মানুষ বিনে আর কিছু নাই

বাউল সাধক ভক্তদের গান পরিবেশনাছবি: শাহ আলম

পশ্চিমবঙ্গ সীমান্ত-লাগোয়া সবুজে ঘেরা ছোট্ট গ্রাম ইছাখালি। মেহেরপুর জেলার অতি সাধারণ একটি গ্রাম। অধ্যাত্মসাধক ও গীতরচয়িতা আরজান শাহ (১৮৮৫-১৯৫৮)-এর জন্ম-মৃত্যু ইছাখালিতেই। তিনি দেশে দেশে গান গেয়ে বেড়াতেন। স্বল্পশিক্ষিত হলেও উচ্চমার্গীয় ভাবুক ছিলেন, আসরে বসেই উচ্চমার্গের গান বাঁধতে পারতেন। প্রতিবছর দোলপূর্ণিমায় আরজান শাহের মাজার ঘিরে মেলা বসে। বছর দুয়েক আগে আমরা কজন বন্ধু আরজান মেলা দেখতে গিয়েছিলাম। চৈত্রের তপ্ত ধুলো উড়িয়ে, ফসলের মাঠ ভেঙে ইছাখালি-নফরচন্দ্রপুরে আরজান শাহের মাজার প্রাঙ্গণে যখন পৌঁছালাম, তখন সূর্য মধ্যগগন থেকে বসন্তের উজ্জ্বল রং ছড়াচ্ছে। চারদিকে প্রচণ্ড দাবদাহ, কিন্তু মনের ভেতর বসন্তের উতল হাওয়া। চারদিকে উৎসবের আমেজ। কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে হাজারো মানুষের উদ্বেল উপস্থিতিতে মাজার প্রাঙ্গণ জনারণ্যে পরিণত হয়েছে।

মেলা প্রাঙ্গণে উপস্থিত এক বাউল সাধককে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার নিবাস কোথায়?’ তিনি বললেন, ‘করিমপুরের গোবরডাঙা, নদীয়া জেলায়।’ আরেকজন বললেন, মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙা থানার গোপীনাথপুর। বিএসএফ-বিজিবির বদান্যতায় সীমান্তরেখা পার হয়ে তাঁদের অনেকে এসেছেন পশ্চিম বাংলার নদীয়া-বর্ধমান-মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে। পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর জেলার দূরপাড়াগাঁ থেকেও অনেকে এসেছেন। ইছাখালি-নফরচন্দ্রপুর গ্রামের পূর্বাংশ ইছাখালির অবস্থান বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানায়, আর নফরচন্দ্রপুর অংশটি পড়েছে পশ্চিমবঙ্গে। ১৯৪৭ সালে গ্রামটি দুভাগ হয়ে যায়। অবিভক্ত বঙ্গদেশের মতো একই ট্র্যাজিক নিয়তি বরণ করেছে ইছাখালি-নফরচন্দ্রপুর গ্রাম ও আরজান শাহের মাজার। তারপরও দুপারের মানুষের আবেগ-আত্মীয়তাকে ভাগ করা যায়নি। বিভেদ-বিভাজনের মধ্যে রয়েছে মিলনের আকুলতা। আরজান শাহের মাজারটি দুই বাংলার সহজিয়া সাধকদের সহজ মিলনের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। দোলপূর্ণিমা উপলক্ষে আরজান শাহের মাজার প্রাঙ্গণ ঘিরে দুই বাংলার মরমি সাধক ও আত্মীয়স্বজনের মিলনমেলা বসে। আরজান স্মরণ দিবস উপলক্ষে মাজার প্রাঙ্গণে পশ্চিমবঙ্গের এক নিভৃতচারী গায়ক গেয়ে ওঠেন—
‘মানুষ বিনে আর কিছু নাই,
নৈরাকারে ডিম্ব ’পরে ভেসেছে এই মানুষ গোঁসাই।’

বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক-মানবিক দর্শন ও চিন্তাধারা আজ প্রবল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। রাজনীতিতে অশুভ সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রকোপ বাড়ছে, বাড়ছে উগ্রতা ও অসহিষ্ণুতা। সেই সঙ্গে বাড়ছে লুণ্ঠন, ভোগবাদ, অবক্ষয় আর অসৎ অমার্জিত ব্যক্তিদের তাণ্ডব। সবচেয়ে হতাশ ও শঙ্কিত হতে হয় মানুষের কট্টর অবস্থান দেখে।

আরজান শাহ-রচিত এই গানের কথা একেবারে সহজ-সরল ও সাদামাটা। কিন্তু এর ভেতরে রয়েছে উদারতা, যুক্তি, ভক্তি, প্রেম-মানবিকতা ও মানবমনের অপার কৌতূহল। এই গানের কথায় রাজনৈতিক ভূগোলের পরিসীমা নেই, জাতিধর্মের নামে বাড়াবাড়ি নেই, সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি নেই। বাউলেরা গানে গানে মানবিকতা ও সম্প্রীতির বাণী ফেরি করে বেড়ায়। সত্তরের অসহযোগ আন্দোলনে ও মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে সব ধর্মের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি-সৌহার্দ্য ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য গানের কথা-সুর দিয়েই আমরা আত্মজাগরণ সৃষ্টি করেছিলাম। তাহলে কি বাঙালির অসাম্প্রদায়িক ভাবনার শিকড় বাংলার লোকায়ত সাধকদের মর্মছোঁয়া চিন্তারাশির গভীরে পোঁতা আছে আগে থেকেই? হ্যাঁ, তা-ই হবে। আর সেই দর্শন থেকে রস নিয়েই কি আমরা বাংলা সাহিত্যের বিস্তৃত প্রাঙ্গণে সোনা ফলিয়ে চলেছি? উল্লেখ করা প্রয়োজন, আমাদের আধুনিক চেতনা ও সাহিত্যভাবনার চাতালে যেমন বব ডিলান-জোয়ান বায়াজরা আছেন, তেমনি লালন-হাসনরাও রয়েছেন তাঁদের সরব উপস্থিতি জানান দিয়ে। বাংলার লোকায়ত মরমি ভাবুকতার ফেরিওয়ালা আরজান শাহও আমাদের ভাব-ভাবুকতার পরিধি বিস্তৃত করে দিয়ে গেছেন। অথচ আমাদের নগরমনস্ক বিদ্যাজীবীরা তাঁকে ও তাঁর গোত্রীয়দের চিনতে চাইলেন না।

