মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি

‘আগু‌নের পরশম‌ণি’র শুটিংয়ে হুমায়ূন আহমেদছবি: সংগৃহীত

এক—
‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক,
আমি তোমাদেরই লোক,
আর কিছু নয়—
এই হোক মোর শেষ পরিচয়।’

কিংবদন্তি লেখক হুমায়ূন আহমেদের পরিচয় ছিল তিনি যেন আমাদেরই লোক। যত দিন বেঁচে ছিলেন, আমাদের কথাই বলে গেছেন। আমাদের জীবনের ছোট ছোট ভাবনা, দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনা ধারণ করেছেন নিজের মধ্যে। আমরা অনেক কিছু ভাবি। কিন্তু সব কি বলতে পারি? তিনি আমাদের হয়ে সেটা বলছেন। কেউ যখন আমাদের কথা, আমাদের হয়ে, আমাদেরই বলেন, তখন তিনি হয়ে ওঠেন একান্তই আমাদের।
এই বাংলায় তিনি যেন মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি হয়ে এসেছিলেন। তাদের বেড়ে ওঠা, রহস্যময় ভাবনা, সবকিছুতেই ছিলেন তিনি। মধ্যবিত্তের ‍টানাপোড়নের এই জীবনকে তিনি যেভাবে দেখেছেন, সেভাবেই গল্প-উপন্যাস, নাটক, সিনেমায় হাজির করেছেন। তাঁর দেখার দৃষ্টি ছিল অন্যদের থেকে আলাদা। উপস্থাপনার মধ্যে ছিল নান্দনিক সৌন্দর্য। উপন্যাস-নাটকের চরিত্রগুলো অবিকল জীবন নয়। কিন্তু তারা যেন জীবন যে রকম, সে রকম হয়ে ওঠে। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস-নাটকের চরিত্রগুলোর বাস্তবতা, বিশ্বস্ততা ও প্রাণ এতটাই জীবনবান্ধব যে কাল্পনিক চরিত্ররা হয়ে ওঠে বাস্তব জীবনের প্রতিনিধি।

কিন্তু এই সৃষ্টিশীল মানুষটি বেশি দিন বেঁচে থাকলেন না পৃথিবীতে। মৃত্যু অনিবার্য বলেই মানুষ হয়তো জীবনকে এত ভালোবাসে। তিনিও ভালোসেবেছিলেন। কিন্ত হার মানতে হলো নিয়তির কাছে। তাঁর অমর সৃষ্টি মিসির আলি, হিমু, রূপা ও নিলুদের দেখতে আর কোনো দিন ফিরে আসবেন না। তবে চিরদিন বেঁচে থাকবেন মানুষের মননে, চিরন্তন ভালোবাসায়।

দুই—
জীবনে রসায়ন প্রয়োজন। এটা না থাকলে নাকি জীবনও সুন্দর হয় না। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের রসায়ন ছিল জটিল। এমন একটি জটিল বিষয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন। আর সেই তিনিই সৃষ্টি করেছেন মিসির আলি ও হিমুর মতো বৈচিত্র্যময় সব চরিত্র। হিমু তাঁর এক অমর সৃষ্টি। আবেগ–অনুভূতিহীন এক অনবদ্য চরিত্র। পৃথিবীর সব যুক্তির ঊর্ধ্বে থাকে। অনেকটা দায়িত্বহীন। স্বাধীনচেতা। নিজের যা ভালো লাগে, তা-ই করে।

হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর ১৯৪৮—১৯ জুলাই ২০১২)।
প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

মিসির আলি চরিত্র আমাদের যুক্তির মধ্যে নিয়ে যায়। কিন্তু দুজনকেই আমরা পছন্দ করি। দুজনই আমাদের প্রিয় হয়ে ওঠে। মুগ্ধ করার মতো এমন চরিত্র বাংলা সাহিত্যে আর কেউ সৃষ্টি করতে পেরেছেন বলে জানা নেই। তাই বাংলা উপন্যাসে মিসির আলি ও হিমুর আগমন হয়তো এক অভূতপূর্ব সংযোজন। মিসির আলি জটিল সমস্যার মনস্তাত্ত্বিক সমাধান দেয়। আমরা বিভিন্ন সমস্যায় তার কাছে যাই। সে আমাদের মিস্টার সমাধান। আমাদের দৈনন্দিন চলার পথের নির্ভরতার প্রতীক।
এ দুটি চরিত্র অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছে। উপন্যাসে এনেছে ভিন্নমাত্রা। পাঠককে আন্দোলিত করেছে। বইমুখী করেছে। আমাদের জীবনের আবেগ, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভালো লাগা-মন্দ লাগার যত বিষয় আছে, এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তাঁর উপন্যাসে। তাই একসময় বাংলা একাডেমির বইমেলা অনেকটা তাঁর বইনির্ভর হয়ে উঠেছিল।

