মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে যে কিছু জানে না, দাবি করে এসেছে; এখন বলছে সে সবকিছু জানে, কিন্তু কিছুই বলবে না। এখানে এই মুহূর্তে এসে একজন সাধারণ মানুষও অসাধারণ হয়ে নিজের প্রাণের বিনিময়ে দেশের মান রক্ষা করে গেল।
উচ্চ মার্গের শাস্ত্রীয় সংগীতের পাশে কি কর্কশ প্রদাহময় গোলাগুলির শব্দ মানায়? যুদ্ধ মানেই তো হিংসা, রক্তপাত, খুনোখুনি। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তখন মানুষকে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হয়। প্রতিটি মানুষের বুকের ভেতরে একটা বাঁশি আছে। সে বাঁশি শিরায় শিরায় বেজে যায়। বাঁশিটা বাজে বলেই তীব্র প্রেম থেকে প্রতিবাদ আসে। রক্তচোষা শোষকের ভয়ংকর শক্তিশালী অস্ত্রের সামনে, প্রতিবাদে মুখরিত জনতার হাতে অস্ত্র উঠে আসে। বাধ্য হয়ে হাতে উঠে আসা এই অস্ত্রটিও মাটির শিকড়ে জল ঢেলে ফুলের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। শাস্ত্রীয় সংগীত লজ্জাপতি পাতার চাক্ষুষ শিহরণের মতো শরীরের রোমকূপে সাড়া জাগিয়ে দেয়, বুকের ভেতরে হৃৎস্পন্দনের মতো। বোধ আর চেতনার গভীরে যেন শিহরিত উদ্দীপ্ত শিখা। মহা ভারতীয় সুর সম্রাট তানসেন নাকি গান গেয়ে বৃষ্টি নামাতে পারতেন। আসলে তাঁর সেই সুরধারায় বুকের ভেতরে ঝড়ের দোলা লাগত। আর চোখ বন্ধ করে যদি সেই স্রোতে ভেসে যাওয়া যায়, তবে বন্ধ চোখের পর্দায় সত্যি সত্যি বৃষ্টিতে ভিজে উঠতে থাকে মন। তেমনই ঘন বর্ষার রাগে, মুক্তিযুদ্ধের দেশপ্রেমের একটা অনুরাগের ছবি বানিয়ে, আমাদের চেতনায় ঝড়ের মাতন লাগিয়ে দিলেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক জাহিদুর রহিম অঞ্জন।
শাস্ত্রীয় সংগীতের পাশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানাবে না কেন? রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘মেশিনগানের সম্মুখে গাই জুঁই ফুলের এই গান’। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘রেইনকোট’ গল্পের ছায়া অবলম্বনে পরিচালক অঞ্জনের একটি উচ্চ মার্গের রাগাশ্রয়ী চলচ্চিত্র ‘মেঘমল্লার’। স্বপ্নের মতো সুন্দর একটা ছবি, স্বপ্ন-বাস্তবতা-ইতিহাস হাত ধরাধরি করে এগিয়ে গিয়েছে। চলচ্চিত্রের ভাষাটা যদি কানে না আসত, শুধু ক্যামেরায় আঁকা এত সুন্দর দৃশ্যায়ণ, চিত্রায়ণ দেখে অনেকের মনে হতে পারত হলিউডের বিখ্যাত পরিচালকের কোনো ছবি। আবার ঝড়ের রাতে শিল্পীর অভিসারের মতো, বাংলার স্নাত পরম সবুজ প্রকৃতি, গাছপালা, মাঠঘাট, নদী—মাটির ভাষার আঁচল বিছিয়ে দিয়ে যায়। অন্ধকার ঘরে প্রদীপ প্রজ্বালনের মতো সংলাপে, নবজাতকের কান্নার শব্দের মতো আত্মপরিচয় উন্মোচন করে। সাহিত্যের অন্তর্মুখী চিন্তাধারা বহির্মুখী রূপ পায়। আমরা তো আসলে সবাই চলচ্চিত্র দেখি চলমান এসব দৃশ্য রূপ দেখব বলেই।
