের ত্বক যদি তৈলাক্ত থাকে, তাঁদেরকে আমরা ব্লু লাইট, মাইক্রোডার্মাব্রাশন পরামর্শ দিই, কেমিক্যাল পিলও পরামর্শ করে থাকি। শরীরে যদি ব্রণ থাকে, সে ক্ষেত্রে স্যালি পিল, ল্যাকটিক পিল ও ত্বকের জন্য প্রোবায়োটিক পিল। যাঁদের পরিপক্ব ত্বক, তাঁদের জন্য অ্যান্টি–এজিং পিল পরামর্শ করে থাকি। যেখানে কোষ কমিউনিকেটর ইনগ্রেডিয়েন্ট থাকে, যেগুলো বার্ধক্যের ছাপ কমায় এবং প্রিএগজিস্টিং কোনো সমস্যা থাকলে, সেটিকে ঠিক করে এবং ত্বকের টেক্সচারকে উন্নত করে উজ্জ্বলতা বাড়ায়।
এরপরও অনেকে ত্বকে পিআরপি করেন। চুলের মতো এই পিআরপিও ত্বককে শুষ্ক রাখে, ময়েশ্চারাইজ রাখে, ত্বকের টোনকে পরিষ্কার করে, টেক্সচারকে উন্নত করে ও প্রিম্যাচিউর এজিংকে বাধা দেয়। যাঁরা মেকআপের ফ্ললেস লুক আনতে চান অথবা মেকআপ যাঁদের সেট হতে চায় না, তাঁদের জন্য পিআরপি খুব ভালো একটি চিকিৎসা। তবু অনেকে ঈদের আগে ত্বককে একটু মসৃণ ও পরিষ্কার রাখতে চান, অপ্রয়োজনীয় বা ডাবল চিনকে কমাতে চান, তাঁরা হাইফু ট্রিটমেন্ট করে নিতে পারেন। এটি হাই ইনটেনসিটি ফোকাসড আলট্রাসাউন্ড, যা একেবারেই নিরাপদ।
স্বাস্থ্যের যত্নে খাবার
খাবারের ক্ষেত্রে প্রথমেই যে ব্যাপারটি রাখতে হবে, ঈদের সময় আমাদের লাল মাংসের অসংখ্য অপশন থাকে। আবার এ সময়টি কিন্তু মৌসুমি ফলের সময়। সব ক্ষেত্রে আমরা একটু খাবারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করব। আমাদের মনোযোগ থাকবে পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের ওপর, যেন উৎসবের খাবারটাকে উপভোগ করতে পারি। খাবারের ক্ষেত্রে রান্না, যেটি আমরা খুব সাধারণ পদ্ধতিতে করব। গ্রিল বা বেকিংয়েও যেতে পারি।
ডেজার্টের ক্ষেত্রে এখন অনেক রকম ফল আছে, বিশেষ করে মিষ্টি ফলগুলো। বেশি পরিমাণে মিষ্টি ফলও খাওয়া যাবে না। পরিমাণমতো খেতে হবে। মিষ্টি ফল দিয়ে কিন্তু ফলের সালাদ, কাস্টার্ড ও পুডিং করা যায়। নারকেলের পানি, নারকেলের দুধ বা পাল্প দিয়েও অনেক ধরনের স্বাস্থ্যসম্মত ডেজার্ট করি, যেটাতে মিষ্টির ক্রেভিং যাঁদের আছে, তাঁদের এই নির্ভরশীলতা একেবারেই কমিয়ে আনা সম্ভব। টক দই দিয়েও ডেজার্ট বানাতে পারি। কোমল পানীয়ের পরিবর্তে লেবুর পানি, বিশুদ্ধ পানি, ডাবের পানি ও টক দইয়ের লাচ্ছি পরিবেশন করতে পারি। তাহলে হবে কী, ঈদে তো কয়েক দিন ধরে অতিথি আপ্যায়ন বা খাবারদাবারের ব্যাপারটি চলে, আমরা যদি প্রতিদিন একটু একটু করে খাবারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করি এবং সঙ্গে একটু হালকা শরীরচর্চা, হাঁটা বা ব্যায়াম করি, তাহলে দেখব যে ঈদের পরে বাড়তি ওজনের যে ব্যাপার থাকে, সেটিও কমে আসবে এবং আপনি থাকবেন সুস্থ।
ঈদের খুশি ছড়িয়ে পড়ুক প্রতিটি ঘরে ঘরে। সুস্থ ও সুন্দর হোক আপনার ঈদ।
ওয়েলনেস অ্যান্ড বিউটি কনসালট্যান্ট এবং স্বাস্থ্য ও ক্রীড়া সম্পাদক, বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