মানুষের জীবনশূন্যতা ও হাহাকার ‘নোনা পানি’ চলচ্চিত্রের মূল ভাষা

‘নোনা পানি’ চলচ্চিত্রের পোস্টার

সৈয়দা নিগার বানু খুলনার আঞ্চলিক জীবনগাথাকে সুচারু নিরীক্ষণ, শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে এনেছেন পূর্ণদৈর্ঘ্যের ‘নোনা পানি’ চলচ্চিত্রে। দীর্ঘ সাত বছরের কঠিন শ্রম ও নিরলস গবেষণার ফসল তাঁর এই চলচ্চিত্র।

চরিত্র, স্থান, গল্প খুলনার আঞ্চলিক যাপনের চিত্রমালা হলেও আমাদের পারিপার্শ্বিক চিরন্তন জীবনধারার কথা বলে। প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠ, যাতনা, বেদনা পরিস্ফুটিত হয়। আমাদের বলা না-বলা কথাও নিগারের দৃষ্টিতে খুঁজে পাই। খুলনার একটা অঞ্চলের সীমাবদ্ধতার মধ্যেই যেন অনেক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর গ্রামের কথা নিয়ে একটা ভুবনগ্রামের চিত্র গড়ে ওঠে।

দশপাই নামের একজন তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি, যার মধ্যে রয়েছে আত্মপরিচয় খোঁজার সংকট, যাকে আমরা নিয়ত ভিন্ন গ্রহের মানুষ ভাবি। সেই মানুষ কেমন সহজ-সরলভাবে সবার সুখ-দুঃখে মিশে যায়। আবার টিকে থাকতে না পেরে একসময় যা করার নয়, তা-ও করে ফেলে।

সমাজ কীভাবে প্রান্তিক শ্রেণির নারীকে দেখে, সাহায্য করে পাশে দাঁড়ানোর নাম করে কীভাবে ব্যবহার করে। পুরুষের চোখে নারীর শরীর, লোলুপ বিকৃত কামনা, তা যেমন এই চলচ্চিত্রে উঠে আসে; আবার অবদমনের খোলস ছেড়ে মানুষের জৈবিক যৌনতার শৈল্পিক মূল্যায়ন হয়।

জীবনকে একমুখী কোনো দৃষ্টিতে দেখা শিল্পের কাজ নয়। মানুষের জীবনচিত্র মানুষকে কীভাবে দেখানো হবে তার ওপরে রয়েছে মূল্যায়ন। গ্রামীণ একটি কুঁড়েঘর আমরা অনেকেই দেখেছি, এ আবার এমন কি বিষয়—এই বলে এড়িয়েও গিয়েছি। চলচ্চিত্রে দৃশ্যায়ন নান্দনিকতা সেই চেনা দৃশ্যকে এমনভাবে নতুন করে দেখায়, ভাবানোর চেষ্টা করে। ‘নোনা পানি’র আঞ্চলিক জীবন সেভাবেই আমাদের বুঝতে সাহায্য করেছে। প্রতিদিনের বেঁচে থাকার লড়াই, কুসংস্কার, সামাজিক রাজনীতির কূটকচালি, সাম্প্রদায়িক স্নায়ুর লড়াই, জলের স্রোতের সকাল-দুপুর, রাত্রি, সন্ধ্যা।

এ জীবনসংগ্রাম কিন্তু কোথাও এতটুকু তরলীকৃত হয়ে ওঠেনি। লঘু রসে পরিশীলিত-মার্জিত থেকেছে। সোহাগ নামের ছেলেটির চরিত্র যেমন ভালো লেগেছে, আবার সোহাগের মায়ের সংলাপ—‘সোহাগের মা বাঁচলে সোহাগও বাঁচবে’ ভাবিয়ে তুলেছে। অভিনেত্রী জয়িতা মহলানবিশকে মুহাম্মদ কাইয়ুমের ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ চলচ্চিত্রে দেখেছি। অসাধারণ অভিনয় করেন। একজন অভিনেত্রী চরিত্রবিশেষে কীভাবে নিজেকে ভেঙে আবার গড়ে নিতে পারেন, এই চলচ্চিত্রে তা দেখলাম।

বাংলার বিকল্পধারার চলচ্চিত্রের যন্ত্রণার সঙ্গে গ্রুপ থিয়েটারের যন্ত্রণার একটা মিল আছে। গ্রুপ থিয়েটারের কলাকুশলীদের আরও বেশি এ ধরনের চলচ্চিত্রে নিয়ে আসা প্রয়োজন। এতে অভিনয়ের জায়গাটা যেমন বহুমাত্রিক রূপ পাবে, দুই শিল্পের যন্ত্রণার বিনিময়ে মিলেমিশে শিল্পজগৎ অনেকটা সমৃদ্ধ হবে।

‘নোনা পানি’ চলচ্চিত্রে সুর ও গানের ব্যবহার খুবই ভালো। নোনা পানির জনজীবন নিয়ে চলচ্চিত্র, চারপাশে এত জল আর জল অথচ বৃদ্ধের গলা শুকিয়ে আসে, কলসে একফোঁটা পানীয় জল থাকে না। মানুষের এই জীবনশূন্যতা, হাহাকার এ চলচ্চিত্রের মূল ভাষা।

পরিচালক নিগার এই আর্তনাদের ভাষাকে তুলে আনতে পেরেছেন। বুকের ভেতর একটা যন্ত্রণা চারিয়ে দিয়েছেন।