প্রায় সারাক্ষণই বৃষ্টি পতনের শব্দ, পণ্ডিত তুষার দত্ত আর আইভি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে রাগ সংগীত, মুক্তিযুদ্ধের গল্পকে ভিন্ন মাত্রা এনে দেয়। ছবির মতো টুকরো টুকরো দৃশ্য কখনো সংলাপকেও ছাপিয়ে যায়। এই ছবির সংলাপ অনেক মূর্ত অবয়বের ভেতরে যেন প্রাণস্পন্দন ছড়িয়ে দেয়। এখানে গর্জন করে কেউ ‘জয় বাংলা’ বলে না, গুলি খাওয়া মানুষ নিষ্প্রাণ হতে হতে জয় বাংলার আহ্বান ছড়িয়ে দিয়ে যায়। সেই আহ্বানের সঙ্গে শিল্প মাধুরী মিশিয়ে বহু কষ্টের বেদনার রক্তক্ষয়ের স্বাধীনতা আসে। এ যেন শুধু এক দেশ স্বাধীন করার গল্প নয়, শিল্পের মতো একটা ঝড়ের রাতের দেশকে কৃষ্টিতে ভর করে ভোরের আলোর দিকে নিয়ে যাওয়ার উত্তরণ।
শেষ দৃশ্য বড় চমৎকার, শাস্ত্রীয় সংগীতের মূর্ছনা, ট্রাকের সামনে ছোট্ট জয় বাংলার পতাকা, আর একজন মুক্তিযোদ্ধা তার স্বামীহারা বুবু এবং ভাগনিকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাড়ি ছেড়ে নিয়ে যাচ্ছে। ভয়ভীতি আক্রান্ত পরাধীন দেশের একটা বাসা বদলের মধ্য দিয়ে যেন নতুন একটা দেশে আবার নতুন করে বাঁচার আশা। একটা খাঁচা থেকে অন্য খাঁচার উদ্দেশে ছুটে চলা জীবন। এই পুরোনো বাসার হাতে ঘোরানো সেলাই মেশিন, পুরোনো আসবাবপত্রগুলোও ইতিহাসের দিকনির্দেশক।
মুক্তিযুদ্ধের বছরে বর্ষা স্থায়ী হয়েছিল দীর্ঘদিন। সেই বর্ষার সময়টাকেও গল্পে ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তুলে আনা হলো। মুক্তিযুদ্ধের প্রচলিত গানের সুর আবহে খুবই কম এসেছে। রাগ বন্দনা রাগের ছোঁয়ায় চলমান জীবনের গভীর শূন্যতাকে ধীরে ধীরে পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে কত মানুষ চলে গিয়েছে, সেই মানুষকে জীবনে আশ্রয় করে যাঁরা বেঁচে ছিলেন, বেঁচে আছে তাঁদের যন্ত্রণা, ভেতরের ক্ষরণ জীবন শূন্যতা নিপুণ দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে সমষ্টির প্রতিনিধি একজন ব্যক্তি মানুষ আসমার মধ্য দিয়ে তুলে আনা হয়েছে। এই আসমা চরিত্রে এত সুন্দর স্বাভাবিক সাবলীল অভিনয় করেছেন, নাসির উদ্দীন ইউসুফের ‘গেরিলা’ থেকে যেমন জয়া আহসান, ‘মেঘমল্লার’ থেকে রাগ-রাগিনীর কন্যা অপর্ণা ঘোষের উত্তরণ হলো।
ছবির নাম দেখেই তো বোঝা যায়, ‘মেঘমল্লার’ কল্পনা এবং বাস্তবের মিশেলে অন্তর জাগরণে আমাদের মুক্তির হাতছানি।
এই আসমার স্বামী অধ্যাপক নুরুল হুদা দেশ, রাজনীতি, উত্তাল সময়—সবকিছু থেকে গা বাঁচিয়ে চলা মানুষ। নিরপেক্ষ থাকতে চাওয়া মানুষ। এই চরিত্রটিও অতি সাধারণ ছাপোষা জীবনে অভ্যস্ত মধ্যবিত্ত মানসিকতার। কিন্তু সময়ের প্রেক্ষাপট তাকেও নিরীহ হয়ে থাকতে দেয় না। নিজের মুক্তিযোদ্ধা শ্যালক মিন্টুকে সে এড়িয়ে চলে। কিন্তু দিদির বাড়িতে হঠাৎ চলে আসা এবং চলে যাওয়া মিন্টুর ফেলে যাওয়া একটা রেইনকোট এই গল্পের মূল চাবি হয়ে উঠল।
খাকি সৈনিকের পোশাক পরে যেমন মানুষের চরিত্র পাল্টে যায়। নিজের ভেতরে হিংস্র, পাশবিক সত্তা জেগে ওঠে। ক্ষমতার পায়ের তলায় অন্যকে পিষে ফেলতে চায়। একটা রেইনকোটের বর্ম এক মুক্তিযোদ্ধার শরীর থেকে অন্য সাধারণ মানুষের শরীরে গিয়ে তাকেও যেমন বিপদে ফেলে, আবার বর্মের আড়ালে মনের ভেতরেও বিরাট পরিবর্তন এনে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে তোলে। বৃষ্টি থেকে নিজের ত্রাণ পেতে যে বর্ম গায়ে জড়ানো, সেই বর্ম এবার গোটা একটা জাতির ত্রাণ খুঁজে দিতে উন্মুখ, তৎপর। পরিচালক অবশ্য সাহিত্যিকের গল্পের এই চাবিটাকে, ততটা মুখ্য করে ফুটিয়ে তোলেননি। রেইনকোটের পাশে চারপাশের আরও অনেক কিছুই রসায়নের এই অধ্যাপক মানুষটাকে একটু একটু করে পাল্টে ফেলেছে। ক্রিয়া–বিক্রিয়ায় প্রতিক্রিয়া ঘটাতে সাহায্য করেছে।
