ব্রেইনস

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বিকেল গড়িয়ে  রাত। হিমা বসে আছে হাসপাতালের করিডরে। কোনোমতে একটা বসার জায়গা জোগাড় হয়েছে। লোকে লোকারণ্য। তিল ধারণের ঠাঁই নেই যেন। এখানে-ওখানে দেয়ালের সঙ্গে গা এলিয়ে বসে আছে সবাই। সবার চোখেমুখে ক্লান্তি স্পষ্ট। ঘামের তীব্র আঁশটে গন্ধে বমি পায়। ঘুম আসে না হিমার। জেগে জেগে সে বাবার কথা ভাবে।

হিমার বাবা, লতিফ সাহেব প্রচণ্ড অসুস্থ। তীব্র মাথাব্যথায় শরীরের একদিক বিকল। প্রাণ যায় যায় অবস্থা। হাসপাতালে আসতেই চিকিৎসক এমআরআই করে জানায়, মাথায় এভিএম টিউমার আছে, তৎক্ষণাৎ অপারেশন করতে হবে। হিমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। আঠারো পেরিয়ে উনিশে পা দেওয়া হিমার জন্য এসব সহ্য করা সহজ নয়। সিদ্ধান্ত হলো, অপারেশন হবে, আজ রাতেই হবে।

এই হাসপাতালে অবস্থানরত প্রত্যেকেরই অবস্থা অনেকটা একই রকম। তীব্র দাবদাহ আর শব্দদূষণে নাকাল জনজীবন। ছোট্ট সেই জবুথবু হিমার বেড়ে ওঠা যে গ্রামে, রাউজান, আজ বসবাসের অযোগ্য। শিল্প–কলকারখানা শহর পেরিয়ে এখন গ্রামের পথ ধরেছে। তার প্রভাবে সুস্থ দেহে বাসা বাঁধছে মরণব্যাধি, জন্ম নিচ্ছে বিকলাঙ্গ শিশু। চট্টগ্রাম ছেড়ে সবাই পাড়ি জমাচ্ছে পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোয়।
রাত এগারোটা বেজে ত্রিশ মিনিট। লতিফ সাহেবকে স্ট্রেচারে করে ওটির দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। হিমা নিষ্কম্প দাঁড়িয়ে রইল।
চিকিৎসক ডেপ দাঁড়িয়ে আছেন ব্যালকনিতে। দূরে নদীর ওপারে কিছু একটা দেখছেন উনি। হাতে ধরে থাকা গরম কফি থেকে কুয়াশার মতো ধোঁয়া উড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ তাঁর সহকারী লিলিন এসে উৎফুল্ল স্বরে বলল, স্যার, একটা সুখবর আছে।
‘বলো,’ কফিতে চুমুক দিতে দিতে আনমনে বললেন চিকিৎসক ডেপ।
‘স্যার, এবার বোধ হয় আমরা একটা ব্রেইন জোগাড় করতে পারব। আপনি আবার পুরোনো গবেষণা শুরু করতে পারবেন,’ উত্তেজিত কণ্ঠে বলল লিলিন। বাইরে প্রবল বেগে বরফ পড়ছে। এমতাবস্থায় বাইরে গেলে ফ্রস্ট বাইট দেখা দেবে নিশ্চিত। ভেতরে ভেতরে একটা তীব্র পৈশাচিক আনন্দ আর চাপা উত্তেজনা অনুভব করলেন চিকিৎসক ডেপ। এত দিনে তাহলে স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে! শান্ত গলায় বিস্ময়ের সুরে বললেন, ‘কী বলো!’
‘স্যার, বাংলাদেশ থেকে আপনার বন্ধু চিকিৎসক ইহান ফোন করেছিলেন। উনি বললেন যে আজ ওনার ওখানে এক স্ট্রোকের রোগী গেছে। সে এভিএমে আক্রান্ত। আরও বলেছেন যে ব্রেইনটা উনি বের করে আপনাকে দিতে চান।’ একগাল হেসে অবিন্যস্ত চুলগুলো ঠিক করতে করতে বলল লিলিন।

উত্তেজনা যেন আরও বাড়তে থাকল চিকিৎসক ডেপের। স্মিত হেসে লিলিনকে ফোন করে প্রস্তাবে রাজি হওয়ার কথা জানাতে বললেন। কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। ওটাতে চুমুক দেওয়া জরুরি।

বছর পাঁচেক আগে জেলে যেতে হয় চিকিৎসক ডেপকে। বয়সটা তখন বোধ হয় চল্লিশের কোঠায়। সরকারের অনুমোদন ছাড়াই গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করে গবেষণা করছিলেন তিনি। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে চুরি করে এনেছিলেন গবেষণার নানা বস্তু। শেষবার আফ্রিকা থেকে এক বৃদ্ধার মৃতদেহ চুরি করার দায়ে তাঁকে জেল খাটতে হয়। সিলগালা করে দেওয়া হয় তাঁর সেই পুরোনো গবেষণাগার। জেল থেকে বেরিয়ে আবার নেমে পড়েন গবেষণার কাজে। বোস্টন শহর থেকে দূরে লোকচক্ষুর আড়ালে গড়ে তোলেন নতুন গবেষণাগার, ব্রেইনস।
চিকিৎসক ইহান জানতেন, তাঁর বন্ধু এমন প্রস্তাবে না করতে পারবে না। তাই তিনি আগে থেকেই সবকিছুর প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। লতিফ সাহেবের হাইব্রিড নিউরোসার্জারি করা হবে।
চিকিৎসক ইহান বসে আছেন কন্ট্রোল রুমে। সব মনিটর করছেন। কয়েক মাস আগে নিজ প্রয়োজনে সাইবার নাইফ রোবট কেনেন। সামান্য মডিফাই করে ক্রেনিয়েক্টমি করার উপযোগী করে তোলেন।
সাইবার নাইফকে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো ওটিতে। সব প্রস্তুতি শেষ। বিশেষজ্ঞ দলের প্রত্যেকে বসে আছেন বড় একটা মনিটরের সামনে। সবাই উদগ্রীব। এই অপারেশনের পুরোটাই হবে রোবটদের দিয়ে। প্রয়োজনে পেছন থেকে নির্দেশনা দেবেন চিকিৎসক ইহান।

অপারেশন শুরু হয়ে গেছে। কমপ্রিহেনসিভ অ্যাপ্রোচের প্রথম ধাপ হিসেবে নিউরো ক্যাথল্যাবে কেমিক্যাল এম্বোলাইজেশনের মাধ্যমে রক্তনালি বন্ধ করা হয়েছে। সবাই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন লতিফ সাহেবের মস্তিষ্কের দিকে। এত সূক্ষ্ম হওয়া সত্ত্বেও বিশেষ ক্যামেরার মাধ্যমে কন্ট্রোল রুমে বসেও বেশ ভালোই ঠাহর করা যাচ্ছে সবটা। প্রফুল্ল সবাই। অপারেশনটা হলে পকেট একদম ভরে যাবে। মাথায় এখন একটাই চিন্তা, মোটা অঙ্কের টাকা পকেটে আসবে। সেসব দিয়ে অনায়াস কেটে যাবে বেশ কিছু বছর।

ক্রেনিয়েক্টমি শেষ। খুলি সরিয়ে রক্তনালি থেকে টিউমার আলাদা করা হয়েছে, সঙ্গে আস্ত মগজটাও বের করে আনা হয়েছে। সাইবার নাইফের কাজ আপাতত শেষ। সফল অপারেশনের ব্যাপারে জানিয়ে দেওয়া হলো চিকিৎসক ডেপের সহকারীকে। এখন মস্তিষ্কটা পগার পার করতে পারলেই শান্তি। চিকিৎসক ইহান স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। অন্য এক স্টাফকে নির্দেশ দিলেন মস্তিষ্কটা দ্রুত বোস্টনে পাঠাতে।

ক্রিং ক্রিং আওয়াজে বেল বাজছে। বাইরে বরফ পড়ছে। তাপমাত্রা কমে মাইনাস ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ঠেকেছে। আকাশের মেজাজ-মর্জিও আজ ভালো না। এমন সময় কে আসতে পারে এখানে? ভাবতে ভাবতেই ফটকের দিকে এগোতে লাগল লিলিন।
‘কে?’ দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল লিলিন।
‘ম্যাম, একটা পার্সেল আছে।’ দরজার ওপার থেকে বলল কেউ। কণ্ঠটা অনেকটা যান্ত্রিক শোনাল লিলিনের কাছে। দরজার ওপাশে হয়তো কোনো রোবট রয়েছে। খুলবে কি খুলবে না, এমন দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে ভুগতে হঠাৎ তার চিকিৎসক ইহানের কথা মনে পড়ল। গতকাল রাতে কথার ভেতর চিকিৎসক ইহান বলেছিলেন যে তারা হয়তো কোনো একটা রোবট দিয়ে মস্তিষ্কটা বোস্টনে পাঠাবে, নিরাপত্তার স্বার্থে। মনে পড়তেই উৎফুল্ল হয়ে উঠল লিলিন। দরজা খুলে মাঝারি মাপের একটা বাক্স বুঝিয়ে দিয়েই চলে গেল রোবটটা। দেখে বোঝার উপায় নেই যে সে আদতে মানুষ নয়, মানুষরূপী একটা যন্ত্র।

বিকেল গড়িয়ে রাত। শীত বেড়েই চলেছে। বারবার নিউজ চ্যানেলগুলোয় জনগণকে বাড়িতে থাকতে বলা হচ্ছে। ব্যাপক হারে ফ্রস্ট বাইট দেখা দিচ্ছে বোস্টনে। লিলিন জানালার কাছে বসে আছে। রাতের আঁধারে সবটা কালো, প্রকৃতি দেখার সুযোগ নেই। হঠাৎ দরজায় সজোর ধাক্কা মেরে ল্যাবে প্রবেশ করলেন চিকিৎসক ডেপ। এত ভারী ভারী কাপড় পরেও ঠান্ডা ঠেকানো যায় না। তাঁর হাতের আঙুলগুলো খানিকটা সাদাটে দেখাচ্ছে। চিকিৎসক ডেপ নিজেকে উষ্ণ করার চেষ্টা করতে লাগলেন।
রাত একটা বেজে তেরো মিনিট। লিলিন চেষ্টা করছে বাক্সটা খোলার। চিকিৎসক ডেপ এখন অনেকটাই সুস্থ। পাশে দাঁড়িয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। অবাক নজরে তাকিয়ে আছেন তিনি।

মস্তিষ্কটা একটা গ্লাস শেলে ভরা। লিলিন সন্তর্পণে সেটাকে নিয়ে ল্যাবের বড় টেবিলে রাখল। বক্র হাসি হেসে চিকিৎসক ডেপ এগিয়ে গেলেন সেই গ্লাস শেলের দিকে। ভেতরে ভেতরে একটা তীব্র চিত্তচাঞ্চল্য। অবশেষে স্বপ্ন তাঁর সত্যি হচ্ছে। তর সইতে না পেরে গ্লাস শেলটা হাতে নিতেই খটকা লাগল। আরও কিছু সময় গবেষণার পর বুঝতে পারলেন যে এটা আদতে স্টেম সেল থেকে তৈরি। সত্যিকারের কোনো মানুষের মস্তিষ্ক নয়। ঠকানো হলো তাহলে!
‘শোনো, তোমার বাবা এখন সুস্থ আছেন। আর আমরাও ট্র্যাক করে ফেলেছি চিকিৎসক ডেপের নতুন গবেষণাগার। তুমি সুস্থ বোধ করলে আসতে পারো আমাদের সঙ্গে।’ চিকিৎসক ইহান হিমাকে বললেন। হিমা বসে আছে তার বাবার কেবিনের বাইরে। উদ্ভ্রান্ত দেখাচ্ছে তাকে, তবে বাবার সুস্থতার কথা শোনার পর কিছুটা ভালো লাগছে।
‘না, থাক।’ হিমা বলল।
‘আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি বরং বিশ্রাম নাও। আর চিকিৎসক ডেপকে খুব দ্রুত ধরে ফেলব আমরা।’ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন চিকিৎসক ইহান। তাড়া আছে বোধ হয়। ‘জানোই তো, এই হাসপাতালে কিছু অর্থলোভী মানুষও আছে। তাদের জন্যই মূলত নাটকটা করা। কিছু দিন আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য একটা মৃতদেহ দান করেছিলেন এক ব্যক্তি। সেই মৃতদেহই সুবিধা করে দিল। চিকিৎসক ডেপ মস্তিষ্ক পেয়েই মোটা অঙ্কের টাকাও পাঠিয়ে দিলেন। ভালোই হলো। যা হোক, পরে কথা হবে।’ বলেই কেবিনের পাশে থাকা সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতে লাগলেন চিকিৎসক ইহান।
হিমা মলিন দৃষ্টিতে দেখছে চারপাশ। প্রত্যেকেই বিধ্বস্ত। কবে অবসান হবে এই অলীক জীবনের!