আনন্দদায়ক মৃত্যু

গল্পটি ২০২৪ সালের জুনে প্রকাশিত বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের ‘তারুণ্য’ ম্যাগাজিনের দশম সংখ্যা থেকে নেওয়া।

অলংকরণ: অভিনয় আহমেদ

‘দাদা, আপনি তো জীবনে অনেক কিছুই দেখছেন, অনেক কিছুই পাইছেন। কোনো শখ বাকি আছে?’ আগ্রহের সঙ্গে আমি দাদাকে জিজ্ঞেস করলাম।

‘আনন্দদায়ক মৃত্যু’—দাদা শান্তকণ্ঠে জবাব দিল।

‘সেটা আবার কেমন শখ, মৃত্যু কি কখনো আনন্দদায়ক হয়! সব মৃত্যুই তো বেদনার!’ বিস্মিত হয়ে বললাম।

‘কিছু মৃত্যু আছে, যা বেদনার নয়। চারপাশে থাকবে আমার প্রিয় মানুষগুলো। মৃত্যুর আগে শেষবারের মতো তাদের মুখগুলো দেখতে পারা হবে পরম প্রাপ্তি। এ রকম একটি মৃত্যুই হবে আনন্দদায়ক মৃত্যু।’ কথা বলতে গিয়ে দাদার মুখে এক অদ্ভুত দীপ্তি খেলে যায়।

‘কিন্তু দাদা, আপনার জীবনে তো আরও অপূর্ণতা রয়েছে। সেগুলো নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই?’

‘কিছু অপূর্ণতা থেকে যাওয়া ভালো। সব চাওয়া পূর্ণতা পেলে জীবনের স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়।’

বছর পাঁচেক আগে এক কথোপকথনে দাদার এই অদ্ভুত ইচ্ছার কথা জানতে পারি। মৃত্যু নিয়েও যে মানুষের শখ থাকতে পারে, তা ছিল আমার কল্পনার বাইরে।

****

আমার দাদা ব্রিটিশ আমলের মানুষ। আমরা যেমন জন্মের পর ভেজাল খেয়ে বড় হয়েছি, তাঁদের সেই দুর্ভাগ্য হয়নি। সোনার চামচ মুখে নিয়ে না জন্মালেও সোনালি সময়ে জন্মেছিলেন তিনি। জীবনে অনেক কিছু পেয়েছে, সাক্ষী হয়েছেন অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার।

ছোটবেলা থেকে দাদা-দাদির সান্নিধ্যে ছিলাম। শৈশব-কৈশোর কেটেছে তাঁদের অভিভাবকত্বেই। এইচএসসির পর গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমালেও আত্মার বন্ধন ছিন্ন হয়নি। আমি ছিলাম তাঁদের নয়নের মণি। প্রতিবার ছুটিতে যখন বাড়িতে যেতাম, তাঁদের আনন্দ হতো আকাশচুম্বী।

কালের পরিক্রমায় দাদার এই অদ্ভুত শখের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। দীর্ঘদিন বিভিন্ন রোগে ভুগে তিন বছর আগে দাদি মারা যান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দাদার শরীরও বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে। এর মধ্যে একদিন হঠাৎ করে খবর আসে, দাদা বেশ অসুস্থ। হয়তো বেশি দিন বাঁচবেন না। আত্মীয়স্বজন সবাই ছুটে গেল তাঁকে শেষবারের মতো দেখতে। আমাকেও বারবার বলা হলো বাড়িতে যেতে। কিন্তু পরীক্ষা একদম দরজায় কড়া নাড়ায় ওই মুহূর্তে বাড়ি যাওয়া সম্ভব ছিল না। বাড়িভর্তি মানুষ থাকা সত্ত্বেও দাদা বারবার আমাকে দেখতে চাইছিলেন। এরই মধ্যে তাঁর শরীরের অবস্থা ক্রমেই অবনতি হয়ে একপর্যায়ে স্মৃতিবিভ্রম হয়। উল্টাপাল্টা কথা বলতে শুরু করেন। তার মধ্যেও তিনি বেশ কয়েকবার আমার কথা জিজ্ঞেস করেন।

আমার মনে পড়ে দাদার বলা ‘আনন্দদায়ক মৃত্যুর’ কথা। হয়তো এটাই তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়। পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে গ্রামের বাড়ি হওয়ায় ঢাকা থেকে ৮-১০ ঘণ্টা লাগে সেখানে পৌঁছাতে। সন্ধ্যার পর রওনা দিয়ে ফজরের আজানের পরই গ্রামে পৌঁছাই। বাড়িতে পৌঁছে তাঁর বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়াই। সৌম্য চেহারার বৃদ্ধ মানুষটি তখন চোখ দুটো বড় করে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু তাঁর হাত-পা এবং শরীরের অন্যান্য অংশ ছিল একদম নিথর। কয়েক মুহূর্ত পর সবাই বুঝতে পারে যে দাদা আর বেঁচে নেই।

মুরব্বিরা সবাই বললেন, শান্তির মৃত্যু হয়েছে তাঁর। কিন্তু আমার মনের ভেতর প্রশ্ন রয়ে যায়, আসলেই কি তার শান্তির মৃত্যু হয়েছে? আনন্দদায়ক মৃত্যুর যে স্বপ্ন সে দেখেছিল, তা কি পূর্ণ হয়েছে? মৃত্যুর আগে সে বারবার আমাকে দেখতে চেয়েছিল। সে কি শেষবারের মতো আমাকে দেখতে পেয়েছিল?

এখনো মাঝেমধ্যে দাদার কবরের পাশে গিয়ে চিন্তা করি, ‘আনন্দদায়ক মৃত্যুর দেখা কি তিনি পেয়েছিলেন?’ তবে বহু বছর আগে তাঁর বলা কথাটি মনে পড়লে সান্ত্বনা খুঁজে পাই, ‘কিছু অপূর্ণতা থেকে যাওয়া ভালো। সব চাওয়া পূর্ণতা পেলে জীবনের স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়!’

বন্ধু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা