বসন্তবেলা

বসন্তে রাঙা পলাশের ফুলে টিয়ার নাচনছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

বসন্ত মানে কবিতাবেলা, ভালোবাসার পঙ্‌ক্তিমালা আর এলোমেলো হাওয়ার দিন। বসন্ত মানে শিমুল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়ায় রঙিন। শীতে ঝিমিয়ে যাওয়া প্রকৃতিতে বইতে শুরু করেছে বসন্তের মাতাল হাওয়া। ঝরাপাতার দিন শেষে নির্জীব প্রকৃতিতে প্রাণের সঞ্চার করতে ঋতুরাজ বসন্তের আবির্ভাব হয়। যে নিষ্প্রাণ প্রকৃতিতে প্রাণের সঞ্চার ঘটায়, অকৃপণ হাতে সাজিয়ে দেয় নিজের সবটুকু ঢেলে; রাজমুকুট তো তারই মাথায় শোভা পায়। এ কারণেই বসন্ত ঋতুদের রাজা, ঋতুরাজ বসন্ত।

এ সময় ডালে ডালে নতুন পাতা ও কুঁড়ি বসন্ত–বন্দনায় মেতে ওঠে। তাদের আনন্দে শামিল হতে মগডালের আড়াল থেকে ডেকে ওঠে লাজুক কোকিল। ফুল আর ফুলের সুবাসে ভরে ওঠে বনবাদাড়। বাহারি রঙের ডানা মেলে নেচে বেড়ায় প্রজাপতির দল। পাখিদের কিচিরমিচির আর কলতানে মনে হয় পক্ষীকুলের বনসভা বসেছে ধরায়। আম্রমুকুল আর বাতাবিলেবু ফুলের গন্ধে পাগল করে মন। বসন্তে প্রকৃতি সৌন্দর্যের দুয়ার খুলে নিজেকে মেলে ধরে এক অপরূপ রূপে।

বসন্ত ফুলের ঋতু। এ সময় নানা রঙের ফুল ফুটলেও বসন্তের ফুল বলতে প্রথমেই বাসন্তী রঙের গাঁদার ছবিই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এ ছাড়া এই ঋতুতে অশোক, রক্তকাঞ্চন, রক্তকরবী, দেবদারু, নাগেশ্বর, মহুয়া, পলাশ, শিমুল, কৃষ্ণচূড়া ইত্যাদি ফুল ফোটে। প্রকৃতিকে সাজাতে পিছিয়ে থাকে না ঘাসের গালিচা আর বনবাদাড়ে ফোটা নাম না–জানা বনফুলও। এত ফুলের ভিড়ে শিমুল, পলাশ আর কৃষ্ণচূড়া প্রকৃতিতে রঙের আগুন ছড়িয়ে বসন্ত সৌন্দর্যে আলাদা মাত্রা যুক্ত করে। এ কারণেই বসন্তকে আগুনঝরা ফাগুন বলে ডাকা হয়।

বসন্তকালে আবহাওয়া তুলনামূলক ঠান্ডা থাকে। যাকে বলে শরীরের সঙ্গে জুতসই আবহাওয়া। দিনের বেলা হালকা গরম থাকলেও বেলা গড়িয়ে এলেই কিছুটা ঠান্ডা অনুভূত হয়। বসন্ত সন্ধ্যার অদ্ভুত এক ঘোর আছে। সন্ধ্যার মুখে আধো আলোছায়ায় যখন দক্ষিণের মৃদুমন্দ বাতাস অজানা ফুলের গন্ধ মেখে চোখেমুখে পরশ বুলিয়ে দেয়, তখন একমুহূর্তে মন ভেসে যায় দূর থেকে দূরে। চিন্তার জাল এলোমেলো করে কখনো ভাসায় সুখের অনুভূতিতে আবার কখনো–বা বিষাদের বানে। তাই তো রবীন্দ্রনাথ কখনো বলেছেন, ‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান। তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান; আমার আপনহারা প্রাণ, আমার বাঁধন-ছেড়া প্রাণ’। আবার কখনো বলেছেন, ‘আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে, বসন্তের এই মাতাল সমীরণে’।

মুগ্ধতার ঋতু, বিস্ময়ের ঋতু বসন্ত। বসন্তের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন মানুষকে মুগ্ধ করে, তেমনি রহস্যঘেরা সৌন্দর্যে ডুবিয়েও রাখে অপার বিস্ময়ে। বসন্ত শূন্য হৃদয় ভরিয়ে দেয়, মনের বিবর্ণ ক্যানভাসে আঁচড় কাটে বাহারি রঙের তুলিতে। যাঁরা প্রকৃতি ভালোবাসেন, তাঁদের জন্য বসন্ত সৌন্দর্যের স্বর্গরাজ্য। যুগ যুগ ধরে বসন্ত মানুষকে করেছে প্রেমিক, ভাবুক, কবি ও সাহিত্যিক। তাই তো বসন্তকে ঘিরে এত গান, কবিতা আর গল্পমালা রচনা হয়েছে, যা যুগ যুগ ধরে মানুষের মনের খোরাক জুগিয়ে আসছে।

বনশ্রী, ঢাকা