আরজান মেলার ভাবগানের আসরে আমরা যারা মেহেরপুর থেকে গিয়েছিলাম, তাদের চিন্তা ও উপলব্ধির জগৎ কেমন যেন ওলটপালট হয়ে গেল। আমার এক বন্ধু আমাকে বলল, ‘তোমাকে মেহেরপুরের বাউলদের নিয়ে লিখতে হবে, ছড়িয়ে দিতে হবে তাদের অসাম্প্রদায়িক ভাবনা ও গান। বাংলাদেশকে একটি মানবিক দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্যও তাদের ভাবনাগুলো ছড়িয়ে দেওয়া দরকার।’ মাজার প্রাঙ্গণে বসেই সিদ্ধান্ত নিলাম, অজপাড়াগাঁয়ের সাধকদের অসাম্প্রদায়িক ভাবনাগুলো তুলে ধরার জন্য কাজ করতে হবে। মরমি সাধকদের অসাম্প্রদায়িক ভাবনা পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিতেই লিখে ফেলি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালির সম্প্রীতি সাধনা’। এরপর লিখি ‘বাঙালি মুসলমান সমাজের সংস্কৃতি ভাবনা’। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি: মেহেরপুর জেলা’ বইটি লিখি কথাসাহিত্যিক রফিকুর রশীদের সঙ্গে সহলেখক হিসেবে। বাউলদের সঙ্গ-সান্নিধ্য, তত্ত্ব ও গান আমার কল্পনার আকাশ ও চিন্তার জমিনকে প্রসারিত করেছে, অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে লিখতে। তাদের আখড়াবাড়ি–লাগোয়া গাছগাছালি ও উঠান, তাদের পরমতসহিষ্ণুতা আমাকে মানুষ ও প্রকৃতিলগ্ন হতে শিখিয়েছে। আমার লেখকসত্তার খোরাক সরবরাহ করেছে।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক-মানবিক দর্শন ও চিন্তাধারা আজ প্রবল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। রাজনীতিতে অশুভ সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রকোপ বাড়ছে, বাড়ছে উগ্রতা ও অসহিষ্ণুতা। সেই সঙ্গে বাড়ছে লুণ্ঠন, ভোগবাদ, অবক্ষয় আর অসৎ অমার্জিত ব্যক্তিদের তাণ্ডব। সবচেয়ে হতাশ ও শঙ্কিত হতে হয় মানুষের কট্টর অবস্থান দেখে। তারপরও স্বস্তি ও গৌরবের কথা, লালন-হাসন-রাধারমণ-আরজান শাহদের মতো সাধকদের উত্তরসূরিরা এখনো নিঃশেষ হয়ে যায়নি। মানবিকতা ও সহনশীলতার সপক্ষে তাঁদের যে গান, তা এখনো আমাদের সমাজে শিরদাঁড়া টান করে টিকে আছে। তাঁদের গান মানবিকতার পক্ষে, সাম্প্রদায়িক-সংকীর্ণতার বিপক্ষে। একটি ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ না টেনে পারছি না, আমার দাদা বানী আমিন মাস্টার বিশ্বাসে ও জীবনচর্যায় প্রগাঢ়ভাবে ধর্মনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি নিয়মিত নামাজ পড়তেন, কোরআন তেলাওয়াত করতেন এবং রোজা রাখতেন। ইসলামের যুক্তিসিদ্ধ ও শাশ্বত বিধিবিধানের সঙ্গে তাঁর ছিল গভীর আনুগত্য। তারপরও তিনি জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বভিত্তিক ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি সমর্থন করেননি, সমর্থন করতেন শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিমদের উদার অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে। নিজ ধর্ম ও সম্প্রদায়ের প্রতি উচ্চকিত আবেগ থাকা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ও সত্য উচ্চারণে অবিচল। পড়তেন রবীন্দ্র-নজরুল সাহিত্য। রুশ সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ছিল। সাম্প্রদায়িকতা নামক সংক্রামক ব্যাধি আমার দাদাকে কখনো স্পর্শ করতে পারেনি, যদিও তিনি সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির শিকার হয়ে ’৫০-এর দশকে উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গের নিজ বাসভূমি ত্যাগ করে পূর্ব বাংলায় চলে এসেছিলেন। শৈশবে তাঁর কাছে নিয়েছিলাম জীবনপাঠ, সাহিত্যপাঠ এবং মনুষ্যধর্মের পাঠ। তাঁর কাছেই পেয়েছিলাম মাওলানা আজাদ সোবহানি ও আবুল হাশিমের মানবিক দর্শনের দীক্ষা। আমার শিক্ষক বাবাও ছিলেন প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ। কৈশোরে বাবার কাছ থেকে পাওয়া গাজ্জালি-রুমি-হাফিজের মিস্টিক ভাবনা আমার উপলব্ধির জগৎ প্রসারিত করে দেয়। আমার ধর্মপ্রাণ দাদা, আমার আদর্শনিষ্ঠ বাবা এবং অজপাড়াগাঁয়ের মরমিরা ধর্মেও বিশেষত ইসলামের সঙ্গে যুক্তিসম্মত সমঝোতা স্থাপন করে যাপন করে গেছেন সাদামাটা অথচ বর্ণাঢ্য জীবন।

যুক্তিহীনতা ও ধর্মান্ধতার কাছে আত্মসমর্পণ না করেও তাঁরা ধর্মপ্রাণ ছিলেন। আরজান শাহও যাপন করে গেছেন সাদামাটা আটপৌরে জীবন। মাজার প্রাঙ্গণে গিয়ে সেটাই মনে হয়েছিল। মাজার প্রাঙ্গণে উপস্থিত মরমিয়া ভাবুকদের তত্ত্ব আলোচনা, গানের ঝরনাধারা এবং বিচিত্র মানুষের সান্নিধ্য আমাকে চিনিয়ে দেয় অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবিক সম্প্রীতির প্রশস্ত পথটি। তাঁদের ভাব-ভাবনা আজও আমাকে আলোকস্তম্ভের মতো পথ দেখায়। তাঁরাই আমাকে পড়ায়, লেখায় এবং যা কিছু ভালো তার সঙ্গে থাকতে অনুপ্রেরণা জোগায়।

সভাপতি, মেহেরপুর বন্ধুসভা এবং সহযোগী অধ্যাপক, মেহেরপুর সরকারি কলেজ