তিন—
হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন উপন্যাসের জাদুকর। নানাভাবে বাংলা উপন্যাসকে সমৃদ্ধ করেছেন। বহুমাত্রিকতায় লিখেছেন। সেই প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ থেকে শুরু করে ‘আগুনের পরশমণি’, ‘মধ্যাহ্ন’, ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, ‘মাতাল হাওয়া’ এবং একেবারে শেষের দিকের দেয়াল কী আশ্চর্য সব সৃষ্টি! কেবল উপন্যাসেই নয়, ছোটগল্পেরও তিনি অসাধারণ নির্মাতা। লিখেছেন অসংখ্য ছোটগল্প। সাধারণ বিষয় নিয়ে লিখেছেন অসাধারণ গল্প। তিনি বাংলা গল্পেও এনেছেন নতুন মাত্রা।
জীবনের বিচিত্র দিক এসেছে তাঁর ছোট গল্পে। অতিপ্রাকৃত, ভৌতিক, রহস্য—বিভিন্ন ধরনের গল্প লিখেছেন। তাঁর ছিল গল্প বলার সম্পূর্ণ এক নিজস্বতা। গল্পকে তিনি মুক্তি দিয়েছেন গল্প বলার চিরায়ত ধারা থেকে।

গল্পের এই অভিনব কৌশল তাঁকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। আর তাই অল্প সময়ে পাঠকের অনেক বেশি প্রিয় হয়েছেন। শরৎচন্দ্রের বেলায় যেমন বলা হয় নারীর চোখের জলের হিসাব রাখার জন্যই লিখেছেন। এ দায় যেন তাঁর, তেমনি হুমায়ূন আহমেদের ক্ষেত্রেও বলা হয়, তিনি যেন মধ্যবিত্তের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার কথা বলার জন্যই লিখেছেন। তিনি যেন তাদের প্রাণের মানুষ। আপনজন, যাঁকে মন খুলে সবকিছু বলা য়ায়।
‘ঘেটুপুত্র কমলা’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ও ‘আগুনের পরশমণি’ এই সিনেমাগুলো বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। এর সঙ্গে তিনি যুক্ত করেছেন বিভিন্ন দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত পোড় খাওয়া মানুষের জীবনের গান। যেমন ‘পূবালী বাতাসে...।’ ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়...।’ ‘সোয়া চান পাখি...।’ ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়...’ ইত্যাদি। প্রায় সবার কাছে এগুলো অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছে।

চার—
একসময় হুমায়ূন আহমেদ ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন’ নাটকে রাজত্ব করেছেন। নাটকে এনেছেন অভিনব বৈচিত্র্য। তাঁর নাটক দেখার জন্য দর্শকেরা প্রস্তুতি নিত। সব কাজ ফেলে টেলিভিশনের সামনে ভিড় করত। নাটকের চরিত্রগুলো হতো অনেক বেশি সংবেদনশীল। ‘বাকের ভাই’ তাঁর অসম্ভব একটি জনপ্রিয় নাটকের জনপ্রিয় চরিত্রের নাম। একটি খুনের অপরাধে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হবে। দর্শকেরা কোনোভাবেই এই মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না। তাঁর মৃত্যুর বিরুদ্ধে অনেক জায়গায় মিছিল হয়েছিল। কোনো নাটকের চরিত্রকে রক্ষার জন্য পৃথিবীতে কোথাও মিছিল হয়েছে কি না, জানা নেই। কিন্তু এই উপমহাদেশে হুমায়ূন আহমেদের নাটকের চরিত্রকে রক্ষার জন্য মিছিল হয়। বাকের ভাই নামের এ চরিত্র কিংবদন্তির মতো আজও মানুষের স্মৃতিতে রয়ে গেছে।

‘এইসব দিনরাত্রি’ নাটকের টুনির মৃত্যুকে দর্শক কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। টুনির জন্য দর্শক কষ্ট পেয়েছেন। তাঁদের চোখের পানি ঝরেছে। উপন্যাস-নাটকের চরিত্রগুলো অবিকল জীবন নয়। কিন্তু তাঁরা যেন জীবন যে রকম, সে রকম হয়ে ওঠে। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস-নাটকের চরিত্রগুলোর বাস্তবতা, বিশ্বস্ততা ও প্রাণ এতটাই জীবনবান্ধব যে কাল্পনিক চরিত্ররা হয়ে ওঠে বাস্তব জীবনের প্রতিনিধি। তাই তো বাকের ভাইয়ের মৃত্যুতে মানুষ মিছিল করে। টুনির মৃত্যুতে চোখের পানি ঝরে। ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘বহুব্রীহি’ ও ‘অয়োময়’-এর মতো নাটক তিনি উপহার দিয়েছেন। হাজারো বিনোদনের ভিড়েও মানুষ এসব নাটকের গল্প এখনো মনে রেখেছে এবং রাখবে।

পাঁচ—
হুমায়ূন আহমেদের গল্প-উপন্যাসের পরতে পরতে আনন্দ-বেদনা ও রসিকতা। আবার একই সঙ্গে পাওয়া যায় দার্শনিক তত্ত্ব। মানুষকে তিনি আনন্দ দিতে পারতেন। কিন্তু তাঁর নিজের জীবনটা ছিল ধু-ধু মরুভূমির মতো। অন্তরে গভীর ক্ষত নিয়ে নিরন্তর কাজ করেছেন। আনিসুল হক এক জায়গায় লিখেছেন, ফরিদুর রেজা সাগরের বাসায় হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দেখা। হুমায়ূন আহমেদ একটার পর একটা সিগারেট টানছেন। বললাম, আপনার না হার্টে অপারেশন? এত সিগারেট খান কেন? তিনি বললেন, ‘আমার জীবনে কত দুঃখ তুমি জানো? আমার জীবনের দাম কী? এই শহরে আমার মেয়েরা থাকে। আজ কতগুলো বছর আমি তাদের দেখি না।’ সে-ই তো বড় মানুষ, যিনি নিজের জীবনের এত দুঃখ গোপন করে অন্যকে আনন্দ দেন।

যতটা সত্য জন্ম, এর থেকে অনেক বেশি সত্য মৃত্যু। হুমায়ূন আহমেদ রোদ, বৃষ্টি, জোছনা ভালোবাসতেন। যেদিন তাঁর মৃত্যু হয়েছিল, সেদিনও অনেক বৃষ্টি হয়েছিল। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লাশ আনা হলো। সেটি ছিল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। অমর একুশের দিন ছাড়া এমন দৃশ্য দেখা যায় না। সহস্র মানুষ ফুল নিয়ে আসছেন শহীদ মিনারে। মধ্যাহ্ন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল মানুষের বাঁধভাঙা উপস্থিতি। কখন মাথার ওপর দিয়ে রোদ-বৃষ্টি যাচ্ছে, খেয়াল করছে না কেউ। কে নেই সেই শোকার্ত জনস্রোতে! মন্ত্রী, সংস্কৃতিকর্মী, টিভি–সিনেমার তারকা থেকে শুরু করে স্কুলের শিক্ষার্থী, শিশু-কিশোর, নারী, শ্রমজীবী, বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মী, এমনকি বাউল, দোকানদার, গাড়ির চালক সবাই আছেন। বিভিন্ন চ্যানেল শহীদ মিনার থেকে সরাসরি শ্রদ্ধা নিবেদনের পর্বটি প্রচার করছিল।

পথের বিভিন্ন স্থানে মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল প্রিয় লেখকের অন্তিমযাত্রা দেখার জন্য। বিশেষ করে নুহাশ পল্লীর প্রায় আট কিলোমিটার পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সী মানুষ রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। অগণিত মানুষের পদচিহ্নে ভারী হয়ে উঠেছিল নুহাশ পল্লী। মান্নাদের একটি বিখ্যাত গান আছে, ‘কে বলে তুমি নাই। তুমি আছো মন বলে তাই।’ বলতে চাই না তুমি নেই। তোমাকে খুঁজে নেব মেঘ, রোদ, বৃষ্টি, জোছনা, সমুদ্র, নীলাকাশ, শরৎ ও দুরন্ত প্রকৃতির মাঝে।

লেখক, সাংবাদিক ও সংগঠক