পাকিস্তানি সেনার হাতে নির্যাতন শেষ মুহূর্তে এসে সব থেকে বড় ভূমিকা নিল। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে যে কিছু জানে না, দাবি করে এসেছে; এখন বলছে সে সবকিছু জানে, কিন্তু কিছুই বলবে না। এখানে এই মুহূর্তে এসে একজন সাধারণ মানুষও অসাধারণ হয়ে নিজের প্রাণের বিনিময়ে দেশের মান রক্ষা করে গেল। নুরুল হুদা চরিত্রে শহীদুজ্জামান সেলিমও দেখিয়ে দিলেন, অভিনয়ের জগতে তিনি কত বড় যোদ্ধা। এ ছাড়া আমিনুর রহমান মুকুল, আসিফ মাহমুদ অদিতি, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, মোস্তাফিজ শাহীন সবার অভিনয় মনে দাগ কাটে। আসমা আর নুরুল হুদার মেয়ে সুধার চরিত্রে মারজান হোসাইন জারা, এই একরত্তি মেয়েটা বুঝতেই দিল না যে সে একটা চলচ্চিত্রে অভিনয় করছে। ছোট্ট শিশুদের মতো সে দেয়ালে আঁকিবুঁকি করে, দাড়ি কাটার সময় বাবার ঘাড়ে চড়ে বসে, বাবা নিখোঁজ হয়েছে, সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও ঘরের দুয়ারে বসে রংপেনসিল ছড়িয়ে ছবি আঁকে। মা তাকে পরিস্থিতি বুঝতে দেয়নি। কিন্তু পরিচালক তার ভাত খাওয়ার বিভিন্ন দৃশ্য সামনে নিয়ে এসে একটা শিশুর ক্রমেই একা হয়ে যাওয়ার অবস্থাটা আমাদের সামনে মেলে ধরেন।
এই চলচ্চিত্রের সুরকার অভিজিৎ বসু, চিত্রগ্রাহক সুধীর পালসানে, সম্পাদনায় সামীর আহমেদ—সবাই মিলে নিজেদের অসামান্যটুকু দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ব্যতিক্রমী ইতিহাস রচনা করলেন। বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক মানেই তিনি যেমন একজন লেখক হতে পারেন, তার কোনো মানে নেই; একজন চলচ্চিত্র শিক্ষকও ভালো পরিচালক সব সময় হয়ে উঠতে পারেন না। সেদিক থেকে শিক্ষক পরিচালক অঞ্জন দেশ-বিদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসকে যেমন মাথায় নিয়ে চলেন, প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে এসে প্রমাণ করে দিয়েছেন নান্দনিক সৃষ্টিশীলতায়ও তিনি যথেষ্ট দক্ষ।
বলতে দ্বিধা নেই, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও এমন অনেক মোটাদাগের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, যা দেখে কখনো কখনো মনে হয়েছে মুম্বাইয়ের কোনো অ্যাকশনধর্মী উত্তেজক ঝাড়পিটের সিনেমা দেখছি। কিন্তু সবাইকে বুঝতে হবে, মারপিটের সব সিনেমাগুলো কাল্পনিক, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটি বাস্তব ইতিহাস। অঞ্জন হিংসা, হানাহানি, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া—এসব দৃশ্য দূর থেকে ধারণ করেছেন। যতটা হিংসা না দেখালে ইতিহাসকে বোঝা যায় না, ততটাই দেখিয়েছেন। বাকিটা মুক্তিযুদ্ধের মূল কথা, মূল সত্যটাকে বাস্তবে বড় করে তুলে ধরে উচ্চ মার্গের সুরের স্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছেন। ছবির নাম দেখেই তো বোঝা যায়, ‘মেঘমল্লার’ কল্পনা এবং বাস্তবের মিশেলে অন্তর জাগরণে আমাদের মুক্তির হাতছানি।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত